যানজট বাংলাদেশের, বিশেষ করে রাজধানী শহরের অতিপরিচিত দৃশ্য, আলোচিত বিষয়, যা নাগরিক জীবনের জন্য এক ভোগান্তি। প্রতিদিন রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব, রামপুরা, বনশ্রী, মধ্য বাড্ডা, মালিবাগ, তেজগাঁও, মগবাজার, গুলিস্তান, মহাখালীসহ বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের দৃশ্য দেখা মেলে।কিন্তু কেন এই তীব্র যানজট, তা প্রশ্ন থেকেই যায়!
সকালে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হওয়া মানুষ, শিক্ষার্থীরা শিক্ষা অর্জনের জন্য কিংবা রাজধানীর কর্মজীবীরা তাঁদের গন্তব্যে বের হয়েই ভয়াবহ যানজটের কবলে পড়তে হয়। তাঁরা সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন না। মাঝেমধ্যে যানজটের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র থাকে যে ক্ষেত্রবিশেষে ১০-১৫ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে ঘণ্টাতেও পার হওয়া যায় না। কিন্তু কেন এই তীব্র যানজট।
রাজধানীর তীব্র যানজটের প্রধান কারণ হচ্ছে, অতিরিক্ত প্রাইভেট কারের উপস্থিতি। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাইভেট কার। অনেক পরিবারের একাধিক প্রাইভেট কার রয়েছে। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, একজন চালক ও একজন যাত্রী। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেট কার।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনার ত্রুটি যানজটের অন্যতম একটি কারণ হতে পারে। একটি মেগাসিটিতে শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। এই রাস্তার অনেক জায়গা আবার বিভিন্ন অবৈধ দখলদারের হাতে।
রাস্তায় ফুটপাত, ময়লার ভ্যান, যত্রতত্র গাড়ি রেখে রাস্তাকে সংকীর্ণ থেকে আরও সংকীর্ণতর করে ফেলা হচ্ছে। ট্রাফিক আইন অমান্য করার ফলে রাস্তার স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া চালকের অদূরদর্শিতা, শহরমুখী মানুষের স্রোত, অপ্রশস্ত রাস্তা প্রভৃতি বিষয়ও যানজটের অন্যতম কারণ।
যানজটের কারণে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, আমাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। অসহনীয় যানজটের কারণে একজন মানুষের প্রতিদিনের ৮-১০ কর্মঘণ্টার মধ্যে বড় একটা সময় রাস্তায় কাটাতে হয়।
স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কিংবা কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনে যানজটে থাকার কারণে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্কুল শেষে তাদের বিনোদন বা খেলাধুলার জন্য যে সময়টা দরকার, তা নষ্ট হচ্ছে যানজটে বসে থেকে।
আমাদের দেশের অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে, যাঁরা বিদেশে পড়াশোনার জন্য গিয়ে আর দেশে ফিরছেন না। কারণ, দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে রাজধানীর নগরজীবন। ফলে দেশ মেধাবী ছেলেমেয়ে হারাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকার ফলে নগরীর বায়ু দূষিত হচ্ছে। ফলে অ্যাজমা, হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামছে প্রায় ২০০ ধরনের নতুন পরিবহন। ২০৩০ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা হবে ৩ কোটি। তাই যানজট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি। রাজধানী শহরকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করার জন্য সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন জরুরি।
যানজটের সমস্যা নিরসনে কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে, যা বাস্তবায়িত হলে যানজটের সমস্যা থেকে নগরবাসী মুক্তি পেতে পারেন:
১. যানজটের সমস্যা নিরসনে দেশি-বিদেশি সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এ কমিশন যানজটের প্রকৃত কারণ নির্ণয়সহ সমাধানের পরামর্শ দিতে ও প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দেবে।
২. রাজধানী ঢাকায় প্রাইভেট কারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাধিক্য যানজটের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়।
৩. চৌরাস্তাগুলোতে টানেল নির্মাণ, ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ট্রাফিক পুলিশের জনবল বৃদ্ধি করা, ঢাকা থেকে বের হওয়া এবং ঢোকার রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা।
৪. বড় বাজারগুলোর ওপর ছোট আকারের ফ্লাইওভার নির্মাণ করা, গাড়ির চালক এবং পথচারীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।
৫. যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা ও গাড়ি ঘোরানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা দরকার।
৬. ট্রাফিক পুলিশকে আধুনিক সরঞ্জাম ও বিদেশি প্রশিক্ষক দ্বারা প্রশিক্ষণ দেওয়া
৭. অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ফুটপাত ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে।
৮. শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
রাজধানীর তীব্র যানজট নিরসনে আমাদের সবার সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। নাগরিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। উন্নয়নের যাত্রাকে আরও গতিশীল করতে যানজট সমস্যার সমাধানের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা মনে করি, এসব উল্লিখিত বিষয়ের আংশিক বাস্তবায়িত হলেও যানজট অনেকটা কমে আসবে।
সাকিবুল হাছান
শিক্ষার্থী ঢাকা কলেজ, ঢাকা