হাওর-বাঁওড়-নদী-পাহাড়বেষ্টিত ঐতিহ্যবাহী জনপদের নাম নেত্রকোনা। আউল-বাউল, মহুয়া-মলুয়াসহ অগণিত পালা-লোকগাথা-কেচ্ছা-কাহিনির স্বর্ণগর্ভা জনয়িত্রী নেত্রকোনা। পাহাড়-হাওর-বাঁওড়ের সৌন্দর্য ও স্থৈর্য নেত্রকোনাবাসীকে দিয়েছে ভাবের গভীরতা। আউল-বাউলের উদার মানবিকতা নেত্রকোনাকে দিয়েছে উচ্ছল প্রাণের সমৃদ্ধি।
সাহিত্য-সংস্কৃতি, চারু-কারুকলাতে নেত্রকোনা বেশ সমৃদ্ধ অঞ্চল। বিশেষত মাটিসংলগ্ন ভাব ও ভাবনাতে এ অঞ্চলের জুড়ি মেলা ভার। তবে বর্তমান উন্নয়নসূচক—শিক্ষা, সম্পদ ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এ জেলা অনেক পিছিয়ে। এখানে শিল্পকারখানা নেই; নেই বড় কোনো কারবারি প্রতিষ্ঠান বা নাগরিক জীবনধারণের প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা। এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষত সড়ক যোগাযোগ—এটা যেন ভূতের পথচলার মতো; সামনে নয়, দিন দিন পেছনের দিকে হেঁটে চলেছে।
সদরসহ নেত্রকোনা জেলায় মোট ১০টি উপজেলা রয়েছে। এর মধ্যে জেলা সদরের সঙ্গে খালিয়াজুরি উপজেলার সড়ক সংযোগ নেই। দুর্গাপুর, পূর্বধলা, আটপাড়ার সঙ্গে সড়ক সংযোগ থাকলেও এ সড়কে বাস চলাচল করে না। বারহাট্টা-মোহনগঞ্জ, কেন্দুয়া, মদন ও কলমাকান্দায় নিয়মিত বাস চলাচল করে। আন্তজেলার ক্ষেত্রে বাস যোগাযোগ আছে কেবল ময়মনসিংহের সঙ্গে। ওই বাস চলাচলের হালহকিকত, সেটা মর্মপীড়ার জন্ম দেয় শুধু।
নেত্রকোনা-খালিয়াজুরির দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার প্রায়; দূরত্ব খুব বেশি নয়, কিন্তু যাতায়াতে চরম হাঙ্গামা পোহাতে হয়। প্রথমে নেত্রকোনা থেকে বাসে চড়ে মদন বা মোহনগঞ্জ যেতে হয়। ওখান থেকে চড়তে হয় নতুন যানে। বর্ষাকালে ট্রলার, শুকনাকালে মোটরসাইকেল, সিএনজি, টেম্পো ইত্যাদি। যাতায়াতের মাধ্যম যা-ই হোক, দূরত্বের তুলনায় অর্থ এবং সময়—দুটোতেই অপচয় আর অপচয়। এ রকম যানে দুর্ঘটনা যেন স্বাভাবিক ঘটনা। বড় দুর্ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায়, ছোটগুলো ‘কপালের লিখন’ হিসেবে বিস্মৃতিতে তলিয়ে যায়।
আগেই বলেছি, নেত্রকোনা-আটপাড়া-পূর্বধলা-দুর্গাপুর সড়কে বাস চলাচল করে না। কেন চলে না, এর যথাযথ কোনো উত্তর নেই। এখানকার যাতায়াতের বাহন—মোটরসাইকেল, সিএনজি, টেম্পো, অটোরিকশা ইত্যাদি। একুশ শতকে জেলা সদর থেকে উপজেলায় যেতে কি যে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়, ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন।
গত শতকের নব্বই দশক থেকে একুশ শতকের তৃতীয় দশক—অনেকটা সময়। এর মধ্যে আমরা কত কী ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে এগিয়েছি। পদ্মা সেতু তৈরি করেছি, মেট্রোরেল বানিয়েছি, মহাকাশে পাঠিয়েছি উপগ্রহ। এসব অর্জনের ভিড়ে নেত্রকোনার সড়ক যোগাযোগ আমাদের যেন নিত্য পরিহাস করে চলেছে। মূল্যবৃদ্ধির যুগে আমাদের সময়ের মূল্য অভাবিতভাবে কমে যাচ্ছে। এ শোচনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় কি নেই? সত্যিই কি নেই?
নেত্রকোনার সঙ্গে যেসব উপজেলার সড়ক যোগাযোগ আছে, এর কোনোটার দূরত্বই ৩০ কিলোমিটার মিটারের বেশি নয়। পথের দূরত্ব কম হলেও পথে নামলে মনে হবে ‘এ বুঝি অন্তহীন পথ’। যার শুরু আছে শেষ নেই; এর কারণ একাধিক। প্রথমত, এসব রোডে চলাচলকারী বেশির ভাগ গাড়িই পুরোনো, কোনো কোনোটা চলাচলেরই অযোগ্য। দ্বিতীয়ত, এ সড়কের অধিকাংশ চালকই নবীন, কেউ কেউবা ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন। তৃতীয়ত, এ অঞ্চলের প্রতিটি সড়কের অবস্থাই শোচনীয়। একে তো সরু পথ, এর ওপর স্থানে স্থানে গর্ত, খানাখন্দ, হাট-বাজারের ভিড়। চতুর্থত, ধারণক্ষমতার তুলনায় বেশি যাত্রী বহন। ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি, হইচই, চেঁচামেচি, ভাড়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, যাতে চালকের মনঃসংযোগ নষ্ট হতে বাধ্য। বাসে ওঠার পর যাত্রী মাত্রেরই মনে হবে, তারা যেন খাঁচাবন্দী পাখি।
ওসব রোডে সময়ের হিসাব করে বাসে চড়ার উপায় নেই; বাস কখন গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে, এটা কেউ জানে না। হেলে-দুলে কিছুক্ষণ চলবে, তারপর কারণে অকারণে থামবে ; সময় নিয়ে প্রশ্ন তুললে- উপদেশ শুনতে হবে, ‘এবার থেকে প্রাইভেট কারে চড়বেন।’৩০ কিলোমিটার যেতে দেড়-দুই ঘণ্টা, আড়াই-তিন ঘণ্টা সময় যা-ই লাগুক, রাগ-ক্ষোভ চেপে চুপটি করে বসে থাকতে হবে। এ-যেন নিয়তির লেখন, এড়াবার পথ নেই।
নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ এ-অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা ব্যস্ত সড়ক। দুই জেলার মধ্যে দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার; নব্বই দশকে এ সড়কে গেটলক ও লোকাল—দুই ধরনের বাস চলাচল করত। গেটলক সময় লাগত বড়জোর ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট; লোকালে ১০ থেকে ১৫ মিনিট বেশি। এখন এ রোডে গেটলক চলে না; সবই লোকাল।
সময় বাসে লেখা আছে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট। কিন্তু বাস্তবে লাগে দেড় ঘণ্টা প্রায়। অর্থাৎ, নব্বই দশকে যে সময় লাগত, এখন এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় হয়। বিজ্ঞান মানুষকে বেগ দিয়েছে, কিন্তু এ অঞ্চলকে দিয়েছে শম্বুক-ধীরতা। খরগোশ-কচ্ছপের গল্পের মাহাত্ম্য- আর কেউ অনুসরণ না করুক, এ রোডের বাস তা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে চলে।
কয়েক বছর আগে নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ সড়কটি নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে সড়কের স্থানে স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত শ্যামগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ অবধি—বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থার জন্য বালু এবং মাছভর্তি ট্রাকই দায়ী।
দুর্গাপুর-কলমাকান্দা-মোহনগঞ্জ থেকে অগণিত মাছভর্তি ট্রাক পানি ছড়াতে ছড়াতে প্রতিদিন যায় ঢাকা-চট্টগ্রামের দিকে। এর ওপর ‘ওভারলোডেড’ হাজার হাজার বালুভর্তি ট্রাক দুর্গাপুর থেকে যাতায়াত করে দেশের বিভিন্ন অংশে। এ দুয়ে মিলে রাস্তার সর্বনাশ ঘটাচ্ছে অকালে।
গত শতকের নব্বই দশক থেকে একুশ শতকের তৃতীয় দশক—অনেকটা সময়। এর মধ্যে আমরা কত কী ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে এগিয়েছি। পদ্মা সেতু তৈরি করেছি, মেট্রোরেল বানিয়েছি, মহাকাশে পাঠিয়েছি উপগ্রহ। এসব অর্জনের ভিড়ে নেত্রকোনার সড়ক যোগাযোগ আমাদের যেন নিত্য পরিহাস করে চলেছে। মূল্যবৃদ্ধির যুগে আমাদের সময়ের মূল্য অভাবিতভাবে কমে যাচ্ছে। এ শোচনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় কি নেই? সত্যিই কি নেই?
বিধান মিত্র
অধ্যক্ষ, নেত্রকোনা সরকারি মহিলা কলেজ
নেত্রকোনা