শীতের কুয়াশার মতো ধুলায় আচ্ছাদিত রাস্তা। চলন্ত যানবাহনের পেছনে কুণ্ডলি পাকিয়ে বাতাসে উড়ছে ধুলা-বালু। সড়কে দুই পাশের দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ধুলায় সয়লাব। এর ফলে বিশ্বের আর সব দূষিত বায়ুর শহরকে পেছনে ফেলে কয়দিন পরপরই এক নম্বরে উঠে আসছে রাজধানী ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা জানান, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫-এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীসহ সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বায়ুদূষণের কারণে প্রথমেই প্রভাব পড়ে শ্বাসযন্ত্রের ওপর। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে, তার অধিকাংশই বায়ুদূষণজনিত। ধূলিকণা নিশ্বাসের সঙ্গে রক্তে মিশে গিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে এ সময় নানা অসুখে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ জন্য ধূলিকণা প্রতিরোধক ব্যবস্থা যেকোনো মূল্যেই নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সর্দি, জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা, কাশি, অ্যাজমার মতো রোগের প্রকোপ বাড়বে। জ্বর, কাশির অন্যতম কারণ হচ্ছে দূষিত বায়ু। বিশেষ করে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, কাশিসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। বিশেষ করে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণ বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। নাজেহাল হচ্ছেন রাস্তায় দায়িত্বরত পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশের সদস্য, ভ্যানগাড়ি, রিকশাচালকসহ গণপরিবহনের চালক ও যাত্রীরা।
ঢাকায় ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে বাতাস চারদিকে ছড়াতে পারে না। এতে বাতাসে ধূলিকণার উপস্থিতি ভারী হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত এক জরিপে জানা গেছে, দেশের ১৮টি জেলার বায়ু আদর্শ মানের চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় দূষিত। ১৮টি জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে গাজীপুরে, এরপরই রয়েছে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ। ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশে যেন বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। একই সঙ্গে ২০২০ সালে বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। নয় দফা নির্দেশনায় বলা হয়, ১. ঢাকা শহরে মাটি/বালু/বর্জ্য পরিবহনের ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহনের গাড়ির মালামাল ঢেকে রাখা ২. নির্মাণাধীন এলাকার মাটি/পলি/সিমেন্ট/পাথর/নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা ৩. সিটি করপোরেশন শহরে পানি ছিটাবে ৪. রাস্তা, কালভার্টসহ উন্নয়নকাজে টেন্ডারের শর্ত পালন করতে হবে ৫. কালো ধোঁয়া নিঃসরণকৃত গাড়ি জব্দ করতে হবে। ৬. সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী গাড়ির চলাচল নিশ্চিত ও সময় উত্তীর্ণ গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। ৭. অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতেই হবে। ৮. পরিবেশ লাইসেন্স ব্যতীত চলমান সব টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখা এবং ৯. মার্কেট, দোকানে প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখাসহ সেগুলো অপসারণে সিটি করপোরেশনকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাস্তবে উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনা প্রতিপালন করতে পারলে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেকাংশেই কমে আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা, ট্রাফিক জ্যামের সমাধান, উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা, বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো ইত্যাদি বিষয়গুলোর ওপর নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে নির্মল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বাজেটের ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি, সিটি করপোরেশনসহ সেবা সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় নগরজুড়ে ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এসবের সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেসহীন লক্কড়ঝক্কড় পুরোনো গণপরিবহনের কালো ধোঁয়া, ঢাকার আশপাশে নিয়মবহির্ভূতভাবে যত্রতত্র ইটভাটার ধোঁয়া, দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে নির্ণয় করেন পরিবেশবাদীরা। দূষণ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান যেমন পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, রাজউক বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় তাদের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করছে না। বাস্তবে দুই সিটি করপোরেশনসহ অন্য সংস্থাগুলো নিয়োজিত ঠিকাদারদের ধুলা নিয়ন্ত্রণে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে শুধু ওই আইটেমের বিল প্রদান করা বন্ধ রাখলে ধুলা নিয়ন্ত্রণ করা অনেকাংশেই সম্ভব হবে। যদিও দুই সিটি করপোরেশনের তরফে প্রতিদিনই কমবেশি ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো হয়, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। ফলে উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে পানি ছিটানোর পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি করতে হবে, তেমনি উন্নয়নকাজে ব্যবহৃত ইট, সুরকি, বালু, টিন দিয়ে ঘিরেও কাজ করতে হবে।
বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রকোপ রোধে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়তা হবে। বায়ুদূষণ কমানো গেলে নিজেদের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বেড়ে যাবে জিডিপিও। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে হবে এবং সচেতন করে তুলতে হবে। বিশেষ করে বায়ুদূষণের জন্য যেসব উৎস চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো বন্ধের পাশাপাশি নতুন করে যেন কোনো উৎস থেকে বায়ুদূষণ না ঘটে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে নীরব ঘাতককে প্রতিহত করা ছাড়া আর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
বায়ুদূষণের বিপর্যয় থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ গবেষণা, পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের প্রয়োজন। বায়ুদূষণ কমাতে আমাদের প্রত্যেকের সচেতন হতে হবে। করোনা মহামারিতে মাস্ক ব্যবহার বাড়লেও বায়ুদূষণে মাস্ক ব্যবহার করলে দূষণ থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া যাবে। বায়ুদূষণের লাগাম এক্ষুনি টেনে না ধরলে অদূর ভবিষ্যতে গোটা প্রাণিকুলের জন্য ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে।
রফিউল কলিম রিফাত
যন্ত্রকৌশল বিভাগ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা।