বর্তমান সময় অনলাইন জুয়া মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাতে স্মার্টফোন থাকায় তারা সহজে জড়িয়ে পড়ছে এই ভয়ানক ফাঁদে। এক সময় এই খেলা শহরে থাকলেও স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় এটা এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে এ অনলাইন জুয়া।
লোভে পড়ে বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণেরা এই জুয়ায় বেশি আসক্ত হচ্ছেন। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন তাঁদের অনেকে। এ কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষ এই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এই খেলা শুরুর করলেও পরে নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় খোয়াচ্ছেন হাজার হাজার টাকা।
অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্মার্টফোনে নির্ধারিত কয়েকটি অ্যাপস ডাউনলোড করে সেখানে জুয়া খেলা চলে। বিভিন্ন নামের প্রায় ২০ থেকে ২৫টির মতো অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়।
এসব অ্যাপসের বেশির ভাগই পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাংলাদেশে এগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) রয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি বাজারেই রয়েছে এই ধরনের এজেন্ট। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ বা প্রদান করে থাকে। এজেন্টরা বিদেশি অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে হাজারে কমপক্ষে ৪০ টাকা কমিশন পায়। এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে টাকা পাচার হয়। জুয়ায় বিনিয়োগ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মোবাইল ব্যাংকিং খাতে দেশে নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ২১ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩০ জন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিকাশ, নগদ, রকেট, এম ক্যাশসহ মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৯ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করেছে। আর ওই অর্থবছরে জাতীয় বাজেট পেশ করা হয় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, জাতীয় বাজেটের প্রায় দেড় গুণের বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। শুধু গত ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালীন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয়েছে ৯৪ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুধুমাত্র অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি ১১.৭ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে এর ব্যাপ্তি কেমন হবে? যদিও এখন পর্যন্ত এর সঠিক হিসাব জানা যায়নি। তবে অনলাইন জুয়ায় বাজারমূল্যের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, দেশ থেকে বছরে পাচার হচ্ছে দুইশ কোটি টাকার বেশি। এক অনুসন্ধানে জানা যায়, অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের টার্গেট এখন জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটররা।
গ্লোবাল ডেটা ফার্ম স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ৪৭ লাখ। মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। বিশ্বে ইউটিউব ব্যবহারকারী ২০০ কোটি। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বাংলায়।
তথ্যপ্রযুক্তির খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইনে সাইট ব্লক করা সম্ভব হলেও জুয়ার অ্যাপ বন্ধ করা যায় না। গুগল প্লে বা অ্যাপল স্টোর থেকে মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে জুয়া খেলা যায়।
অ্যাপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে অ্যাপ ব্লক বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ফলে এভাবেই জুয়া থেকেই যাচ্ছে অনলাইনে। এ ছাড়া প্রতি দিনই নতুন নতুন নামে জুয়ার সাইট আসছে অনলাইন দুনিয়ায়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই সেগুলো ব্লক করা হচ্ছে। এ জন্য পুরোপুরি অনলাইনকে জুয়ামুক্ত করা যাচ্ছে না।
সামাজিক এই মহামারি বিনাশে শৈথিল্য দেখালে, বিষয়টি জটিল জাতীয় ব্যাধি হিসেবে একসময় আবির্ভূত হতে পারে। দেশে তরুণ জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করতে চাইলে, দ্রুত এর বিহিত জরুরি।
মো. হাসনাইন রিজেন
শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম