ছোট ছোট শৈবাল মিলে যেমন একটি বৃহৎ আকারের প্রবাল সৃষ্টি হয়, তেমনি মানুষের ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণ একটি বড় স্বপ্ন পূরণের আশা জাগায়। এ রকমই একটি আশা আমার মনে জেগেছিল। দিনটি ছিল ২৮ ডিসেম্বর ২০২১। দিনটি ছিল আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। ওই দিন আমি ও আমার বন্ধু অন্বেষা ঘোষ বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি (এসপিএসবি) কর্তৃক আয়োজিত শিশু–কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসের বৈজ্ঞানিক পোস্টারে জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী হয়েছিলাম।
বিজ্ঞান কংগ্রেস হচ্ছে নতুন কোনো বিষয়ে গবেষণা করা। আমাদের গবেষণার বিষয় ছিল ‘গাছের পানি শোষণক্ষমতা পর্যবেক্ষণ’। আর আমরা সেই গবেষণায় সিনিয়র ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হই। দক্ষিণা চরণ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের আল-বিরুনি বিজ্ঞান ক্লাব থেকে আমাদের দুজনের একটি দল ছিল আর আমি ছিলাম দলনেতা।
আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে এ রকম কোনো দিন আমার জীবনে আসবে। এর পেছনে রয়েছে বেসরকারি সংস্থা ‘সেবা’ ও আমার পরিবারের মহৎ অবদান। তারা আমাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে এসেছেন ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন। বিএফএফ ও সেবার যৌথ উদ্যোগে এসপিএসবি থেকে ৩ জন মেন্টর (মুশফিকুর রহমান প্রিয়, সাজিদুর রহমান আকাশ ও রিয়াজুল জান্নাত) আমাদের এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়েছেন। তাই তাঁদের অবদানও অনস্বীকার্য।
আমি এর আগে আরও অনেক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছি। কিন্তু সেগুলো ছিল উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে। তখন আমি বুঝতে পারলাম, ছোট ছোট স্বপ্নগুলো যখন পূর্ণতা পায়, তখন বড় স্বপ্নও ওই স্বপ্নগুলোর কাছে এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেই পূর্ণতা যে এত বড় হবে, সেটা বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর মোড়টা সবার চেয়ে আলাদা।
আমি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী ছিলাম না। আমাকে তখন আমার স্কুলের কোনো শিক্ষক চিনতেন না। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে পড়াশোনা ভালোভাবে শুরু করি। তখন ক্লাসের বিজ্ঞান শিক্ষক রাকিব স্যারের অনুপ্রেরণায় বিজ্ঞান মেলা, কুইজ প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই এগুলোতে বিজয়ী হই। এভাবে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডেও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এখন পর্যন্ত বিজয়ী হচ্ছি। কিছুদিন আগেও ফিজিকস অলিম্পিয়াডে জেলা পর্যায়ে বিজয়ী হয়েছি এবং এখন বিভাগীয় পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এখন আসি আগের প্রসঙ্গে, যখন ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিজ্ঞান কংগ্রেসের জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী হয়েছি, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলের বাইরে ও ভেতরে সবাই আমাকে একনামে চিনত ঝুমি রানী পাল নামে। তার কিছুদিন পর আবার বিজ্ঞানের একটি কুইজে সারা বাংলাদেশে ২০ জনকে বিভাগীয় পর্যায়ে বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত করা হয় এবং চুনারুঘাট উপজেলা থেকে শুধু আমি ছিলাম। সিলেট বিভাগের মধ্যে আমরা তিনজন ছিলাম। বিজ্ঞান কংগ্রেসের বিজয়ীদের এসপিএসবি থেকে সংবর্ধনার তারিখ ঘোষণা করা হয়।
২০২২ সালের ২৭ মার্চ ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের কমপ্লেক্স ভবনে ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সৌমিত্র চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরীসহ অনেক গুণীজন।
আমি সেখানে তাঁদের সামনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাই এবং আমাকেই সবার আগে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়। সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী এবং জাফর ইকবাল স্যারের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করি ও তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাই। আবার সেখানে অতিথিরা যখন বক্তব্য দেন, তখন কয়েকজন তাঁদের বক্তব্যে আমাদের কথা উল্লেখ করেন যে কীভাবে আমরা একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জাতীয় পর্যায়ে এলাম। তাই সাজ্জাদুর রহমান স্যার অতিথিদের সঙ্গে আমাকে ও অন্বেষাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সত্যিকার অর্থে দিনটি আজও আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমার জীবনের একটি স্বপ্ন ছিল জাফর ইকবাল স্যারের সঙ্গে দেখা করা।
‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’—এই সত্য আমার বেলায় প্রমাণিত হলো। ওই দিন আমার মা-বাবা ও পরিবারের সবাই অনেক খুশি হয়েছিল। আমার স্বপ্ন বড় হয়ে একজন চিকিৎসক হব। জানি না, এই ধারাবাহিকতা কত দিন ধরে রাখতে পারব। তবু সব সময় চেষ্টা করব ভালো কিছু করতে। কারণ, জীবন তো একটাই। যাহোক, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ ও ২৭ মার্চ ২০২২ আমার জীবনের এক স্মৃতিময় অধ্যায়; যা আমি কখনো ভুলতে পারব না। এ জন্যই এই সময়টা আমার জীবনের গোল্ডেন পিরিয়ড।
ঝুমি রানী পাল
শ্রেণি: একাদশ (বিজ্ঞান)