মহান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি ছিল তখনকার বিদ্যমান নিম্ন সাক্ষরতার হার। বাংলাদেশের সাক্ষরতার নিম্ন হারের সঙ্গে বিদ্যমান দারিদ্র্যের একটা স্পষ্ট সংযোগ আছে। একাত্তরপরবর্তী বছরগুলোর পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায় দেশের দারিদ্র্যের হার যত কমেছে সাক্ষরতার হার তত বেড়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি আর সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের সেই হার নেমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। আর একই সময়ে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ০৮ শতাংশে।
ইউনেসকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী সাক্ষরতা বলতে পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে এবং লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা, যোগাযোগ স্থাপন এবং গণনা করার দক্ষতাকে বোঝায়। অন্যভাবে বললে, সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝায়। এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের যোগ্যতা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই অর্থে বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাংলাদেশের সরকারের একটা সাংবিধানিক দায় আছে। এখন আগেই যেহেতু বলেছি, নিরক্ষরতা দূরীকরণের সঙ্গে দারিদ্র্যের একটা স্পষ্ট প্রভাব আছে, সেহেতু এই নিরক্ষরতা দূরীকরণের পূর্বে দারিদ্র্যের মূলোৎপাটন আগে ঘটাতে হবে।
কিন্তু, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্য মতে, এখনো বাংলাদেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আর তাদের মধ্যে অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশের সবশেষ জনশুমারি অনুসারে, দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা আছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার। সেই হিসাবে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ দারিদ্র্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী, দৈনিক ১ দশমিক ৯০ ডলারের কম আয় করা মানুষ দরিদ্র বলে গণ্য হবেন। ১৩ জুলাই, ২০২৪ সালের সর্বশেষ তথ্য মতে, বর্তমানে আমেরিকান এক ডলার সমান বাংলাদেশি মুদ্রা ১১৭.৫০ টাকা। অতএব, ১ দশমিক ৯০ ডলার বাংলা টাকায় রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ২২৩.২৫ টাকা।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির যে উল্লম্ফন তাতে ২২৩.২৫ টাকায় চার সদস্যের একটা দরিদ্র পরিবারের দৈনন্দিন বাজার-সদাই করাই সম্ভব নয়, সেখানে কীভাবে ওই পরিবারের একটা শিশু বিদ্যালয়ে যাবে? কীভাবে তার খাতা-কলমের খরচ আসবে? কীভাবে সে তার পোশাকের খরচ মেটাবে? কীভাবে সে দৈনন্দিন পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা পূরণ করবে?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুবই সহজ এবং সরল। ওই দরিদ্র শিশুর পক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কখনোই সাক্ষরতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এ কারণে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে এখনো আমরা লাখ লাখ শিশুশ্রমিক দেখতে পাচ্ছি। অথচ তাদের বই-খাতা নিয়ে আজ বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল! যদিও বাংলাদেশে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, তবুও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে হাজার হাজার শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে।
আমাদের চারপাশে হাজার হাজার শিশু আজও বিদ্যালয়ে না গিয়ে কৃষি শ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক, গণপরিবহনের শ্রমিক, শিল্পকারখানার শ্রমিক, হোটেল-রেস্টুরেন্টের শ্রমিক ইত্যাকার পেশাজীবী হিসেবে কাজ করছে। এমন নির্দয় ভাগ্যবরণ করে এই শিশুরা যেমন তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারছে না, তেমনি করে দেশের টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনেও তারা সেভাবে অবদান রাখতে পারছে না।
সার্বিকভাবে, এই অপ্রত্যাশিত নিরক্ষরতা দেশের জন্য ক্রমাগতভাবে অভিশাপ বয়ে আনছে। আমরা এই উন্নততর বিশ্বে এমন অভিশাপের জীবন আর চাই না। এমন অভিশাপপূর্ণ দেশও আর চাই না। আমরা চাই এই অভিশপ্ত নিরক্ষরতার মূলোৎপাটন।
কিন্তু, অবশিষ্ট এই নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য আমাদের সর্বাগ্রে দারিদ্র্যকে জয় করতে হবে।
দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে। আমি মনে করি দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৩ কোটি ১৭ লাখ দরিদ্র মানুষের এই বিরাট বড় সংখ্যাটি এই শিল্পায়নের যুগে একটা বড় পরিহাসের বিষয়। এই সংখ্যাটা শূন্যের কাছাকাছি আনতে পারলেই কেবল এ দেশের সাক্ষরতা আন্দোলন সফল হবে। অন্যথায়, আমাদের শতভাগ সাক্ষরতার জাতীয় যে স্বপ্ন সেটি স্বপ্নই রয়ে যাবে। আর শতভাগ সাক্ষরতার স্বপ্ন পূরণ হলে বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকা কোথায় যেয়ে ঠেকবে তা তো আমরা ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, জাপান বা জার্মানির মতো শতভাগ বা তার খুব কাছাকাছি সাক্ষরতাসম্পন্ন দেশগুলোর দিকে তাকালেই দেখতে পাই।
তবে দরিদ্র মানুষের এই বড় সংখ্যাটি তো আর কোনো বিশেষ জাদুর বলে রাতারাতি মিইয়ে যাবে না। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দরকার হবে একটি কার্যকরী পরিকল্পনা এবং তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। দারিদ্র্য বিমোচনের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোকে আবার ঢেলে সাজাতে হবে।
দরিদ্র মানুষকে উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত করতে সরকারি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক থেকে দরিদ্র মানুষেরা উৎপাদনমুখী প্রকল্পের জন্য যে ক্ষুদ্র বা মাঝারি ঋণ পায় সেই ঋণের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি, দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের একটি সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।সেই রূপরেখা ধরে দারিদ্র্য দূরীকরণের জাতীয় লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই বাংলাদেশের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত শতভাগ সাক্ষরতার স্বপ্ন পূরণ হবে।
রেজাউল ইসলাম
সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)
পাইকগাছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খুলনা
ইমেইল: [email protected]