একাকী থাকার সময়ে কেউ যদি একাকিত্ব অনুভব করে তবে সেটার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। সঙ্গীর কাছে, পরিবারের সঙ্গে, বন্ধুদের মাঝে গেলেই এই একাকিত্ব নামক বেদনার মেঘ কেটে যাবে। কিন্তু যদি সবার মাঝে থেকেও, সবার সঙ্গে মিশেও হঠাৎ হঠাৎ কাউকে একাকিত্ব গ্রাস করে তবে সেটা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সবার মাঝে থেকেও একাকিত্ব যদি কাউকে ডাকে, মস্তিষ্কের সেলগুলোর ওপরে নিয়ে নেয় কর্তৃত্ব তবে হতাশা-বিষণ্নতা থেকে রক্ষা পাওয়া শুধু কঠিন নয়, কখনো কখনো অসম্ভবও।
কখন এমন ভয়ানক অস্তিত্ব ঘিরে ধরে? যখন জীবনের সবকিছু ভালো লাগে, সবকিছু রঙিন দেখায় তখন এমন একাকিত্বের প্রশ্ন অবান্তর। যদি যখন-তখন খেতে ভালো লাগে, ঘুরতে ভালো লাগে এমনকি দিনভর ঘুমাতে ভালো লাগলেও এই একাকিত্ব ভর করার সুযোগ পায় না। যদি বই পড়তে ভালো লাগে তবেও তারও একাকিত্ব নাই।
তবে সারা দিন যদি মোবাইল নিয়ে কাটাতে ভালো লাগে, অতীতের ছবিগুলো দেখে বর্তমান নিয়ে দুঃখ আসে তবে ধরে নিতে হবে একাকিত্ব আসতে শুরু হয়েছে। যদি আপনজন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়, লুকিয়ে রাখতে হয় হই-চই থেকে তবে সেখানে বিষণ্নতা-হতাশার ঢেউ খেলতে শুরু করেছে। এখন সুনামির অপেক্ষা!
দাম্পত্যের একটা সময়ে ভয়ানক একাকিত্ব আসতে পারে। সেটা দু’জন চার দেয়ালে পাশাপাশি থাকার পরেও, একই ছাদের নিচের পরিবারভর্তি মানুষজন গমগম করার পরেও সেই একাকিত্ব দেখা দিতে পারে। মান-অভিমানের দিনগুলো যদি অবহেলায় ডুবে যায়, যত্নের বদলে যদি সন্দেহ-সংশয় ভরে যায়, পাতা নড়ার শব্দেও যদি বাতিক হয়, অপ্রাপ্তির ছলনা যদি দুঃখের কারণ হয়, মনের মাঝে দমিয়ে রাখা ইচ্ছাগুলো যদি কেউ জানাতে না চায় তবে একেক জনের আলাদা আলাদা পৃথিবীতে জীবনযাপন শুরু হতে পারে।
সাধারণত দাম্পত্যের মধ্য বয়সে একাকিত্বের এই প্রবল ঢেউ আঘাত হানতে পারে। তখন ঘটতে পারে নানান অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। অল্প একটু টনকেই ভেঙে পড়তে পারে আজন্মের লালিত ঢাল।
এই যে একাকিত্ব, এত যে হতাশা তার অধিকাংশ এসে থাকে অতিরিক্ত ভোগবাদী মানসিকতা এবং স্বার্থপরতার পথ গলিয়ে। অধিকার বঞ্চিত হওয়া, বিশ্বাস-ভরসা হারিয়ে যাওয়া, আস্থার নিশ্চয়তা মুছে যাওয়ার কারণে নীরস একাকিত্ব বাড়ছে। বন্ধনের মধ্যে থেকেও মানুষের সন্দেহ সাংঘাতিক পরিসরে বাড়ছে। সংক্রমিত ঢেউ হয়ে একাকিত্ব ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রাণে প্রাণে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের এমনভাবে অসামাজিক বানাচ্ছে যাতে রক্তের বন্ধন কিংবা বন্ধুত্বের বন্ধন বারবার আঘাতে আঘাতে দাহ হচ্ছে। এই যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, পাশাপাশি থেকেও আলাদা আলাদা জগতে বসবাস এসবের ভাবনা মানুষকে একাকিত্বের দরিয়ায় নিক্ষেপ করছে। মনের মধ্যে জ্বালিয়েছে অশান্তির দাবানল।
এখান থেকে উত্তরণের উপায়? আছে। ভালো কাজে ব্যস্ততা বাড়াতে হবে। নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাও এখান থেকে রেহাই পাওয়ার পরিত্রাণ হতে পারে। সঙ্গীর মান-অভিমান এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষা বুঝতে হবে। প্রত্যেক সম্পর্কের অন্তর্নিহিত বার্তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া রাখতে হবে। এই আমি একা নই, অনেক ‘আমি’র মিশ্রণ-এই বোধটুকু না জন্মালে মানুষ বারবার একা হতে হবে।
শারীরিক অনেক বড় বড় অসুখের চেয়েও মানসিকভাবে একাকিত্ব আরও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেখানে ভালোবাসা আছে, যা কিছু পছন্দের সে-সবের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলতে হবে। মনের কথা বলতে হবে, লিখতে হবে, শুনতে হবে এবং পড়তে হবে। একা থাকার কারণে যদি একাকিত্ব বাসা বাঁধে তবে নিয়মিত বিরতিতে পরিবার, বন্ধুমহলের কাছে ফিরতে হবে। ছুটে যেতে হবে ভালোবাসার দ্বারে।
নিজেকে ভালো রাখার জন্য অন্য মানুষের চেয়ে নিজেকে বেশি সময় দিতে হবে। ভালোবাসতে হবে অফুরান। গান শুনতে হবে, কবিতায় নিজেকে হারাতে হবে। পা বাড়াতে হবে পৃথিবীর পথে। যদি সবার মাঝে থেকেও একাকিত্ব অনুভূত হয় তবে সেটা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। এটা যে কাউকে মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে এবং অবস্থান-মর্যাদাগতভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে। ভালোর সঙ্গে থেকে আলো মাখুন, অন্ধকার কাটিয়ে সবার সঙ্গে বাহির দেখুন। সবকিছু সুন্দর-আপনাকে বরণ সরতে সেজে আছে ধরিত্রী। আপনিই কেন্দ্র, এই সুন্দরের সব আয়োজন আপনাকে ঘিরে।
রাজু আহমেদ
প্রভাষক, মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজ, পিরোজপুর
[email protected]