যে কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন

আমরা ছোটবেলায় মাঝেমধ্যে গাছের পাতাকে টাকা বানিয়ে অদৃশ্য কেনাবেচা খেলা খেলতাম। সেই সময় নিয়ম ছিল, যেই গাছের পাতা সংগ্রহ করা যত কঠিন, সেই গাছের পাতার দাম তত বেশি এবং যেই গাছের পাতা যত সহজলভ্য, সেই গাছের পাতার দাম তত কম। আমাদের মধ্যে তখন এক্সচেঞ্জ রেটও চালু ছিল। যেমন তিনটি কাঁঠালপাতার বিনিময়মূল্য ছিল একটি জবাপাতা। সমস্যা বাধত তখন, যখন একটি বাড়িতে জবাগাছ বেশি থাকত বা কাঁঠালগাছ কম থাকত। সেই সময় পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সঙ্গে এক্সচেঞ্জ রেটও পরিবর্তন করতে হতো।

বড় হয়ে বিশ্বের একেকটি দেশের মুদ্রাকে ছোটবেলার ভিন্ন ভিন্ন গাছের পাতার মতোই মনে হলো। যেমন নরওয়েতে ক্রোনা, রাশিয়াতে রুবল, ভারতে রুপি, বাংলাদেশে টাকা। একটি দেশের নাগরিকেরা যখন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বাণিজ্য করেন, সেটি দেশীয় মুদ্রাতে লেনদেন হয়ে থাকে। কারণ, দেশের ভেতরে লেনদেনের সাধারণ মাধ্যমই হচ্ছে দেশীয় মুদ্রা। কিন্তু দুটি ভিন্ন মুদ্রার দেশ পরস্পর লেনদেন করবে কীভাবে?

অভ্যন্তরীণ সাধারণ মুদ্রার মতোই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও লেনদেনের সাধারণ মুদ্রা আছে। অতীতে তা ছিল সোনা আর বর্তমানে তা হচ্ছে ডলার। একটি দেশ, যেমন বাংলাদেশ যখন বিদেশ থেকে পণ্য বা সেবা আমদানি করে কিংবা বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় শ্রমিকেরা ভারতে রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন অথবা বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি বিদেশে বিনিয়োগ করে, তখন তাদের ডলার কিনতে হয়, যা ডলারের চাহিদা সৃষ্টি করে। ঠিক তেমনি করে, যখন বাংলাদেশ পণ্য বা সেবা রপ্তানি করে অথবা বিদেশে কর্মরত শ্রমিকেরা বাংলাদেশে টাকা পাঠান, কিংবা বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশে বিনিয়োগ করে, তখন বাংলাদেশ ডলার অর্জন করে, যা ডলারের সরবরাহের সৃষ্টি করে।

অর্থনীতির একটি চিরন্তন সত্য হচ্ছে, কোনো বস্তুর সরবরাহ কমে গেলে বা চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বস্তুটির দাম বাড়বে। ডলারের বেলায়ও এমনটিই প্রযোজ্য। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ডলার আয় কম করলেই ডলারের দাম বেড়ে যাবে এবং টাকার দাম পড়ে যাবে। সম্প্রতি ঠিক এমনটিই হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে আগস্টে আমদানি গত বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ, অথচ একই সময়ে রপ্তানি ছিল নিম্নমুখী। সব মিলিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪১২ কোটি ডলারে, অথচ একই সময়ে গত বছর বাণিজ্য ঘাটতি ছিল মাত্র ৬৯ দশমিক ৭ কোটি ডলার।

রেমিট্যান্স খাতেও আমরা একই রকম চিত্র দেখতে পাই। চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমেছে ২০ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে দেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রবাহ ছিল দেড় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)।

সম্প্রতি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও ছিল নিম্নমুখী। একটি দেশ থেকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ বিদেশে যায় এবং বিদেশ থেকে যেই পরিমাণ দেশে আসে, তার পার্থক্যই হচ্ছে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন মেয়াদে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৫০ মিলিয়ন ডলার কম। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে আমরা ডলার-সংকটে আছি এবং এই কারণেই টাকার মূল্য কমে গেছে।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রথমত যেই সমস্যা সৃষ্টি হবে তা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্য এবং চিকিৎসাসেবার পণ্যও ডলারে কিনতে হয়। এ কারণে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া মানে জীবনযাপনের খরচও বেড়ে যাওয়া। মাত্র করোনার কঠোর বিধিনিষেধ থেকে উঠে আসা একটি অর্থনীতিতে নতুন করে মূল্যস্ফীতি হওয়াটা সবার জন্যই দুর্ভোগের বিষয়।

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কী, তা এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য দুই রকম কৌশল আছে, সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদি। সাময়িক পদক্ষেপ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করা অথবা বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হচ্ছে, রপ্তানি খাতের উন্নয়ন, বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ। নিশ্চয়ই ঋণ নিয়ে বা সঞ্চয় ভেঙে আমরা বেশি দিন চলতে পারব না। তাই বর্তমান সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট মহলের দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

মোহাইমিন পাটোয়ারী নরওয়ে স্কুল অব ইকোনমিকস ও মানহাইম বিশ্ববিদ্যালয় জার্মানি থেকে স্নাতকোত্তর