প্লাস্টিক দূষণ কী ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তার বড় প্রমাণ, মানুষের রক্তেও এখন প্লাস্টিকের কণা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে এখন আলোচনা চলছে। কিন্তু সমস্যার সমাধানের সঠিক পথ কী? শুধু নীতি প্রণয়ন করলেই হবে না, সেই নিয়মের রশিতে বাঁধতে হবে সবাইকে। ইতিমধ্যে কোনো কোনো দেশে ডিসপোজেবল প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র। আমাদের দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার এতটা বেড়েছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারছে না। না পারছে প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে, না পারছে এর ব্যবহার বন্ধ করতে। জনগণকে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করতে বলা তথা সচেতন করতে চাওয়ার অর্থ অনেকটা বহুছিদ্র পাত্রে পানি ভরার প্রচেষ্টামাত্র। কারণ, প্লাস্টিকের নানাবিধ সুবিধা মানুষের অভ্যাসে ঢুকে গেছে।
যে প্লাস্টিক ছাড়া আজকের পৃথিবী অচল, সেই কৃত্রিম প্লাস্টিকের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। ১৯০৭ সালে সম্পূর্ণ কৃত্রিম উপায়ে প্রথম প্লাস্টিক সংশ্লেষ করেন বেলজিয়ান-আমেরিকান রসায়নবিদ লিও বেকল্যান্ড। গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে কৃত্রিম প্লাস্টিকের উৎপাদন শুরু হলেও চল্লিশের দশক থেকে এর ব্যবহার যথেষ্ট বেড়ে যায়। ষাটের দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন ২০ গুণ বেড়ে বর্তমানে প্রত্যেক মানুষ প্লাস্টিকনির্ভর পৃথিবীর বাসিন্দা। প্রথম ৫০টি প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কোম্পানির সম্মিলিত বিক্রির পরিমাণ এখন বছরে প্রায় ট্রিলিয়ন ডলার। এভাবে চললে ২০৪০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক উৎপাদন আজকের তুলনায় বাড়বে আরও ২০ গুণ। ভোগবাদী দুনিয়ার ‘প্লাস্টিক সভ্যতা’ এক চরম সীমায় নিয়ে যাচ্ছে জীবকুলকে।
উৎপাদনে রাশ না টেনে সমুদ্রতটে প্লাস্টিক কুড়িয়ে দেশে দেশে রাষ্ট্রনেতারা কী বার্তা দিয়েছিলেন জানি না, সামান্য ৫০ মাইক্রেনের নিচে প্লাস্টিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেও আউটপুট যেখানে শূন্য, সে ক্ষেত্রে এটুকুই বলাই যায়, এ ব্যাপারে জনগণকে দিনের পর দিন ‘সচেতন’ হতে বলাটা হাস্যকর পদক্ষেপ। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জনমানবশূন্য ছোট বিন্দুর মতো একরত্তি দ্বীপ হেন্ডারসন আইল্যান্ড। এর তিন হাজার মাইলের মধ্যে কোনো মানববসতি নেই। কিন্তু এর তটরেখাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ১৯ টন বর্জ্য। দ্বীপময় ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ নানা আকারের প্লাস্টিকের টুকরো। সমুদ্রে এসে পৌঁছানো প্লাস্টিকের দুই-তৃতীয়াংশ আসে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত ২০টি নদী বেয়ে। এর মধ্যে ১৫টিই এশিয়ার। এই ক্ষয়হীন দূষণ-পণ্যে শুধু নদী, সমুদ্রের ২ হাজার ২৭০টি প্রজাতির পাশাপাশি মানুষও বিপন্ন হচ্ছে প্রতিদিন।
মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর ৮০০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশে ১৮ কোটি। প্লাস্টিক বর্জন করে কাচের বা টিনের বোতল, পাট ও কাগজের ব্যাগ ফিরিয়ে এনে স্বনির্ভর হয়ে আমাদের পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়াটাও কার্যত অসম্ভব। সুতরাং প্রতিবছর একবার করে দেশে দেশে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালন ব্যাপারটা বিশ্ববাসীর কাছে চরম রসিকতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?
পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ রক্ষার আলোচনা, আয়োজন, পালন, সভা–সমাবেশ চলছে ৫০ বছর ধরে। শুরু ১৯৭১ সালের ৫ জুন সুইডেনের স্টকহোমে। প্রায় সব দেশই পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সিরিয়াস, কাগজে-কলমে। ৫০ বছরে বিশ্বে পরিবেশ আইনের সংখ্যা ৩৮ গুণ বেড়েছে। কিন্তু বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। আইন আছে ভাঙার জন্যই। ল আছে, অর্ডার নেই।
এ তো গেল প্লাস্টিকের কথা। মানবতার পরিবেশ কোথায়? পরিবেশ জনগণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, প্রত্যেক মানুষও পরিবেশের সঙ্গে হৃদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ। পরিবেশের পরিসর অসীম। প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়াও, সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ, আর্থসামাজিক পরিবেশ মানুষের ওপর প্রভূত প্রভাব ফেলে। গাছপালা, নদী–নালা, মানুষের বৌদ্ধিক সংবেদনশীলতা, নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা, কুসংস্কারহীনতা ইত্যাদি বিষয় পরিবেশের অত্যাবশ্যক অঙ্গ। সুপরিবেশ সুনাগরিকের জন্ম দেয়, আবার সুনাগরিক সুস্থ পরিবেশের জন্মদাতা। রাজনৈতিক পরিবেশও দিন দিন দূষিত হয়ে পড়েছে, ফলস্বরূপ জন্ম নিচ্ছে হিংসা, বিভেদ। ধর্মীয় পরিবেশও দূষণের কবল থেকে মুক্ত নয়। জনগণ ভুলেই গেছে, বরফের ধর্ম যেমন শীতলতা, আগুনের ধর্ম যেমন দহনশক্তি, মানুষের ধর্ম তেমনই মানবতা। মানবতার পরিবেশই পারে সভ্যতাকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে দিতে। সুস্থ পরিবেশ ঘোচায় দ্বেষ—এই মন্ত্রেই মানুষের শুরু হবে কবে থেকে পথচলা?
পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ রক্ষার আলোচনা, আয়োজন, পালন, সভা–সমাবেশ চলছে ৫০ বছর ধরে। শুরু ১৯৭১ সালের ৫ জুন সুইডেনের স্টকহোমে। প্রায় সব দেশই পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সিরিয়াস, কাগজে-কলমে। ৫০ বছরে বিশ্বে পরিবেশ আইনের সংখ্যা ৩৮ গুণ বেড়েছে। কিন্তু বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। আইন আছে ভাঙার জন্যই। ল আছে, অর্ডার নেই।
প্রকৃতির পরিবেশে আছে রঙের ছলনা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর গানে বলেছেন, ‘আমি তার ছলনায় ভুলব না’। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ রঙের ছলনায় ভুলে গেছে, হয়েছে নিমজ্জিত। তারা কী খাচ্ছে? পরিবেশ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, শাকসবজি, মিষ্টি, মাছে অননুমোদিত বিষাক্ত রাসায়নিক রঙের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। গরমকালে তরমুজের চাহিদা থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তরমুজের ভেতর নিষিদ্ধ রং এরিথ্রোসিন-বি ইনজেকশন দিয়ে ঢুকিয়ে এর রং আরও লাল করছেন। আলুতে হলুদ এলামাটির সঙ্গে ইটের গুঁড়া মিশ্রণের প্রলেপ দিয়ে নিম্নমানের আলুকে ভালো আলুর সঙ্গে মিশিয়ে চালাকি চলছে। এসব রং মানুষের শরীরে ক্যানসার, হৃদ্রোগ, বৃক্ক ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাসহ বহুবিধ রোগ সৃষ্টি করছে।
কৃত্রিম রং ক্ষতিকারক হওয়া সত্ত্বেও এর ব্যবহার চলছে কেন? কারণ, ব্যবসায়ীদের একাংশের নৈতিক অধঃপতন। প্রশাসনিক শিথিলতা, ভেজালরোধ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। কৃত্রিম রঙের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা গড়ে তুলতে না পারা। রঙিন খাদ্য জনগণের চোখ টানে। সুতরাং খাবারে রঙের কোনো গুরুত্ব নেই, এ কথা বলা যাবে না। বরং কৃত্রিম রং না মিশিয়ে প্রাকৃতিক রঙের কথা ভাবা যেতে পারে। যেমন বিট থেকে লাল রং, মরিচ থেকে লাল রং, কুসুম থেকে লাল ও হলুদ রং ইত্যাদি। লাল অ্যানাট্রো, বেগুনি বিটানিন, কমলা হলুদ ক্যারোটিন, সবুজ ক্লোরোফিল ইত্যাদি প্রাকৃতিক রং খাবারে মেশালেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। এ বিষয়ে সরকার ও প্রগতিশীল ব্যবসায়ীদের উদ্যোগী হতে হবে।
লিয়াকত হোসেন খোকন
রূপনগর, ঢাকা