ইসলামে রাষ্ট্রচিন্তা বা সমাজদর্শন মানবিক। সব মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ইসলাম অন্যায় ও জোরজবরদস্তি এবং জুলুম–নিপীড়ন সমর্থন করে না। ইসলামি রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। প্রত্যেক নাগরিকেরও দায়িত্ব রয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকার। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! ধৈর্য ধারণ করো, প্রতিরোধে দৃঢ়তা প্রদর্শন করো এবং (সীমান্ত) প্রহরায় স্থিত থাকো। আর আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সদ্য স্বাধীন মদিনার সার্বভৌমত্ব রক্ষার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মদিনার ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিককে নিয়ে এর সুরক্ষার জন্য অনেক প্রতিরোধযুদ্ধ করেছেন। ঐতিহাসিক মদিনা সনদের অন্যতম ধারা ছিল, ‘শত্রু কর্তৃক মদিনা আক্রান্ত হলে এখানকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিক ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করবে।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুটি চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না—একটি হলো ওই চোখ, যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে, আরেকটি হলো ওই চোখ, যা সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন সীমান্ত পাহারা দেওয়া দুনিয়া ও এর মধ্যে যা কিছু আছে, সেসবের চেয়েও উত্তম। জান্নাতে তোমাদের কারও চিবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া ও ভূপৃষ্ঠের সমস্ত কিছুর চেয়ে উত্তম। আল্লাহর পথে বান্দার একটি সকাল বা একটি বিকেল ব্যয় করা দুনিয়া এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে সেসব কিছু অপেক্ষা উত্তম।’ (বুখারি: ২৬৯৩, তিরমিজি: ১৬৬৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘আল্লাহর রাহে (মানুষের কল্যাণে দেশ ও রাষ্ট্রের সুরক্ষায়) একটি দিবস ও একটি রাতের সীমান্ত প্রহরা এক মাস রোজা পালন এবং এক মাস রাত জেগে ইবাদত করার চেয়েও শ্রেয়। যদি এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হয়, তাতে তার এ আমলের সওয়াব চলমান থাকবে এবং তার (শহীদসুলভ) রিজিক অব্যাহত রাখা হবে, সে ব্যক্তি ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকবে।’ (মুসলিম: ৪৭৮৫)
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের কদরের রাতের থেকেও শ্রেষ্ঠ রাতের কথা জানাব না? সে ওই পাহারাদারের রাত, যে ভয়সংকুল স্থানে পাহারা দেয়। তার আশঙ্কা হয় যে সে হয়তো তার পরিবারে জীবিত ফিরতে পারবে না।’ (মুসতাদরাক হাকিম: ২৪২৪) তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ; যে ব্যক্তি তার দ্বীন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ; যে ব্যক্তি তার জীবন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ; যে ব্যক্তি তার স্বজন রক্ষার্থে নিহত হয়, সেও শহীদ।’ (তিরমিজি: ১৪২১)
দেশের নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রকে ভালোবাসা এবং এর নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। মাতৃভূমি ও রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ ফরজ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুটি চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না—একটি হলো ওই চোখ, যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে, আরেকটি হলো ওই চোখ, যা সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’ (তিরমিজি: ৪/১৭৫)। ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরীদের জন্য জান্নাত অবধারিত।’ (আবু দাউদ: ৩/৯)
বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে নবীজি (সা.) ঘোষণা করেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রেখো, তোমাদের পরস্পরের জান, মাল ও সম্মানের ওপর হস্তক্ষেপ হারাম করা হলো। আজকের এই পবিত্র দিন (আরাফা), এই পবিত্র মাস (জিলহজ) ও এই পবিত্র শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র ও সম্মানিত; তেমনি এগুলোও (অন্যের জান, মাল ও সম্মান) সম্মানিত ও পবিত্র। এখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে আমার এ বাণী পৌঁছে দেবে।’ (বুখারি: ১/৩৬)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম