খালিস্তানিদের যে কারণে এড়াতে পারেন না ট্রুডো

ভারতের মন্ত্রিসভায় যতজন শিখ আছেন তার চেয়ে বেশি সংখ্যক শিখ আছেন কানাডার মন্ত্রিসভায়। সে কারণে জাস্টিন ট্রুডোর কাছে শিখ সম্প্রদায়ের গুরুত্ব অনেক।
ছবি: সংগৃহীত

কানাডার মাটিতে একজন শিখ নেতার হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে ভারত ও কানাডার মধ্যে পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। শিখ নেতা হরদ্বীপ সিং নিজ্জর খুনের পেছনে নরেন্দ্র মোদির সরকারের হাত থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ পাওয়া গেছে বলে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দাবি করার পরই এই সংকট ঘনীভূত হয়।

ভারতের পাঞ্জাবকে শিখদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিজ্জরকে গত ১৮ জুন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটি সংস্কৃতি কেন্দ্রের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। খালিস্তান আন্দোলনের বিষয়টি দীর্ঘদিন আলোচনার বাইরে থাকলেও নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের জের ধরে এই প্রসঙ্গ পূর্ণমাত্রায় ফিরে এসেছে।

আরও পড়ুন

‘খালিস্তান’ অর্থ ‘পবিত্রভূমি’। শিখ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ‘খালসা’ বলা হয়। এটিও ‘খালিস্তান’ নামকরণের পেছনের একটি কারণ। উত্তর ভারতের এক কোটি ৮০ লাখ শিখের আবাসভূমি পাঞ্জাবকে শিখ সম্প্রদায় স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে দেখতে চায়। ভারতের বাইরে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বাস করা ৮০ লাখ শিখও এই দাবিকে সমর্থন করে যাচ্ছেন।

হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক রাষ্ট্র করার ধারণা নিয়ে দেশ ভাগ করার অনেক আগে থেকেই শিখ সম্প্রদায় নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার আন্দোলন করে আসছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় শিখ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মুসলমানদের জন্য যেভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, সেভাবে তাঁদের জন্যও ‘শিখিস্তান’ কিংবা ‘খালিস্তান’ নামের একটি ভূখণ্ড দেওয়া হোক।

যেহেতু পাঞ্জাবেই তাদের মূল আবাস, সেহেতু সেখানেই তাঁরা তাঁদের সেই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু ভারতের দিক থেকে এই ধারণার বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়ছিল। সে সময় পাঞ্জাবকে এমনভাবে দুই ভাগ করা হয়েছিল যাতে তার এক ভাগ পাকিস্তানে পড়ে আর এক ভাগ ভারতে পড়ে। এর ফলে শিখদের অখণ্ডতাকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

কিন্তু শিখরা তাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও দাবির জায়গা থেকে সরেননি। কারণ তাঁদের কেন্দ্রীয় বিশ্বাসের ভিত্তি হলো, শিখদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ একে অপরের পরিপূরক। তাঁদের বিগত পাঁচ শ বছরের ইতিহাসে তাঁরা মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ঔপনিবেশিক আমলে তাঁরা ইংরেজদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন।

১৯৬০–এর দশকে শিখ আন্দোলনের পুনর্জাগরণ হয় এবং তারা পাঞ্জাব রাজ্যের সীমানা পুনরায় নির্ধারণ করে সেটিকে অখণ্ড পাঞ্জাব হিসেবে গড়ে তুলে সেখানে তাঁদের জন্য আলাদা রাজ্য গঠনের দাবি তোলেন। তাঁদের আন্দোলন আংশিক সফল হয়েছিল এবং তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার পাঞ্জাবি সুবা গঠন করেছিল।

পাঞ্জাবি সুবার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল পাঞ্জাবি ভাষাভাষীদের (যাদের বেশির ভাগই ছিল শিখ সম্প্রদায়ের) বসতি এলাকার ভিত্তিতে। পুনর্গঠিত পাঞ্জাবে এখন যারা বাস করেন তাঁদের ৫৮ শতাংশ শিখ সম্প্রদায়ের।

১৯৮০ এর দশকে ভারত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ‘খালিস্তান’ রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে শিখদের নতুন আন্দোলন শুরু হয়। ওই সময় অনেক শিখ নেতা সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত হন কারণ তাঁরা শিখদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র চাচ্ছিলেন। শিখ সংখ্যাগুরু ভারতীয় রাজ্য তাঁদের চাওয়া ছিল না।

আরও পড়ুন

ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে শিখ মিলিশিয়াদের সংঘাতে কয়েক হাজার প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টার পরিচালনা করা হয়। সেই অভিযানে খালিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতা জারনেইল সিং বিন্দারানওয়ালেসহ বহু শিখ নেতা নিহত হন।

এই ঘটনায় শিখদের ক্ষোভ চূড়ান্ত মাত্রায় রূপ নেয়। এর কিছুদিন পরই ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষী গুলি করে হত্যা করেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে শিখদের আন্দোলন কার্যক্রম আবার ঘনীভূত হচ্ছে এবং ভারত সরকার আবার ১৯৮০ এর দশকের মতো সহিংসতা ফিরে আসার শঙ্কা করছে।

সেই ধরনের সমস্যা যাতে মহিরুহ হওয়ার আগে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়া যায়, সে কারণে নরেন্দ্র মোদি আন্দোলনকে দানা পাকানোর আগেই শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

প্রশ্ন হলো, খালিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে কানাডার সম্পর্ক কী?

এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আবার অতীতে ফিরতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের জের ধরে ১৯৯০ এর দশকে ভারত সরকার শিখ সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক অভিযান চালানোর পর শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা পালিয়ে কানাডায় চলে যান।

সেখানে থাকা প্রবাসী শিখ সম্প্রদায়ের লোকেরা খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে খালিস্তানিদের স্বাগত জানান। আগে থেকেই ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও অন্টারিও এলাকায় শিখদের বাস ছিল। ভারত থেকে নতুন করে পালিয়ে যাওয়া শিখদের উপস্থিতি সেখানে খালিস্তান আন্দোলনকে নতুন করে উজ্জীবিত করে।

শিখরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সুবিধার বিবেচনায় কানাডা এসেছিলেন তা নয়। কানাডায় বাস করে অবাধে রাজনৈতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকায় তাঁরা কানাডাকে নিরাপদ দেশ মনে করেছিল।

ভারতে যেহেতু খালিস্তান আন্দোলন নিষিদ্ধ সেহেতু আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তাঁরা কানাডার মাটিকে অধিকতর নিরাপদ মনে করেছেন। খালিস্তান গঠনের ধারণা নিয়ে বিশ্বের সবখানে ছড়িয়ে থাকা শিখ সম্প্রদায়ের লোক কানাডায় তৎপর আন্দোলনকর্মীদের সমর্থন দিয়ে আসছেন।

এখানে আরও একটি প্রশ্ন জাগে। সেটি হলো, এই খালিস্তিনি আন্দোলনের প্রতি কানাডা সরকারের কোনো সহমর্মিতা আছে কি?

কানাডার মোট জনসংখ্যার ২.১ শতাংশ লোক শিখ সম্প্রদায়ের। শতকরা হিসাবে তাঁরা ভারতে বসবাসরত শিখদের চেয়েও সংখ্যায় বেশি।

কানাডায় বসবাসরত এই শিখরা সে দেশের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ভারতের মন্ত্রিসভায় যতজন শিখ আছেন তার চেয়ে বেশি সংখ্যক শিখ আছেন কানাডার মন্ত্রিসভায়।

জাস্টিন ট্রুডো যদিও ভারতের সরকারকে আশ্বস্ত করেছে, তাঁর সরকার যে কোনো সহিংসতার সাজা নিশ্চিত করবেন; পাশাপাশি তিনি কানাডাবাসীকেও আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁর সরকার যে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শকে সম্মানের চোখে দেখবে এবং শিখদের তাঁদের দাবি দাওয়ার কথা বিনা বাধায় বলতে দেবেন।

তবে আশার কথা হলো, কানাডা ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক আছে। চীন ইস্যুতে এই দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন কৌশলগত নীতি রয়েছে। তাই এই উত্তেজনাকর অবস্থা হয়তো খুব বেশি দিন থাকবে না।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার যেহেতু হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঘোর সমর্থক, সেহেতু তারা শিখদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে মনে করে।
সম্প্রতি ভারত সরকার জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেওয়া অতিথিদের স্বাগতিক দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’ উল্লেখ না করে ‘ভারত’ উল্লেখ করেছে।

এই ‘ভারত’ কথাটি মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। একই সঙ্গে এটি ভারতে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোয় বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করা হয়।

কানাডায় শিখদের জনসংখ্যাধিক্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে জাস্টিন ট্রুডো তাঁর দেশে বসবাসরত শিখদের হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করার অধিকারকে উপেক্ষা করতে পারেননি।

এটিই দুই দেশের সম্পর্ককে অনেকখানি তিক্ত করে তুলেছে। তবে আশার কথা হলো, কানাডা ও ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক আছে। চীন ইস্যুতে এই দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন কৌশলগত নীতি রয়েছে। তাই এই উত্তেজনাকর অবস্থা হয়তো খুব বেশি দিন থাকবে না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
মার্ক জুর্গেনসমেয়ার ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান ও বৈশ্বিক পাঠ–এর একজন অধ্যাপক।