শিক্ষায় অদক্ষতার মহামারি চলছে

ড. মনজুর আহমদ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ইসিডি (প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ) নেটওয়ার্ক, ভাইস চেয়ারম্যান গণসাক্ষরতা অভিযান কাউন্সিল। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন করোনা মহামারির সময়ে দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, শিক্ষার ক্ষতি ও পুনরুদ্ধার নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ইসিডি (প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ) নেটওয়ার্ক, ভাইস চেয়ারম্যান গণসাক্ষরতা অভিযান কাউন্সিল ড. মনজুর আহমদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: করোনার মধ্যে অফিস-আদালত, গণপরিবহন, মেলা, পর্যটন—সবকিছুই খোলা আছে। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক?

মনজুর আহমদ: প্রশ্নটি জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্বের সমতুল্য। সামগ্রিকভাবে সমাজ ও অর্থনীতিতে জীবিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা ও শিক্ষার ক্ষতির মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ। করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে ক্যাম্পে ও এডুকেশন ওয়াচ এক জরিপ করে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিপুল সংখ্যাধিক্যে বিদ্যালয় খোলা রাখার পক্ষে মত দেন। শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারাও স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় জোর দেন কিন্তু তাঁদেরও অধিকাংশ স্কুল খোলা রাখার পক্ষে ছিলেন। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত পর্যালোচনা করে এডুকেশন ওয়াচের পরামর্শ ছিল চার দফা: ১. সারা দেশের জন্য এক ঢালাও সিদ্ধান্ত যুক্তিসংগত নয়। বড় শহর ও অন্যান্য এলাকায় সংক্রমণের হার বিবেচনায় জোন ঠিক করে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী স্কুল যথাসম্ভব খোলা রাখা দরকার। এ জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সমাজ প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট করে স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২. শিক্ষার ক্ষতিপূরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা–এনজিওদের সঙ্গে নিয়ে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষা ক্ষতিপূরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। ৩. এমপিওপ্রাপ্ত ও অন্যান্য বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সহায়তা ও নির্দেশনা দিতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষা ক্ষতিপূরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাঁদের করণীয় সম্পর্কে। ৪. স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষা ক্ষতিপূরণে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যালয়কে ও শিক্ষকদের অতিরিক্ত সময় ও শ্রমের জন্য আর্থিক সহায়তা ও প্রণোদনা দিতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে মান বৃদ্ধি ও প্রয়োজন অনুসারে অতিরিক্ত স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষা সহায়ক নিযুক্ত করতে হবে। এসব পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।

দেশের শিক্ষাবিদ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশ এবং জাতিসংঘের শিশুকল্যাণ সংস্থা ইউনিসেফের মতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢালাওভাবে সারা দেশে এত দীর্ঘ সময় বন্ধ রাখা যুক্তিসংগত ছিল না এবং এখনো বন্ধ রাখা সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু শুধু খোলা রাখলেই চলবে না। একই সঙ্গে স্থির করতে হবে স্কুলে শিক্ষার ক্ষতিপূরণের জন্য কী করতে হবে। স্কুল খুলে সবাই আবার আগের গতানুগতিক কার্যক্রমে চলে যাবেন মনে করা বাস্তবসম্মত নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো এমন এক প্রেক্ষাপটে, যেখানে গত সেপ্টেম্বরের আগে প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল। আবার বন্ধের চক্রেই পড়ে গেল। এর কোনো বিকল্প ছিল কি না।

মনজুর আহমদ: বিকল্পের ইঙ্গিত ওপরে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা সে পথে এগোইনি। দীর্ঘকাল স্কুল বন্ধ থাকা এবং পড়াশোনা ছাড়া গতানুগতিক প্রথায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টায় অটো পাস ও প্রমোশন দিয়ে শিক্ষার্থীদের এক বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অতিমারির আবির্ভাবের পর তৃতীয় শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীরা ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন না করে দুই শ্রেণি পার হয়ে তৃতীয় উচ্চতর শ্রেণিতে চলে গেছে। অথচ নিঃসন্দেহে বলা যায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী মৌলিক প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেনি। দূরশিক্ষণ, অ্যাসাইনমেন্ট বা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি বলে প্রাপ্ত তথ্যে ও বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে। সুতরাং গতানুগতিক ধারায়, নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠের জন্য শিক্ষার্থীরা মোটেই প্রস্তুত নয়। শিক্ষক পাঠ দিয়ে যাবেন, পরীক্ষা হবে এবং মুখস্থবিদ্যার কল্যাণে হয়তো অনেকে পাসও করবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত ন্যূনতম দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করবে না। ইউনেসকো বলছে, এ পরিস্থিতি এক প্রজন্মের বিপর্যয়; যদি দ্রুত ও সঠিক শিক্ষা উদ্ধারের ও ক্ষতিপূরণের পদক্ষেপ নেওয়া না হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার যে ক্ষতি হলো তা পূরণ করার কার্যকর কোনো পরিকল্পনা কি সরকারের আছে বলে মনে করেন? ইতিমধ্যে সরকার এক বছর অটো পাস দিয়েছে এইচএসসিতে, পরবর্তী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও হয়েছে সংক্ষিপ্ত পাঠক্রমে। ভবিষ্যতে শিক্ষার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই পড়বে?

মনজুর আহমদ: শিক্ষার ক্ষতির গভীরতা, ব্যাপকতা এবং এর প্রাজন্মিক অভিঘাতের স্বীকৃতি দেখা যাচ্ছে না। প্রথম ঢেউয়ের পর গত এক বছরের বেশি সময়ে প্রস্তুতি ও বিপদের মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরিতে অনেক এগিয়ে থাকা যেত যদি ওপরে বর্ণিত পরামর্শ আমলে নেওয়া হতো। এখনো অধিকাংশ বিদ্যালয়শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা যায়নি কেন, তা বোধগম্য নয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার নিজের বিদ্যালয়ে টিকা দেওয়া কেন এত কঠিন কাজ? অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতার আরেক মহামারি চলছে দেশে। গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর শিক্ষার ক্ষতিপূরণের জন্য শিক্ষাবিদেরা আবার পরামর্শ দিয়েছিলেন (প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১)। অভিজ্ঞতা ও পর্যালোচনার আলোকে ২০২০ সালের পরামর্শের ধারাবাহিকতায় শিক্ষার ক্ষতিপূরণ ও শিক্ষা পুনরুদ্ধারে জোর দেওয়া হয়েছে এ চার দফা পরামর্শে। এগুলো হচ্ছে: ক. প্রাথমিকের জন্য ভাষা ও গণিত এবং মাধ্যমিকের জন্য বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের শ্রেণিভিত্তিক দক্ষতা যাচাই করা—প্রতিটি বিদ্যালয়ে সহজ ও দ্রুত পদ্ধতিতে; খ. যাচাইয়ের ভিত্তিতে এসব দক্ষতায় পিছিয়ে থাকাদের জন্য নিরাময়মূলক নিবিড় কার্যসূচি বাস্তবায়ন; গ. প্রাথমিক সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা পরিহার; ঘ. শিক্ষকদের এ নিবিড় কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ও মুখোমুখি সহায়তা প্রদান; ঙ. ২০২১ শিক্ষাবর্ষকে ২০২২-এর জুন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা ও তিন সালা শিক্ষা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থায়ীভাবে সেপ্টেম্বর–জুন শিক্ষাবর্ষের প্রবর্তন।

শিক্ষা পুনরুদ্ধারের জরুরি কালীন কার্যক্রমের সময় গতানুগতিক সব কাজে মনোনিবেশ সম্ভব নয়। নতুন শিক্ষাক্রম সংস্কারের কাজ আপাতত স্থগিত রাখতে হবে। কারণ, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রধান কাজ হওয়া উচিত ক্ষতিপূরণ ও পুনরুদ্ধারে পূর্ণ মনোযোগ। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা স্থায়ীভাবে বাদ দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়ের কৃতী মূল্যায়নের জন্য অন্তত এ পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষা যথার্থ পদ্ধতি নয়। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা চালু রাখতে হবে সমাপ্তি সনদ ও উচ্চতর শিক্ষার জন্য যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য। জরুরি কালীন সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য কিন্তু মূল দক্ষতার বিষয় (ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান) বাদ দিয়ে শুধু ঐচ্ছিক বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়। এ সিদ্ধান্ত বদলাবে বলে জানানো হয়েছে। শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে যেকোনোভাবে পুরোনো গতানুগতিক রুটিনে ফিরে যাওয়ার দুর্বার লক্ষ্য ত্যাগ করে জরুরি কালীন ব্যতিক্রমী শিক্ষা পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে নিবিষ্ট হতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে গুচ্ছ পরীক্ষার দাবি ছিল অনেক দিনের। কিন্তু এবার গুচ্ছ পরীক্ষা নিতে গিয়ে হযবরল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এর প্রতিকার কী?

মনজুর আহমদ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, লক্ষ্য, ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। অপরাজনীতির সব উদাহরণ এখানে বিদ্যমান। অপরাজনীতির প্রকোপ দেখা যায় উচ্চতম কর্মকর্তা নিয়োগে। শিক্ষক নির্বাচনে, একাডেমিক কার্যক্রমে, শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনায়, ক্রয় ও নির্মাণ সিদ্ধান্তে। অপরাজনীতি দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে লালন করে এবং প্রশ্রয় দেয়। তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তার কর্তব্য পালন করতে পারে না। এখানে দক্ষতা ও সক্ষমতা দুটোরই ঘাটতি আছে। এখানেও অপরাজনীতি কার্যকর। সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মঞ্জুরি কমিশনের দ্বৈত শাসনের কারণে। কার্যত স্বায়ত্তশাসিত মঞ্জুরি কমিশন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বা আগ্রহী নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: করোনাকালে অনলাইন পাঠক্রম চালু ছিল। কিন্তু অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাহলে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কতটা এগোলাম? ডিজিটাল কি কেবল স্লোগানে, না বাস্তবেও এর প্রতিফলন আছে?

মনজুর আহমদ: দূরশিক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে—টিভির মাধ্যমে পাঠদান, ইন্টারনেট, মুঠোফোন, রেকর্ড করা অফলাইন উপকরণ ইত্যাদি। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে নিয়মিত পাঠের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পাঠগুলো পৌঁছায়নি। পৌঁছালেও যে শিক্ষার্থী শিখবে, তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা জানি যে শ্রেণিকক্ষে মুখোমুখি পাঠে অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠের মর্ম আহরণ করতে পারে না। অন্য কোনো কার্যকর উপায়ের অভাবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু এটাকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্য কার্যকর শিখনপদ্ধতি বলা যায় না। তাই এখন বলা হচ্ছে মিশ্র পদ্ধতি বা ব্লেন্ডেড অ্যাপ্রোচ, অর্থাৎ অনলাইন ও মুখোমুখি পরস্পর পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা দরকার। এ জন্য প্রস্তুতি, দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। ডিজিটাল বাংলাদেশের এক অনুষঙ্গ হিসেবে শিক্ষাব্যবস্থার মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। ডিজিটাল বাংলার প্রসারে নিঃসন্দেহে অগ্রগতি হয়েছে, যা দেখা যায় মুঠোফোনের ব্যাপক ব্যবহারে, ইন্টারনেটের প্রসারে। তবে এ ক্ষেত্রে সেবার বিস্তার ও মানে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আমরা প্রথম সারিতে আছি, বলা যায় না। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে আরও সুপরিকল্পিত, সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন পাঠক্রম মোটামুটি সচল ছিল। নিয়মিত পরীক্ষা, ক্লাস ও ভর্তি হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পারল না কেন?

মনজুর আহমদ: সামগ্রিকভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, দায়বদ্ধতার অভাব এবং মান উন্নয়নে ও সেবাদানে অঙ্গীকারে অবহেলার এক নিদর্শন প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতায় শ্লথ অগ্রগতি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। আবার কারও কারও বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে। যে প্রক্রিয়ায় উপাচার্য নিয়োগ হচ্ছেন, তা কতটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন?

মনজুর আহমদ: আগেই বলেছি, সামগ্রিক অপরাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়কে কলুষিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক উপাচার্যের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, বিবেচনাহীনতা ও আত্মসম্মানবোধের অভাব কোনো দুর্লভ ব্যতিক্রম নয়। এটাই যেন প্রত্যাশিত। শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের পরও সাম্প্রতিক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সুরাহাই হলো না এবং উপাচার্য, সসম্মান নিজে থেকে সরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। উচ্চতম রাজনৈতিক মহলে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য নতুন চিন্তাভাবনার উন্মেষ না ঘটলে আশার আলো দেখা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একদিকে আমাদের দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেরোচ্ছে। তাঁদের বেশির ভাগ চাকরি পাচ্ছেন না। বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার। আবার উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছেন না। মূল সমস্যাটি কোথায়?

মনজুর আহমদ: শিক্ষিত বেকারের সমস্যার কোনো সহজ সদুত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এটা বিশ্বজনীন সমস্যা। বাজারের দক্ষতার চাহিদা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরবরাহের অমিল প্রধান সমস্যা বলে অনেক সময় উল্লেখ করা হয়। এ বিবরণে সমস্যাটিকে অতি সরল করে দেখা হয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি, অর্থনীতি, দক্ষতা ও শ্রমবাজারের জন্য উপযুক্ত জনশক্তি সরবরাহের দায় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নয়। এখানে শিল্প-বাণিজ্য খাত ও নিয়োগদাতা ও অর্থনীতির নিয়ামকদেরও অনেক কিছু করণীয় আছে। তবে সর্বস্তরে শিক্ষার মান উন্নয়ন ও পরিবর্তনশীল বিশ্বের গতি–প্রকৃতি শিক্ষার কার্যকলাপকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তার বিবেচনা অপরিহার্য। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উচ্চ হারে বেকারত্বের কারণ নিঃসন্দেহে অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক নিম্নমান ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আমাদের দেশে সব সরকারই একটি করে শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে। তারপরও শিক্ষার অধোগতি ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?

মনজুর আহমদ: ২০১০ সালের শিক্ষানীতি, যা এখনো বলবৎ, তা বাস্তবায়নের জন্য কোনো সমন্বিত, সুবিন্যস্ত কর্মপরিকল্পনা বা সাংগঠনিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত এক দশকে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে কিন্তু শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ও কৌশলের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষার সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ দেখা যায়নি। তাই শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্য যথা মানসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাভিত্তিক, একীভূত শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি। শিক্ষা খাত মান রক্ষা ও বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে ত্রুটিমাফিক, তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘ মেয়াদি অভিঘাত নতুন সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছে। উচ্চমধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশের অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশের সামগ্রিক পর্যালোচনা করে এক পূর্ণ শিক্ষা খাত পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন বলে শিক্ষাবিদেরা মনে করেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মনজুর আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।