রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের বড় সহায়তা দরকার

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবে একসময় ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পড়ে আসা এই কূটনীতিক অর্থনীতি ছাড়াও আর্থসামাজিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ নানা বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখতেন। প্রথম আলো পত্রিকায় তাঁর অনেক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে তাঁর এ সাক্ষাৎকার প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। আজ বুধবার নয়াদিল্লির একটি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন মুচকুন্দ দুবে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাক্ষাৎকারটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।

মুচকুন্দ দুবে। ছবি: প্রথম আলো
মুচকুন্দ দুবে। ছবি: প্রথম আলো

>

মুচকুন্দ দুবের জন্ম ভারতের ঝাড়খন্ডে, ১৯৩৩ সালে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর এক বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৭ সালে যোগ দেন ভারতীয় পররাষ্ট্র বিভাগে। কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তেহরান, জেনেভা, বার্ন, নিউইয়র্ক ও ঢাকায়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি। ১৯৯১ সালে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে অবসর গ্রহণের পর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। এখন তিনি দিল্লির কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের সভাপতি। সম্প্রতি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন লালন বিষয়ে একটি বক্তৃতা দিতে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভারতের নাগরিক আইন সংশোধন ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মিজানুর রহমান খান।  

প্রথম আলো: ভারতের বাংলাদেশ কূটনীতিতে কবে জড়ালেন?

মুচকুন্দ দুবে: বাহাত্তরের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের তরফে প্রথম এসেছিলাম। এরপরে দেশে ফিরে যাই একজন আন্তর্জাতিক সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে। আর তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমাকে বাংলাদেশ ডেস্কের দায়িত্ব দেওয়া হলো। তবে সেটা ঠিক বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ বিবেচনায় নয়। আমার চাকরি দরকার ছিল, পদ একটা খালি হলে আমি তা পূরণ করলাম, এভাবে। এটা ১৯৭৬ সাল। দুই মাসের মধ্যে আমি যুগ্ম সচিব পদে উন্নীত হলাম।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের সংগীত–সাহিত্য সম্পর্কে আপনার আগ্রহ তৈরি হয়েছে কি এখানে এসে?

মুচকুন্দ দুবে: আসার পরে। লালনের দু–তিনটি রেকর্ড আমার কাছে ছিল। বিখ্যাত ভারতীয় লোকসংগীতশিল্পী নির্মলেন্দু দে গেয়েছিলেন। পরে এখানে এসে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে শুনলাম।

প্রথম আলো: আপনার স্ত্রী কি এখনো নজরুলগীতি চর্চা করেন?

মুচকুন্দ দুবে: খুব ভালো গাইছেন তিনি। এখন সেটা ইউটিউবে দেওয়ার কথা চলছে।

প্রথম আলো: আপনার কি মনে পড়ে যে বঙ্গবন্ধুর সময়ই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন ঘটেছিল।

মুচকুন্দ দুবে: তাঁর সময় দুই দেশের মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল, সেটা খুব ভালো ছিল। যেসব প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা–ও খুব ভালো ছিল। দুই দেশের পরিকল্পনা কমিশন কাজ করেছিল কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, কোন কোন প্রকল্প নেওয়া যায়, সেসব চিহ্নিত করা হয়েছিল। অনেক বড় মানুষ ও বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন এসবের দায়িত্বে। ভারত থেকে সুখময় চক্রবর্তী এবং আপনাদের দেশ থেকে নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখ। তাঁরা প্রথম শ্রেণির অর্থনীতিবিদ। তাঁরা অনেক কাজ করেছিলেন। কিন্তু পরে কিছুটা ভুল–বোঝাবুঝির সূচনা ঘটেছিল দুদেশের সম্পর্কে। যখন আমি যুগ্ম সচিব হলাম, তখনো এ ধরনের ভুল-বোঝাবুঝির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি।

প্রথম আলো: ভারতের দিক থেকে কোনো ঘাটতি ছিল কি?

মুচকুন্দ দুবে: আমি যখন এলাম, তখন সব দিক থেকে বড় বাধা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যখন আমি যুগ্ম সচিব হই, তখন ফারাক্কা চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।

প্রথম আলো: জিয়াউর রহমানের আমলে কী করে ফারাক্কা চুক্তি হয়েছিল?

ুচকুন্দ দুবে: এটার সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। আমি নিজের প্রশংসা করতে চাই না। মূলত আমি কাজটা করেছিলাম।

প্রথম আলো: আমাদের একটা কৌতূহল যে ফারাক্কা চুক্তি জিয়া কীভাবে করেছিলেন? এটা কি মোরারজি দেশাইয়ের কোনো দূরদর্শিতা ছিল?

মুচকুন্দ দুবে: এটা হয়েছিল স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যে বার্তা বিনিময় হয়েছিল, তার সূত্রে। সেই বোঝাপড়ার দুটো অংশ ছিল। প্রথমত যাতে আমরা ফারাক্কা বাঁধ চালু করতে পারি। আর দ্বিতীয়ত, ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হতে পারে। এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল মুজিবের আমলেই। তবে জিয়াউর রহমানের সময় যেটা হলো, বাংলাদেশ জাতিসংঘে বিষয়টা নিয়ে গেল। জাতিসংঘের প্রথম কমিটিতে নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল, ওখানে আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম।

প্রথম আলো: তার মানে বাংলাদেশ কি ওই সময় একটা বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি করেছিল?

মুচকুন্দ দুবে: একভাবে করেছিল, নিশ্চয়ই। জিয়াউর রহমানের সময় পাঁচ বছরের একটা চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়ায় যত বাধা এসেছিল, আমি সেটা সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম।

প্রথম আলো: আমাদের একটা কৌতূহল যে বাংলাদেশ ওই সময়ে কী করে ফারাক্কা পয়েন্টে ন্যূনতম পানিপ্রবাহের গ্যারান্টি ক্লজ যুক্ত করাতে পেরেছিল?

মুচকুন্দ দুবে: চুক্তির যখন মেয়াদ শেষ হয়ে গেল, তখন আমি এখানে ছিলাম। তখন ভারত প্রস্তাব দিল, আমরা আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যাব না। প্রত্যেক বছর এটা নবায়ন করব। আমি আমার বাংলাদেশি প্রতিপক্ষ রেজাউল করিমকে বললাম, আপনি এটা গ্রহণ করবেন না। ইউ ডু নট অ্যাকসেপ্ট, বিকজ মিনিমাম গ্যারান্টি ক্লজ উইল নট বি দেয়ার।

প্রথম আলো: আপনি ঢাকায় হাইকমিশনার থাকতে একটি দৈনিকে খবর বেরিয়েছিল যে আপনি একজন বাংলাদেশি নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে চড় মেরেছিলেন।
কী ঘটেছিল?

মুচকুন্দ দুবে: সেদিন কুয়েতের মিশনের একটা রিসেপশন ছিল। আমি তাতে যোগ দিতে রওনা হলাম। আমি লক্ষ করলাম, একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি আমাকে ফলো করছে। সেটা সেদিন আমার গাড়ির কাছে এসে ধাক্কা লাগাল। আমার নিরাপত্তা প্রহরী বেরিয়ে এলেন। ভক্সওয়াগন গাড়ির চালককে ধরে ফেললেন। আমি আইজিকে ফোন দিলাম। কিন্তু তঁাকে পেলাম না। ১০-১৫ দিন পরে পত্রিকায় একটা শিরোনাম হলো: ভারতের হাইকমিশনার বাংলাদেশের নিরাপত্তাকর্মীকে মারধর করেছেন। এই খবর প্রকাশের পর ভারতে বিরাট হইচই হলো। আমি তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামস উল হক সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তাঁকে বললাম আপনি যদি মনে করে থাকেন যে আমি দুই দেশের হিতের জন্য কাজ করছি এবং বাংলাদেশে আমার মেয়াদের বাকি সময়গুলো থাকা উচিত, তাহলে আপনাকে অবিলম্বে এ ঘটনা তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করি। কারণ, বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাৎক্ষণিক কথা বলে ব্যবস্থা নেন। আইজিপিকেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে বললেন। চার দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেল। সেই প্রতিবেদনে তথ্য বেরোল যে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ভারতের হাইকমিশনার তাতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাঁর নিরাপত্তাকর্মী এর সঙ্গে জড়িত। রিপোর্টে গাড়িচালক ও নিরাপত্তাকর্মীকে তুলে নেওয়ার সুপারিশ করা হলো। কিন্তু আমি দ্বিমত করলাম। আমার কথা তাঁরা মানলেন না। দুজনকেই প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো ভারতে। আর আমি থেকে গেলাম। এরপর আমাদের সংসদে এটা নিয়ে বিতর্ক হলো। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নরসীমা রাও আমাকে জোরালোভাবে সমর্থন করলেন। তিনি বললেন, দুবে বাংলাদেশে আমাদের হাইকমিশনার, কিন্তু উভয়ের স্বার্থ সুরক্ষামূলক কাজ করেন।

প্রথম আলো: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উচ্চতার মধ্যে সম্প্রতি পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বাতিল হলো। এর রেশ কীভাবে মিলিয়ে যাবে? বর্তমান অবস্থা থেকে কীভাবে দুদেশের সম্পর্কের উত্তরণ ঘটবে? হিন্দুস্তান টাইমস বলেছে, দুদেশের উচ্চ সম্পর্কের উপাখ্যানের অবসান হলো।

মুচকুন্দ দুবে: এ বিষয়ে আমি স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারব না। এটা অনেক স্পর্শকাতর।

প্রথম আলো: নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে আপনি কি প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য বা নিবন্ধ লিখেছেন?

মুচকুন্দ দুবে: না। কিন্তু আমার বিচার করে দেখার বিষয় আছে আইন নিয়ে। সেটা আমি বলতে পারি। আমি ভাবি, এটা অনেক দুর্ভাগ্যপূর্ণ জিনিস হয়েছে। এর ফলে ভারতে যেসব মুসলমান নাগরিক আছেন, তাঁদের সমস্যা হবে না। কিন্তু ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাইরে থেকে যারা এসেছে, তাদের মধ্যে অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেবে, মুসলিমদের দেবে না। এটা আমি মানি না। কারণ, এটা নীতির খেলাপ। কী করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলতে পারে যে আমরা ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেব।

প্রথম আলো: বিষয়টির বৈধতার প্রশ্ন নিয়ে অনেকে সুপ্রিম কোর্টে গেছেন, আপনি কি আশা করেন যে সেখানে একটা প্রতিকার মিলবে?

মুচকুন্দ দুবে: আমি আশা করি, সুপ্রিম কোর্টের রায় এর প্রতিকার দেবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে আপনার উত্তরসূরি বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি এ মামলায় অন্যতম আবেদনকারী হয়েছেন।

মুচকুন্দ দুবে: সঠিক। আমি তঁার জন্য গর্বিত।

প্রথম আলো: এই আইন কি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পরিপন্থী বলে মনে করেন?

মুচকুন্দ দুবে: অবশ্যই, এটা নিরঙ্কুশভাবে মনে করি। ধর্মের ভিত্তিতে যদি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তাহলে দেশ ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে কি? এটা একটা সাধারণ ধারণার বিষয়।

প্রথম আলো: কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের একজন অধ্যাপক হিসেবে আপনার কি মনে হয় যে ভারতের নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যম থেকে এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রতিবাদ এসেছে?

মুচকুন্দ দুবে: এটা সংবাদমাধ্যমে ঘটেনি। সংবাদমাধ্যমের পরিস্থিতি অনেকভাবে বদলে গেছে গত কয়েক বছরে। তবে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না। বলব আমাদের সংবাদমাধ্যম ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। একটা গুণগত পরিবর্তন এসেছে।

প্রথম আলো: আর সেই পরিবর্তনটা নিশ্চয়ই বাক্‌স্বাধীনতার অনুকূলে নয়?

মুচকুন্দ দুবে: একদম অনুকূলে নয়। ফেক নিউজ এসে গেছে। ভাড়াটে খবর এসে গেছে।

প্রথম আলো: ভয় কতটা কাজ করছে? কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি আমরা দেখতে পাচ্ছি। ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টিভঙ্গি কি এখানে কোনো প্রভাব ফেলছে?

মুচকুন্দ দুবে: ভয় তো আছে। ভয়ে আছে খবরের কাগজ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ভয় আছে। ভয় সিভিল সোসাইটির মধ্যে। তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জনসমর্থন নিয়ে তারা সরকার করেছে। ওরা তো ভয় পায় না।

প্রথম আলো: এনআরসি, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, অযোধ্যার রায় এবং নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মধ্যে আপনি কি কোনো পরম্পরা
দেখতে পান?

মুচকুন্দ দুবে: আমি বলব একটা কমন ফিচার। এটা একটা প্যাটার্ন। পরম্পরাকে আমরা বলি ট্র্যাডিশন।

প্রথম আলো: এ ঘটনাগুলোর মধ্যে আপনি বিপজ্জনক কিছু দেখেন কি না? ভারতবর্ষ তো একটা সম্প্রীতির মধ্যে ছিল।

মুচকুন্দ দুবে: বিপদ আছে, নিশ্চয়ই আছে।

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল নিয়ে আপনি ইতিমধ্যেই কোনো অভিমত রেখেছেন বা কিছু লিখেছেন কি না?

মুচকুন্দ দুবে: আমি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করি। আমি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কাজ করি না। কখনো করতাম না, এখনো করি না। আমি ফরেন পলিসি অথবা ইকোনমিক পলিসি নিয়ে লিখি।

প্রথম আলো: সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যার রায় সম্পর্কে আপনি কি কিছু বলেছেন বা লিখেছেন?

মুচকুন্দ দুবে: আমি লিখিনি। তবে আমি প্রসন্ন নই। আই অ্যাম নট হ্যাপি।

প্রথম আলো: ভারত কি বাংলাদেশ ছাড়া প্রতিবেশীদের কাছে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে?

মুচকুন্দ দুবে: বন্ধুহীন হয়ে গেছে, তার অনেক কারণ আছে। পাকিস্তান একটি মেজর ফ্যাক্টর। পাকিস্তান যেখানে যাবে, সেখানে আমরা যাব না।

প্রথম আলো: এই কিছুদিন আগেও বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র ছিল নেপাল, সেই নেপালের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি ঘটল কেন?

মুচকুন্দ দুবে: এর কারণ আছে। চায়না ফ্যাক্টর অন্যতম। প্রতিবেশীর প্রত্যেকেই তার মতো করে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়।

প্রথম আলো: আপনি এর আগে সাক্ষাৎকারে বলেছেন সার্কের লাশ পড়ে থাক, দাফনের দরকার নেই। এখনো কি আপনি সার্কের ভবিষ্যৎ দেখেন না?

মুচকুন্দ দুবে: আমার ভাবনা এখনো তেমনি। দাফন করার দরকার নেই। সার্কের যে দশা হয়েছে, সেটা অস্বাভাবিক। ওর প্রতিস্থাপনের জন্য আমরা যে কাজ করেছি ওটা অবাস্তব। আমি শুধু এ বিষয়ে এটুকুই বলতে চাই।

প্রথম আলো: দুই দেশের সম্পর্কের যদি একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন, আপনার সময় ও বর্তমান সময়।

মুচকুন্দ দুবে: আমি দুই দেশের সম্পর্ক ভালো দেখতে চাই। এই সরকারের সময়ে অনেকভাবে ভালো সম্পর্ক হয়েছে। তার কারণ শুধু ভারত সরকার নয়। তার বেশি কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, কাজ করেছেন, সেটা অনেক বড় বিষয়। কিন্তু আমার বিচারে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সংহত না হলে এই সম্পর্কও টেকসই হতে পারে না। এই সম্পর্কের আরও জোরদার হতে পারে, যদি দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়।

প্রথম আলো: এশিয়ায়, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিযোগিতা, সেখানে বাংলাদেশ কি চিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছে, না সুবিধা পাচ্ছে?

মুচকুন্দ দুবে: এই পরিস্থিতি থেকে ভালো কিছু হোক বাংলাদেশের, সেটা প্রত্যাশা করি। কিন্তু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে লাভ ওঠানোর খুব বেশি ক্ষমতা তো বাংলাদেশের নেই। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে কীভাবে ভারত লাভ তুলতে পারে, সেটা জটিল বিষয়।

প্রথম আলো: স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে ভারত কেন একজন চিফ অব ডিফেন্স বেছে নিল?

মুচকুন্দ দুবে: আমি মনে করি, এটা একটা নন–ইস্যু। আমার হিসাবে এ রকম এমন সুপারিশ আগেও ৫-৬ বার হয়েছে। সুব্রামনিয়াম কমিটি দেখেছিল, কারগিল কী করে হলো? এ রকম একটি সুপারিশ দিল। কিন্তু তা বাস্তবে হলো না।

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন রোহিঙ্গারা র‌্যাডিকালাইজ হলে তা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে?

মুচকুন্দ দুবে: ভারতের জন্য এটা অনেক বিপজ্জনক হতে পারে। যদি এখানে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, এটা ভারতের জন্য কখনো ভালো হবে না।

প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয়, এই সমস্যার সমাধানে ভারতের উচিত আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা?

মুচকুন্দ দুবে: ভারতের উচিত আরও বড় পরিসরে সহায়তা করা।

প্রথম আলো: আপনি ১৯৭৯ সালে জিয়ার কাছে পরিচয়পত্র পেশের সময় সুফিয়া কামালের কবিতার লাইন আবৃত্তি করেছিলেন। সূক্ষ্মভাবে কী বার্তা দিয়েছিলেন?

মুচকুন্দ দুবে: ওই পরিচয় প্রদান অনুষ্ঠানে নজরুলের কবিতা থেকেও উদ্ধৃতি ছিল। আমার বার্তা ছিল, সবাইকে নিয়ে চলতে হবে।

প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয় না যে ২০২০ সালে এসেও আপনার সেই অনুভূতি প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে?

মুচকুন্দ দুবে: (হাসি) হতে পারে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুচকুন্দ দুবে: ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন