বুয়েট বিক্রিরও ক্ষমতা রাখেন ভিসি

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত।
>

ড. আইনুন নিশাত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। বুয়েট পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান। 

প্রথম আলো: সবাই বুয়েট সংকটকে একটা সাধারণ বোধগম্যের জায়গা থেকে দেখছেন। আপনি সংকটের গভীরে গেলে কীভাবে দেখবেন?

আইনুন নিশাত: বুয়েটেই আমার সারা জীবন কেটেছে। ১৯৬৫ সালে ছাত্র হিসেবে ঢুকেছি, ১৯৯৮ সালে শিক্ষক থাকতে বেরিয়ে এসেছি। বুয়েট সংকটের পেছনে ছাত্রদের নানামাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক কারণ ও বর্তমান সমাজের বিভিন্ন সম্মিলিত প্রভাবের কথা বলব। ঐতিহাসিকভাবে এখানে ছাত্রদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি আছে। নানা সময়ে এটা মেটানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কখনো নির্মোহভাবে হয়নি। বহু নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থী টিউশনি করে পড়াশোনা করে। উচ্চবিত্তরা কিছু ফ্যাশন করেও টিউশনি করে। এটা করতে গিয়ে সারা বছর নিয়মিতভাবে তাদের পড়া হয় না। টিউশনির ছাত্রের পরীক্ষার সঙ্গে কখনো তার নিজের পরীক্ষার সংঘাত বাধে। তখন সে নিজের পরীক্ষা পেছানোর দাবি তোলে। বেশি নয়, অনধিক ১৫ দিন পেছাতে চায়। কিন্তু শিক্ষকেরা তা ঠান্ডা মাথায় নাকচ করেই আসছেন। তাই এই পরীক্ষাপদ্ধতি এখন মূল্যায়নের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত। তাদের মানসিক চাপমুক্ত করা দরকার। যে শিক্ষার্থী তার আগের শিক্ষাজীবনে ভালো ফল দেখে অভ্যস্ত, সে এখানে কম নম্বর পাচ্ছে বা ফেল করছে। তার ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। এ জন্য তার কাউন্সেলিং দরকার। কিন্তু শিক্ষকেরা এদিকে উদাসীন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মনস্তত্ত্ববিদেরা শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করলে উপকার পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থা আছে। পরীক্ষাভীতি ছাড়াও পারিবারিক সমস্যাও শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলে।

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে শিক্ষকেরা লাঞ্ছিত হয়েছেন।

আইনুন নিশাত: আমি বিভাগীয় প্রধান, হলের প্রভোস্ট এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অর্থাৎ ডিরেক্টর অব স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার (ডিএসডব্লিউ) ছিলাম। উপাচার্যের পরে তিনি শক্তিশালী কর্মকর্তা। হলের প্রভোস্টদের নিয়োগ তাঁর পরামর্শেই ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আমি ছাত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি।

১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আমি স্মরণ করতে পারি, পরীক্ষা পেছাতে তারা বড়জোর লাইট নিভিয়ে দিয়ে চেঁচামেচি করেছে, তার বেশি নয়। এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটা তখন কেউ কল্পনাও করত না। বুয়েটের আরেক সংকট ছাত্র-শিক্ষক দূরত্ব। অল্প কিছু শিক্ষকই দাবি করতে পারেন যে ছাত্ররা তাঁদের কাছে সহজে যেতে পারে। বেশির ভাগ শিক্ষকই আকাশের ওপরে বসবাস করেন। ছাত্রদের থেকে অনেক দূরে। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দরজার সামনে লেখা থাকে, কখন, কত ঘণ্টা তারা শিক্ষককে পাবে। ছাত্ররা ক্লাসে যেটা বোঝে না, সেটা তারা টিউটরিয়ালের মতো করে বুঝতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এটার প্রচলন আছে। বুয়েটে এটা নেই। বরং তাঁরা কখনো ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে তাদের বকাবকি করেছেন, এমন নজিরও আছে। তাই বলব, বুয়েটে বেশ কিছু শিক্ষকের মধ্যে পেশাগত শিক্ষাদানের একটি ঘাটতি ৫০ বছর ধরে চলছে। এদিকে নজর দেওয়া হয়নি। ছাত্র যখন ক্লাসে তাত্ত্বিক দিকগুলোর প্রায়োগিক দিক দেখতে না পায়, তখন তারা পড়াশোনার প্রতি অন্যমনস্ক হয়। অধিকাংশ ছাত্রের সহপাঠ্যক্রম ও খেলার মাঠের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এখন টেলিভিশন হয়ে উঠেছে তাদের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। আমাদের সময়ে একটা ছেলে অসুস্থ হলে শিক্ষকেরা–প্রভোস্টরা তার খোঁজখবর নিতেন। এখন তা হয় না। একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, আজকাল তো সামরিক বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি বিরাট আগ্রহ দেখি। অনেকেই পিএইচডি করছেন। বর্তমান সেনাপ্রধানের সঙ্গে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে দেখা। তিনি বললেন, সেনাপ্রধান হওয়ার কারণে তাঁর পিএইচডি থিসিসের গবেষণা সম্পন্ন করতে হচ্ছে। আমি আনন্দিত হলাম। অথচ আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহের ঘাটতি চোখে পড়ছে। এর মূল কারণ গবেষণাকাজে কর্তৃপক্ষের উৎসাহের ঘাটতি। এখানে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।

প্রথম আলো: শিক্ষকেরা এখন স্বীকার করছেন যে তাঁদের কথায় হলে পুলিশ আসা-যাওয়া করে না। নেতাদের কথায় আসে, চলে যায়। আবরারকে হত্যার পর পুলিশ নেতার কথায় এল, রাত দুইটায় চলে গেল। এটা অসদাচরণ কি না? এই পুলিশকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে কি না, যারা লাশ ও খুনিদের রেখে চলে যায়।

আইনুন নিশাত: ষাটের দশকে ভিসি বা প্রভোস্টের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে পুলিশের উপস্থিতি অসম্ভব বিষয় ছিল। আমি অবাক হই, আবরারকে দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন করা হয়েছে। এই সময়ে ওই কথিত টর্চার সেলের (২০১১ নম্বর কক্ষ) আশপাশের ছেলে বা হলের দারোয়ানেরা কেন প্রভোস্টকে অবহিত করেনি। আমি প্রভোস্ট থাকাকালীন হলে কোনো কারণে উত্তেজনা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে না ঘটতেই খবর পেতাম। নিজে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে রাতবিরাতে ঝামেলা মিটিয়েছি। আমি একা নই; সব হল প্রভোস্ট ও সহকারী প্রভোস্ট একই রকমভাবে তা করেছেন। দারোয়ানদের বলাই ছিল, কিছু ঘটামাত্র আমাকে জানাবে। তবে ওই সময়ে শিবির সন্দেহে কয়েকটি কক্ষে আগুন দেওয়া হয়েছিল। এখন শুনি, ছাত্রদের রুম বরাদ্দ দেয় ছাত্রনেতারাই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটিতে কাকে রাখা হবে, কাকে হবে না, তা–ও ঠিক করে নেতারা। তবে এতখানি ধস কিন্তু অতি সাম্প্রতিক। আমি বলব, ২০১৩ সালের পর থেকে ঘটছে। আমি যত দূর শুনেছি, শিক্ষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে ছাত্রদের একটি গ্রুপের গভীর সম্পর্ক হওয়ার কারণে এই বিপর্যয়। বুয়েটে র‌্যাগিং একটা আক্রমণাত্মক রূপ নেয়। এটাও প্রতিষ্ঠা পায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে যে মত, সেটা তারা সহ্য করবে না। পরবর্তীকালে তুচ্ছ কারণে সাধারণ ছাত্রদের প্রহার ও হেনস্তা রুটিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বলে প্রতীয়মান হয়। একজন সাবেক প্রভোস্ট হিসেবে অনুমান করি, সেদিন রাতে সবার নির্লিপ্ত থাকার কারণ হচ্ছে, পাঁচ–ছয় বছর ধরে এক গ্রুপ ছাত্র অন্যদের মারপিট করছে। এটা সিনিয়র-জুনিয়র প্রশ্ন নয়। যদি সেটাই হতো, তাহলে প্রথম বর্ষের ছাত্র তৃতীয় বর্ষের ছাত্রকে পেটাত না।

প্রথম আলো: তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে বুয়েট ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিমণ্ডলে এমন একটা কিছু গুরুতর ঘটনা ঘটেছে, যা খুবই সম্প্রতি। রুগ্‌ণ রাজনীতির আসর আগেও ছিল। কিন্তু খুব সম্প্রতি কী এমন ঘটল? বুয়েট তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন থাকলেও কোন পথে এত বড় সর্বনাশ?

আইনুন নিশাত: অবশ্যই সাম্প্রতিক। ঢুকেছে এই পথে, যখন ছাত্ররা বুঝেছে, নেতা হলেই চাঁদাবাজি করা যায়। দোকানে গিয়ে পয়সা না দিয়ে খাওয়া যায়। চারপাশে অনেক নির্মাণকাজ হয়, তা থেকে বখরা মেলে। আশপাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে মাস্তানি হচ্ছে, তার প্রভাবও আছে। তারা দেখেছে, গণরুম কালচার কী। হলে কে, কখন, কোথায় থাকবে। ক্ষমতাসীন–সমর্থক হলেই ক্ষমতার দম্ভ দেখানো যায়। আমি মনে করি, উপাচার্য যদি শক্ত থাকেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ফেরানো সম্ভব, তার উদাহরণ বর্তমান উপাচার্যের ঠিক আগের উপাচার্য। তিনি খালেদা একরাম, উপাচার্য থাকতেই ক্যানসারে মারা গেছেন। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেই পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন বন্ধ করেছিলেন। তিনি তাঁর চারপাশের শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়েছেন। সম্মিলিতভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমান উপাচার্য উল্টো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় ঝুলিয়ে রাখেন। শিক্ষকদের নানা কল্যাণমুখী উন্নয়নের বিষয় তাঁর একগুঁয়েমির কারণে বাধাগ্রস্ত হতে দেখেছি। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষক-কর্মচারীদের নতুন স্কেলে পেনশন দেওয়ার পক্ষে। সিন্ডিকেটের সদস্য পরিবর্তন করা হলো। এই সিন্ডিকেটও আগের সিদ্ধান্ত যথার্থ মনে করেছে। কিন্তু তিনি তা অগ্রাহ্য করে উচ্চ আদালতে বারবার মামলা করেছেন। পরাস্ত হয়েছেন। দুই বছর সিন্ডিকেট (২০১৮-১৯) সদস্য হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, তিনি তাঁর পছন্দের সিদ্ধান্ত দিতে আগ্রহী; নিয়মকানুন বা প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্যকে তিনি স্থান দিতে নারাজ। একটুতেই মন্ত্রীর কাছে দৌড়ান। সচিবালয় কিংবা ইউজিসিতে ছোটেন। স্বায়ত্তশাসনের ধারণায় তিনি কুঠারাঘাত করছেন।

অথচ ১৯৪৭ সালের জুন মাসে, অর্থাৎ দেশভাগের আগে প্রতিষ্ঠিত আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কিছুদিন আগপর্যন্তও কার্যকরভাবে শিক্ষকদের সহযোগিতায় পরিচালিত হতো। তদানীন্তন অধ্যক্ষ বা উপাচার্য শুধু নেতৃত্ব দিয়েছেন।

প্রথম আলো: বুয়েট আইন উপাচার্যকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। ১৯৬১ সালে আইয়ুবের সামরিক ফরমান দিয়ে আমরা আজও চলছি কেন? এই আইন বদলাতে আপনারা কথা বলছেন না কেন?

আইনুন নিশাত: বুয়েটের ভিসি চাইলে বুয়েট বিক্রি করে দিয়ে চ্যান্সেলরকে রিপোর্ট করতে পারেন। এতটাই তাঁর ক্ষমতা। ডিন, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ভিসি প্রতি পদে পদে উল্টে দিচ্ছেন। কোনো কিছুকেই তিনি পরোয়া করছেন না। এই মন্তব্য রূঢ়, কিন্তু এর সপক্ষে প্রচুর নজির রয়েছে। বর্তমান উপাচার্যের বাচনভঙ্গি মনোরম, তাৎক্ষণিকভাবে এমন উত্তর দেবেন, যাতে প্রশ্নকারী সন্তুষ্ট হবেন। তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনে মেধার বদলে ক্ষমতার প্রয়োগকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

প্রথম আলো: বুয়েটের অ্যালামনাই আবরার হত্যার পর ছুটে গিয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ চাইল। কিন্তু তারা তো বুয়েটের শাসনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণে সরব হতে পারত। এটা তো কখনো ইস্যু হেয়ে ওঠেনি। আচ্ছা, স্বাধীন বাংলাদেশে কেন ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলো না?

আইনুন নিশাত: হয়েছিল। বাহাত্তর সালেই এই আইন সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল। আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (পরে বিচারপতি) খসড়াটি চূড়ান্ত করেছিলেন। আমি এটি নিশ্চিত জানি, কারণ আমার প্রয়াত পিতা (গাজী শামছুর রহমান) তখন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন। আমি যত দূর জানি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের আইনের বিষয়ে একটা আলাদা অনুশাসন দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হবে। হয়তো তিনি নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসি বা ডিন নিয়োগ চাননি।

প্রথম আলো: বুয়েটের পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগ কী রীতিতে চান? বুয়েটের প্রতি সরকারগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি কী?

আইনুন নিশাত: সরকার যাঁকে উপযুক্ত মনে করবে, তাঁকেই উপাচার্য নিয়োগ দেবে। তবে বুয়েটকে সরকার প্রান্তিক বিষয় মনে করে। বুয়েট নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। ভিসি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতাই প্রাধান্য পাওয়া সমীচীন নয়। মনে রাখতে হবে, বুয়েটের সবাই মেধাবী। দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে। আমেরিকায় একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। তারা পরিপক্বতা ও সামর্থ্যের ওপর জোর দেয়। এভাবেই বাংলাদেশি কেমিক্যাল প্রকৌশলী অমিত চাকমা বর্তমানে কানাডার ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর উপাচার্য।

প্রথম আলো: বুয়েট নিয়ে বর্তমানে আপনার গর্বের জায়গা?

আইনুন নিশাত: এখন পর্যন্ত বুয়েটে তিনটি বিষয় আছে। প্রথমত, মেধাভিত্তিক উন্মুক্ত ছাত্র ভর্তি। আমার ভয় হয়, কোন দিন না আবার কোটার নামে অন্য কিছু চলে আসে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষক নির্বাচনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের আস্থা। যিনি পড়ান, তিনি পরীক্ষা নেন, তিনিই খাতা দেখেন। তাঁর দেওয়া নম্বরই চূড়ান্ত। এই তিন বিষয় এখনো আমার প্রচণ্ড গর্বের জায়গা।

প্রথম আলো: বর্তমান অচলাবস্থা কী করে মিটবে? প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান?

আইনুন নিশাত: এই মুহূর্তে এমন একজন উপাচার্য খুঁজে বের করতে হবে, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে গুণগত দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। একজন উপাচার্য শুধুই প্রশাসক নন। তাহলে তো একজন দক্ষ আমলা বা সামরিক কর্মকর্তাকে উপাচার্য বানানো হতো। একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান আহরণের পরিবেশ গড়ে তুলবেন। ক্ষমতার দম্ভে তিনি রাজত্ব চালাবেন না। পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর হলে জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী উপাচার্যের পদত্যাগ প্রস্তাবে সই দিতে পারেন, সেটা বিচার্য। সরকারপ্রধানের হস্তক্ষেপ আশা করি। তিনি যাঁকে বিশ্বস্ত মনে করেন, জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।

প্রথম আলো: বেরোনোর উপায়?

আইনুন নিশাত: রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। কারণ, রাজনীতিকেরাও নিশ্চয় দেশের ভালো চান। রাজনৈতিক দলের কাছে জোড়হাত করে আবেদন, আপনারা সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রসংগঠন বন্ধ করুন। পাস করার পরে তাদের দলে নিন, তার আগে নয়।

প্রথম আলো: শনিবারের সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হলো ‘বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষকরাজনীতি নিষিদ্ধ’। ১৯ অভিযুক্তকে সাময়িক বহিষ্কার। শিক্ষার্থীদের ১০ দফা মেনেছেন উপাচার্য। দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কীভাবে দেখছেন?

আইনুন নিশাত: গদি টেকাতে যা করার বা বলা প্রয়োজন, উপাচার্য এখন তা–ই করবেন। ছাত্রদের সঙ্গে সভা করার সময়ে শিক্ষক সমিতিকে ভিসির পাশে দেখে তা–ই মনে হলো, এরা কতটা অসহায়। সত্যিই কি মেনে নেওয়া এসব দাবি বাস্তবায়িত হবে?

প্রথম আলো: ২০০২ সালে সনি হত্যাকাণ্ডের সময়ের ডিএসডব্লিউ আমাদের বলেছেন, এ রকম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ওই সময়ও ছিল।

আইনুন নিশাত: তথ্যটি সঠিক। শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি বা সংগঠন–সম্পৃক্ততা ১৯৬১ থেকেই নিষিদ্ধ। কারণ, যে আইনবলে বুয়েট প্রতিষ্ঠিত, তার সব শিক্ষকই পাবলিক সার্ভেন্ট। তবে অনেকেরই জানা নেই যে ১৯৮৯ সালের ৩১ জুলাই বুয়েট একাডেমিক কাউন্সিল একটি ছাত্র অধ্যাদেশ পাস করেছিল। সেটাই বুয়েট আইন। ওই অধ্যাদেশের ১৬ ধারা বলেছে, ছাত্র বা হল সংসদের বাইরে ডিএসডব্লিউর লিখিত অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো ছাত্রসংগঠন করতে পারবে না। আমার জানামতে, এই লিখিত অনুমতি কখনো কোনো সংগঠনকে দেওয়া হয়নি।

গত শুক্রবার উপাচার্য যেভাবে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছেন, সেটা কার্যত আরও খারাপ হলো। কারণ, এটা ছাত্রদের তুষ্ট করার কৌশল। যে রাজনীতি করছে, তা বুয়েটভিত্তিক নয়, রাজনৈতিক দলভিত্তিক। দলগুলো যদি সমর্থন না দেয়, তাহলে এই সিদ্ধান্তের মূল্য নেই। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। ছাত্রসংগঠন কে ঠেকাবে, কে বন্ধ করবে? এই ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। আমি জোর দেব প্রধানমন্ত্রীর কথায়, যেখানে তিনি বলেছেন, আমি দেখতে চাই প্রতিটি হল এসব থেকে মুক্ত। প্রধানমন্ত্রী যে দৃষ্টিকোণ থেকে মন্তব্য করেছেন, সেটা বাস্তবায়ন না হলে কিছুই হবে না। উপাচার্যের নয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের ওপরই ভরসা রাখতে চাই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আইনুন নিশাত: আপনাকেও ধন্যবাদ।