দুই নেত্রী, অনেক হয়েছে এখনই সংলাপে বসুন

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বর্তমানে বিকল্পধারা বাংলাদেশ–এর সভাপতি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন কেরছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী

প্রথম আলো : আগে সরকারের পতন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার মতো নির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। এবার তত নির্দিষ্ট নয়। চলতি অবরোধ সমাবেশ না নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য, অনেকটাই অস্পষ্ট যেন—
বি. চৌধুরী : আমার তা মনে হয় না। কারণ, ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হলো, তার বিরুদ্ধে বিএনপির একটা অবস্থান নিশ্চয় আছে। তাই চলমান আন্দোলন নির্বাচন বাদ দিয়ে নয়। তবে প্রশ্ন হলো, ৫ তারিখে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতি কী হতো? এটা সরকারের সঠিক, না ভুল পদক্ষেপ হলো—চিন্তা করার বিষয়।
প্রথম আলো : বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তারেকের মন্তব্য কি ঠিক ছিল? সমাবেশ না করতে দেওয়া এবং ওই মন্তব্য দুটিই ভুল কি না?
বি. চৌধুরী : হ্যাঁ। তাঁর ওটা কোনো গ্রহণযোগ্য বক্তব্যই নয়। ওটা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না আসলে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি, তাহলে করল কে? তখন তো বিএনপি ছিল না। এটা কোনো কথা হলো?
প্রথম আলো : আপনি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন।
বি. চৌধুরী : পারিনি। পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া করে কী লাভ? তাই চলে এসেছি।
প্রথম আলো : অবরোধের মধ্যে তাঁর সঙ্গে কি কোনো কথা হয়েছে?
বি. চৌধুরী : না। তিনি (খালেদা জিয়া) একদিন ফোন করেছিলেন।
প্রথম আলো : কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
বি. চৌধুরী : কিছুই না। ধন্যবাদ, থ্যাংক ইউ। কেমন আছেন? আমার শরীরটা তখন খুব খারাপ ছিল। কয়েক দিন শয্যাশায়ী ছিলাম। বোধ হয় কারও কাছে জানতে পেরেছিলেন। রাজনৈতিক কোনো কথাবার্তা তিনি বলেননি।
প্রথম আলো : আপনার দিক থেকে তাঁকে কোনো পরামর্শ কি দিয়েছেন বা দেবেন?
বি. চৌধুরী : না। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় আমার বক্তৃতা-বিবৃতি গিয়েছে, সেটাই আমার পরামর্শ।
প্রথম আলো : বিএনপির জোটে আপনি নেই। তাহলে মতভিন্নতা এখন কোথায়?
বি. চৌধুরী : আমরা আলাদা। প্রথম থেকেই আমরা বলছি, এটা বিকল্পধারা। বাংলাদেশে যে রাজনীতি চলে, তাতে আমাদের বিশ্বাস নেই। বিশেষ করে হরতালের রাজনীতির আমরা বিপক্ষে। ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচিতে বিশ্বাসী নই।
প্রথম আলো : তাহলে অবরোধকে কী চোখে দেখছেন? অবরোধ ডাকার অধিকার বিএনপির আছে। আবার সরকার তাকে নাশকতাপূর্ণ বলছে। বিএনপি সরকারকে দায়ী করছে।
বি. চৌধুরী : অবরোধ চলছে। নাশকতা হচ্ছে। সরকার বলছে বিএনপি ও জামায়াত দায়ী। বিএনপি বলছে, এটা সরকার করছে। কে করছে আমরা তো জানি না। মানুষের মৃত্যু আমাকে বিচলিত করছে।
প্রথম আলো : অবরোধ প্রত্যাহারে বা সরকারকে কি কিছু নির্দিষ্ট করে বলেছেন?
বি. চৌধুরী : বলেছি যথেষ্ট হয়েছে। আপনারা কথা বলেন। রাজনীতির প্রথম কথা হলো সংলাপ। আইরিশরা যখন ইংরেজদের মারত, তখন তারা অবৈধ ছিল। ব্রিটেন তাদের সঙ্গেও সংলাপ করেছে।
প্রথম আলো : আমাদের ইতিহাসে সংলাপ নেই।
বি. চৌধুরী : নেই বলেই তো বলি সংলাপ করেন।
প্রথম আলো : কিন্তু সংলাপের জন্য রাজনীতিতে যে ধরনের উপাদান থাকা দরকার, তা এখনো যুক্ত হয়নি।
বি. চৌধুরী : হয়নি। তার কারণ আমরা খুব জেদি। জাতি হিসেবে খুব জেদি।
প্রথম আলো : এর মানে আলোচনা আসন্ন দেখছেন না?
বি. চৌধুরী : না। না। ওই আলোচনাই একমাত্র আশার জায়গা।
প্রথম আলো : কিন্তু পরিবেশ কোথায়? খালেদা জিয়া যদি তারেক রহমানের বক্তব্যটা প্রত্যাহার করে নেন, তাহলে কি একটা ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে? ওই মন্তব্য তো উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে?
বি. চৌধুরী : সত্যি। কিন্তু খালেদা জিয়া কেন করবেন, যিনি বলেছেন তাঁরই তো করা উচিত। তবে বিএনপির পক্ষে এটা প্রত্যাহার করে নিলে কি ক্ষতি হবে?
প্রথম আলো : সেই আহ্বান জানাবেন?
বি. চৌধুরী : জানাইনি। তবে জানাব। এ পর্যন্ত যা কিছু গোলমাল হয়েছে, সেসব বিষয়ে সোজা একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি—আমি মনে করি এটা একটি স্টুপিড স্টেটমেন্ট।
প্রথম আলো : আবার জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের চর ছিলেন—
বি. চৌধুরী : এও অগ্রহণযোগ্য। যেই আগেরটি প্রত্যাহারের কথা বলবেন, অমনি এটিও প্রত্যাহারের কথা উঠবে। এ থেকে বেরোতে হলে মানুষকে ভালোবাসার রাজনীতি করতে হবে। তাহলেই বেরোনো সম্ভব। তবে আমি একটি প্রস্তাব দিই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো মানহানিকর বা অশালীন মন্তব্য অন্তত আগামী এক বছর কেউ করবেন না। করলেও মিডিয়া তা প্রচার করবে না।
প্রথম আলো : জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা কেন সংলাপের উদ্যোগ নেন না। ব্যর্থ হবেন বলেই কি?
বি. চৌধুরী : একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে আমি রোববার একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করছি। কদিন আর বাঁচব, তাই দুই পক্ষকেই বলব, অনেক হয়েছে, এবার আপনারা আলোচনায় বসুন।
প্রথম আলো : কবে নির্বাচন চান? খালেদা জিয়া সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে ‘যথাশিগগির’ চেয়েছিলেন। তার মানে কি নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি খুব তাড়াহুড়োয় নেই?
বি. চৌধুরী : বিএনপির অবস্থান আমি বলতে পারব না।
প্রথম আলো : ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ তাই—
বি. চৌধুরী : আমি মনে করি, প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটাই বড় কথা নয়। তার চেয়েও বড় কথা অর্থমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী বলেছিলেন, এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। তাঁরা যেটা বলেছিলেন, সেটাই করে দিন ভাই। তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
প্রথম আলো l অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ভারতের মতো প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন সম্ভব বলেছেন।
বি. চৌধুরী : এই প্রস্তাব দিয়ে তিনি ভালোই করেছেন। তবে ক্ষমতাসীন দল কি আসলেই নির্বাচন দিতে চায়? আমার তা মনে হয় না। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রাখা না-রাখা এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন। এখন প্রথম প্রশ্ন কখন নির্বাচন হবে?
প্রথম আলো : তার মানে আপনি প্রধানমন্ত্রীকে রেখেও নির্বাচন মানছেন?
বি. চৌধুরী : আমি মনে করি, এটা আলোচনার বিষয়। আমি মত দেব না। কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে, তা আমি কখনো বলিনি।
প্রথম আলো : কিন্তু একটি নির্বাচন আপনাকে সাময়িক স্বস্তি দেবে। আবারও তো একই চক্রে পড়ার হুমকি থাকবে।
বি. চৌধুরী : থাকবে যদি বিরোধী দল জিতে যায়। সে জন্য আমরা এর আগে বলেছিলাম, কোন দল কত ভোট পায় সেই হিসাবে তাদের প্রার্থীদের জয়ী ঘোষণা করা হোক। এটা ইউরোপের অনেক দেশে আছে। এতে প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীলতা কায়েম হতে পারে।
প্রথম আলো : বিএনপি কিন্তু পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো শাসনগত কোনো পরিবর্তন আনার কথা বলছে না। তারা বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকেই ব্যবহার করতে কেবল ক্ষমতা চায়।
বি. চৌধুরী : আপনি সঠিক বলেছেন। তবে এখানে অন্যান্য দল থেকে আমরা স্বতন্ত্র। আমরা বলি, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করা। যখনই বলেন ক্ষমতায় গেছি তখন পোজপাজ কিন্তু অন্য রকম হয়ে যায়। সাংসদেরা যে শক্তি প্রয়োগ করে, তা ওই ক্ষমতায় যাওয়ার অনুভূতি থেকেই।
প্রথম আলো : চলমান সংকট নিরসনে কারও মধ্যে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না কেন?
বি. চৌধুরী : অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা বলার পর মুখ বন্ধ রেখেছেন। যেমন ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে কটাক্ষ করা হলো। এ রকম করলে মানুষের সাহস চলে যায়। তাঁরা ভাবতে পারেন আমার এত ঠেকা কী?
প্রথম আলো : আপনি কি তেমন জ্যেষ্ঠদেরই আহ্বান জানাতে যাচ্ছেন?
বি. চৌধুরী : না। আমি প্রধানত দুই নেত্রীর প্রতি আহ্বান জানাব। সংলাপে লজ্জার কিছু নেই। এতে ভয়ের কিছু নেই। মনোভাবটা থাকবে, সংলাপে আমি ভয় পাই না।
প্রথম আলো : দুই নেত্রীর কোনো সংলাপ স্মরণ করতে পারেন কি?
বি. চৌধুরী : তাঁদের মধ্যে দুবার সংলাপ হয়েছিল। তবে সেটা যে কারণে ঘটেছিল সেই কারণ এখন অনুপস্থিত। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এরশাদ চিহ্নিত ছিলেন। সুতরাং তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে তাঁদের ঐক্য সহায়ক ছিল। এখন তৃতীয় পক্ষ নেই, তাই একই ধাঁচে পড়বে না। শত্রুপক্ষ না থাকলে আমাদের জুত হয় না। তৃতীয় কোনো পক্ষ থাকলে সংলাপ সম্ভব ছিল। অবশ্য স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের সহায়তায় আবদুস সামাদ আজাদ ও তাঁর দলের সঙ্গে আমাদের ভালো আলোচনা হয়েছিল। একটা যৌথ প্রস্তাবে আমরা কাছাকাছি গিয়েছিলাম।
প্রথম আলো : দুই নেত্রীর সেই সংলাপ কি অন্তরঙ্গ ছিল?
বি. চৌধুরী : খুব অন্তরঙ্গ বলা যাবে না। ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাড়িতে প্রথমে কাট কাট কথা দিয়ে শুরু হলো। এরপর আস্তে আস্তে বরফ গলেছিল। আরেকবার কোনো একটি অফিসে আলোচনা হলো। শুভেচ্ছা বিনিময়। শুকনো সভা যদিও। তবে এ থেকে একটা জিনিস বোঝা যায়, ইচ্ছে থাকলে কথা বলানো সম্ভব। তৃতীয় পক্ষের আশঙ্কা থাকলে কথা বলানো একটু বেশি সুবিধাজনক হয়। এখন তো তৃতীয় পক্ষ নেই। এরশাদ যদি একটি কড়া পজিশনে থাকতেন, তৃতীয় পক্ষ হয়ে উঠতে পারতেন, তাহলে জিনিসটি সহজ হতো। কিন্তু তিনি তো এখন গৃহপালিত। সবটাই স্টেজ ম্যানেজ মনে হয়।
প্রথম আলো : বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে ক্ষতি কী?
বি. চৌধুরী : যাঁরা এটা বলেন, তাঁদের সৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আবার এতটাই সহজ কি না সে বিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। সরকার চাইলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু সেটা না করে বিএনপির কাছ থেকে ছাড়িয়ে কখনো নিজের কাজে লাগাবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আসলে রাজনীতি, বাংলাদেশ রাজনীতির জন্য যা আরও বেশি সত্য—এটা ভাবী-কথনের অযোগ্য এক বিজ্ঞান। আনপ্রেডিকট্যাবল। ব্রিটিশরা বলে আবহাওয়া, এই রোদ এই বৃষ্টি।
প্রথম আলো : খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তার আশঙ্কা করেন?
বি. চৌধুরী : কেন করব না, যখন এটা সংসদে আলোচিত হয়েছে।
প্রথম আলো : তাহলে আলোচনা হবেই না?
বি. চৌধুরী : কাকে নিয়ে আলোচনা করবেন? জেলে পুরে সংলাপ ইতিহাসে পাইনি। আমি ভয় পাই যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলে আলোচনার পথ বন্ধ হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
বি. চৌধুরী : ধন্যবাদ।