বিশেষ সাক্ষাৎকার : এম শামসুল আলম
আইন লঙ্ঘন করে সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে
অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি প্রকৌশল অনুষদের ডিন ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও জনজীবনে এর প্রভাব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও রাফসান গালিব
প্রথম আলো: সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে প্রতি লিটারে ১৫ টাকা। সরকারের দাবি, লোকসান কমাতে ও উন্নয়ন প্রকল্প ঠিক রাখতে এই সিদ্ধান্ত। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?
এম শামসুল আলম: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। কারণ, সরকার যা কিছু করুক না কেন, সেটি জনগণের কল্যাণ ও স্বার্থ সুরক্ষার জন্য করতে হবে। জনস্বার্থের সঙ্গে সরকারের এ সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক হয়েছে। যদি উন্নয়ন প্রকল্প ঠিক রাখতে বা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে ঘাটতিকে যুক্তি হিসেবে ধরি, সেটা সরকারের বিবেচনা হতে পারে না, এটা হতে পারে বাণিজ্যিক বিবেচনা। ব্যবসা করলে সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও আইনি পরিকাঠামোর আওতায় করতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) লাইসেন্সি হিসেবে বিপিসিকে বিইআরসির কাছে আসতে হবে। বিইআরসি যাচাই-বাছাই করে তা গণশুনানিতে দেবে। সেখানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এ মূল্যবৃদ্ধি যৌক্তিক।
প্রথম আলো: কিন্তু অতীতে তো তেলের দাম বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে গণশুনানি হয়নি?
এম শামসুল আলম: অতীতে এলপিজির ক্ষেত্রে গণশুনানি হয়নি। এ ব্যাপারে আমরা মামলা করেছিলাম। আমরা বলেছি, শুধু তেল নয়; সব পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ বিইআরসির প্রবিধান মোতাবেক হতে হবে। সেই প্রবিধান তৈরির এখতিয়ার হচ্ছে বিইআরসির, তবে সেখানে জ্বালানি বিভাগের অর্থাৎ সরকারের সম্মতি নিতে হবে। বিইআরসি ২০১২ সালে এ প্রবিধান তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, জ্বালানি বিভাগ সেটি আটকে রেখেছে। আমরা ২০১৩ সালে তাদের এ কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করি। তেলের দাম সাড়ে পাঁচ বছর ধরে কম ছিল, তখন সমন্বয় করা হয়নি। যদিও বিভিন্ন মহলে দাবি উঠলে সরকার ডিজেলের দাম লিটারে মাত্র তিন টাকা কমিয়েছিল। তখন পরিবহন ভাড়া কিন্তু কমানো হয়নি। প্রতি মাসে বারো শ কোটি টাকা পরিবহনমালিকদের পকেটে গেছে। তাঁরা লাভবান হয়েছেন, ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা বলেছিলাম সমন্বয়ের দরকার নেই, আপনারা একটা তহবিল করেন, যেখানে প্রাইজ স্টাবিলাইজড ফান্ড হবে, যদি কখনো তেলের দাম বেড়ে যায়, ঘাটতি পূরণের জন্য সে ফান্ড থেকে টাকা দিয়ে সমন্বয় করা হবে। দাম কমে গেলে বাড়তি টাকা ফান্ডে যাবে।
প্রথম আলো: আপনি বলতে চাইছেন, এখানে তাহলে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
এম শামসুল আলম: আমি যে গণশুনানির কথা বলেছিলাম, সেখানে বিইআরসি আইনের ৩৪ ধারায় দুটি উপধারা আছে, একটি হচ্ছে লাইসেন্সি হিসেবে বিপিসিকে বিইআরসিতে আসতে হবে, কিন্তু তারা আসেনি। এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সাড়ে পাঁচ বছর ধরে তেলের দাম যে কমবেশি হয়েছে, সেখানে গত মে বা জুলাই মাস পর্যন্ত তারা কোনো লোকসান দেয়নি। রাজস্ব চাহিদা অথবা ব্যয়, সরকারের ভ্যাট, ট্যাক্স, মুনাফাসহ সেই ব্যয় অপেক্ষা তারা অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে। জ্বালানি বিভাগই বলেছে, ৪৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। জনগণের কাছ থেকেই সে টাকা নেওয়া হয়েছে। এই টাকার ওপর সরকারের কোনো অধিকার নেই। আইনের ভাষায় বলতে গেলে, জ্বালানি বিভাগ লুণ্ঠনমূলক মূল্যহার নির্ধারণ করে এবং বজায় রাখে। আইনের দ্বারা নির্ধারিত হলে সেই মূল্যহার ন্যায়সংগত হতো, ফলে উল্লেখিত অতিরিক্ত টাকা জনগণকে দিতে হতো না।
প্রথম আলো: সরকার তো বলছে, এ টাকা সে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছে।
এম শামসুল আলম: তাহলে প্রশ্ন হলো, সরকার কি অন্যের পকেটের টাকা এমনভাবে নিতে পারে? সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারে। কিন্তু সরকার জনগণের পকেট থেকে টাকা এমনভাবে নিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করতে পারে না। টাকার উৎস জানা থাকুক বা না থাকুক সরকার সে টাকা জব্দ করে প্রকৃত মালিককে ফেরত দেবে, এটাই আইন। যেমনটা ই-কমার্সের ক্ষেত্রে করা হচ্ছে।
প্রথম আলো: এর আগে তো তেলের দাম যখন বেশি ছিল, সরকার ভর্তুকিও দিয়েছে।
এম শামসুল আলম: সে ভর্তুকি তো সরকার নিজের টাকা থেকে দেয়নি। এর জন্য জনগণের কর বেড়েছে। সেই করের টাকায় সরকার ভর্তুকির টাকা সমন্বয় করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের হিসাবে এখন পর্যন্ত তার ঘাটতি হচ্ছে এগারো শ কোটি টাকার বেশি। অনেকগুলো কারণে মানুষ এ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি গ্রহণ করতে পারেনি। আমরা আইন ও অধিকারের বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। যদি গণশুনানিতে যেত, তাহলে বিষয়গুলো কীভাবে সমন্বয় করা যেত, তার একটি ব্যাখ্যা থাকত। আমার ধারণা, জ্বালানি বিভাগ বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্পষ্ট করেনি। এখন আসি জ্বালানিসচিব বলছেন যে আমার এগারো শ কোটি টাকা ঘাটতি তো অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি দিচ্ছে না। না দিলে সেটা পাব কোথায়? এটা হচ্ছে জ্বালানি বিভাগের প্রশ্ন। এরপর বিপিসি বলছে, এ ঘাটতি সে পোষাবে কী করে? এখন তারাই বলছে, ৪৩ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে, যেখান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে আর ৩৩ হাজার কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ আছে। এই যে উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হলো, এর সুফল কোথায়? ভোক্তার টাকা হিসেবে তো সেটি তার পক্ষ থেকে এই উন্নয়নে বিনিয়োগ হতে হবে। সরকার যদি সে টাকা নিয়ে গিয়ে থাকে, সেটি ফেরত দিতে হবে। বিপিসিতে ভোক্তার অর্থে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল করা হয়েছে, সেসব তহবিল থেকে এলএনজির ঘাটতি সমন্বয় করা হয়, এখানেও সেটি করা যেত।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার এই ধারা বেশি দিন থাকবে না। বিশ্বব্যাপী ফসিল জ্বালানির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে। অনেক দেশই ফসিল জ্বালানির স্থলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে, জার্মানির মতো উন্নত দেশ এখন বিদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি রপ্তানি করছে। এর উৎপাদন খরচ কম। অনেক দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাদ দিয়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনেও চারটি শক্তিশালী দেশ সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে। এর মধ্যে তেলের দাম বাড়তে থাকলে এর ব্যবহার আরও কমে যাবে
প্রথম আলো: আপনারা কি সরকারের এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করবেন?
এম শামসুল আলম: আমরা সরকারের কাছে দুটি বিষয় পরিষ্কার করেছি। আইন লঙ্ঘন করে ও এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে এ মূল্যহার পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রবিধানমতে, কোনো পক্ষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তারা মূল্যবৃদ্ধির রিভিউ চাইতে পারে, বিইআরসির প্রবিধানগুলোতে বলাই আছে যে ৩০ দিনের মধ্যে যেকোনো পক্ষ রিভিউ চাইতে পারে, যদিও এলপিজির ক্ষেত্রে তারও অনেক পরে রিভিউ চাওয়া হয়েছিল। আমরাও বলেছি, এখন এটা রিভিউ হতে পারে। তবে সেটি করতে হবে বিইআরসিকে।
প্রথম আলো: সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভারতে ডিজেলের দাম অনেক বেশি। এখানে দাম না বাড়ালে পাচার হয়ে যেত। পাচার বন্ধের জন্য দাম বাড়ানো হলে তাকে কি সঠিক সিদ্ধান্ত বলবেন না?
এম শামসুল আলম: দিনে দুই শটি ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশে ঢোকে, বেরিয়ে যাওয়ার সময় তারা কিছু তেল নিয়ে যেতে পারে। ভারতে তেল পাচার হচ্ছে বলতে এটিই ঘটছে। আর কোনোভাবে পাচার হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। তেল পাচার রোধ করার দায়িত্ব তো সরকারের। সে কাজ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। জনগণের করের টাকায় তো তারা পরিচালিত হয়। তাহলে তেল পাচারের দায় কেন জনগণকে দেওয়া হবে। ফলে সরকার যদি এ কথা বলে, তাহলে সে তার ব্যর্থতা স্বীকার করে নিল।
প্রথম আলো: জ্বালানির এই দাম বাড়ানো জনজীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে? করোনার অভিঘাত কাটিয়ে যখন অর্থনীতি অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তখন জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে কীভাবে দেখছেন?
এম শামসুল আলম: ক্যাবের প্রতিবেদনে আমরা দেখতে পারছি, করোনা মহামারির কারণে ৭৭ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। বিশাল অংশের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। করোনা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হয়ে এলেও মানুষের আয়ের সুযোগ ভালোমতো তৈরি হয়নি, অর্থনীতি মাত্রই গতি পাচ্ছে, এর মধ্যে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সীমিত আয়ের মানুষকে আরও চাপে ফেলেছে, এখন এই চাপ মোকাবিলা করতে মানুষ তার ব্যয় সংকোচন করবে। মানুষ তো না খেয়ে থাকবে না, আগে যা খেত সেটাকে অর্ধেক করে ফেলবে। সন্তানকে একটা ভালো স্কুলে পড়াত, এখন সেটা পারবে না। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সেখানেও টিউশন ফি দিতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী ঘরে বসে আছে। সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে, যেমন ২০২১ সালের মধ্যে আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হব। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হতে ১ হাজার ৪৬ ডলার আয় করতে হতো, সেখানে আমরা বাইশ শ ডলারের ওপর আয় করেছি, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিঃসন্দেহে বিশাল সফলতা। করোনার সময় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে বিশ্বের মধ্যে আমরা দৃষ্টান্ত রাখতে পেরেছি। এখন আমরা ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হব, এর জন্য দারিদ্র্যের সংখ্যা আরও কমিয়ে ফেলার লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা সম্ভব হতো, যদি জ্বালানির এ মূল্যবৃদ্ধি না ঘটত। এখন ভোক্তা ব্যয় কম করলে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স কম পাবে। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। ভোক্তা খরচ কমিয়ে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করল, এর ফলে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হলো। তখন সরকার ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে, এর ফলে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। সম্প্রতি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা এমন আশঙ্কার কথা বলেছেন। ফলে শিল্প-বাণিজ্য খাতে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হবে, অনেকে কর্মসংস্থান হারাবে। মোটকথা, করোনা আমাদের হার মানাতে পারেনি, দুর্বল করতে পারেনি, কিন্তু জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি আমাদের দুর্বল করার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে সম্ভাব্য ধস ঠেকানোই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথম আলো: জ্বালানির দাম বাড়ানোর বিকল্প কী ছিল?
এম শামসুল আলম: আমার মতে বিকল্প ছিল, এখানে বিপিসির মুনাফা কমাতে পারত। তার যে লোকসান এখন হচ্ছে, সেটা কিন্তু মুনাফা ধরেই। মুনাফা কমালে তার লোকসানও কমে আসত। আমদানি শুল্ক কমিয়ে সরকারের রাজস্ব কমানো যেতে পারত। বিপিসি থেকে বছরে ৬-৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হিসেবে নিয়ে যায়। সেসব তো সরকার করলই না, বরং মূল্যবৃদ্ধির কারণে তার আয় আরও বেড়ে গেল।
প্রথম আলো: ডিজেলের পর কি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও বাড়বে বলে মনে করেন?
এম শামসুল আলম: সরকারের অন্দরমহলে দাম বাড়ানো নিয়ে ইতিমধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। যে যুক্তিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়েছে, সেই যুক্তিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর কথা। আর যদি না বাড়ানো হয় বুঝতে হবে তাদের যুক্তি ঠিক ছিল না। ডিজেলে তিন হাজার কোটি টাকা সরকার সামাল দিতে পারছে না বলে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ তো আরও অনেক বেশি।
প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দামের গতিপ্রকৃতি কী হতে পারে? দাম বাড়তেই থাকবে?
এম শামসুল আলম: আমার ধারণা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার এই ধারা বেশি দিন থাকবে না। বিশ্বব্যাপী ফসিল জ্বালানির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে। অনেক দেশই ফসিল জ্বালানির স্থলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। বিশেষ করে, জার্মানির মতো উন্নত দেশ এখন বিদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি রপ্তানি করবে। এর উৎপাদন খরচ কম। অনেক দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাদ দিয়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনেও চারটি শক্তিশালী দেশকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার জোর দাবি উঠেছে। এর মধ্যে তেলের দাম বাড়তে থাকলে এর ব্যবহারও কমবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজার সম্প্রসারণ হবে, ফসিল জ্বালানি বাজার হারাবে। ফলে বাজার ধরে রাখার জন্য জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম কমাতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির স্বল্পমেয়াদি চাপ সামাল দিতে যে টেকসই নীতিকৌশল নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, আমরা সেটি নিতে পারিনি।
প্রথম আলো: বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন থেকে আমরা কী পেলাম?
এম শামসুল আলম: বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এই যে প্রতিবছর দেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে, তারও কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু আমরা তথা স্বল্প দেশসমূহ কিছু পাইনি। ক্ষতিপূরণ বাবদ এক শ বিলিয়ন ডলারের তহবিলে অনুদান প্রাপ্তির উল্লেখযোগ্য সাড়া মেলেনি। কার্বন নির্গমন প্রতিরোধে শক্ত কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ক্ষতির পরিমাণটা যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারছি বলে মনে হয় না। আবার ক্ষতিপূরণে আমরা যে অর্থ পাচ্ছি, তার একটা অংশ সরকার ঋণ হিসেবে নিচ্ছে। আমরা এর বিরোধী। আমরা বলেছি ঋণ নয়, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষ, তাদের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার কিছু করছে না। সরকারের কথা ও কাজেও যথেষ্ট গরমিল আছে। সরকারের ঘোষণা ছিল ২০২১ সালে মোট জ্বালানির ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জোগান দেবে। কিন্তু ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের তথ্যে দেখা যায়, গ্রিডে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ অনুপস্থিত। আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে এমনটি হতো না। এ কারণেই আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আইন করার কথা বলেছি। সরকার নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে। কিন্তু নিজেদের সক্ষমতা তৈরি করছে না। বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর করছে। পঁচাত্তরের আগের যে রাষ্ট্রীয় দর্শন ছিল জাতীয় সম্পদ সুরক্ষা, উৎপাদন, সঞ্চালন ও বণ্টন সবই সরকার করবে। এখন আমরা দেশি-বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে করছি। আমি মনে করি, সরকারের এই নীতি কেবল জাতীয় স্বার্থের বিরোধী নয়, আত্মঘাতীও।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম শামসুল আলম: আপনাকেও ধন্যবাদ।