অকার্যকর আইন টিকিয়ে রাখা অর্থহীন
>এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ক্যাসিনো সংস্কৃতির বিস্তার আপনাকে বিস্মিত করেছে?
মাহবুব উদ্দিন: মোটেই নয়। কারণ, এটা আনুষঙ্গিক। শিল্পবিপ্লবের চারটি ধাপ। আমরা চতুর্থ পর্যায়ে এসেছি। এখন আমরা ক্লাউড টেকনোলজিতে এসেছি। এর ফলে আমরা দেখছি আমাদের জীবনযাত্রা ও তার মান একেবারেই ভিন্ন হয়ে গেছে, যেটা শিল্পবিপ্লবের প্রথম ধাপে ছিল না। বর্তমানে যে পরিবর্তন, তার মূল বক্তব্য হলো অন্যকে বঞ্চিত করে অর্থ উপার্জন করা। সেখানে যত রকম উপায়ে বঞ্চনা ও প্রতারণা কর সম্ভব, সেটা ঘটবে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটাই দেখব যে সে নিজেই নির্বাচন করবে, সংসদ সদস্য হবে, রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে দেখবে এবং আমরা তা দেখছি। এই সময়ে যারাই তাদের সম্পদ ও অর্থ সঞ্চয়ে বাধা সৃষ্টি করবে, যারা এর প্রতিবাদ করবে, তারা তা প্রতিহত করবে। আইনগুলোও তৈরি হয় এই শ্রেণির উপযোগী করে। এটা হবে জনগণের স্বার্থের বিপরীত। যখনই জনস্বার্থের সঙ্গে সংঘাত হয়, তখন সরকার লুটেরাদের পক্ষ নেয়। সরকার জনগণকে দমাতে গিয়ে তখন অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে যত গবেষণা পাশ্চাত্যে হয়েছে, তাতে দেখা যায়, রাষ্ট্র হয়ে পড়ে একটি পেনাল স্টেট বা শাস্তি দানকারী রাষ্ট্র। তার মূল উদ্দেশ্যই থাকে জনগণকে শাস্তি দেওয়া।
প্রথম আলো: ক্যাসিনো সংস্কৃতি সমাজে যে পরিবর্তন আনছে, তাকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগ নির্দিষ্টভাবে যেসব সমীক্ষা করেছে, তার ফলাফল কী?
মাহবুব উদ্দিন: এসবের ফলাফল অনেকটাই একাডেমিক। তার অডিয়েন্স খুবই সীমিত। সেই অর্থে এই ফলাফলের কোনো প্রভাব সমাজে নেই। বাংলাদেশে লেখাপড়ার কোনো প্রভাব রাজনীতিতে পড়ে না। ভারতবর্ষে একটুখানি হয়েছিল। কিন্তু নেহরুর পরে এটা থেমে গেছে। সে জন্য অমর্ত্য সেনরা চিৎকার করছেন, কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তাদের রীতিতেই চলছে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে এর কী অভিঘাত দেখেন? বিশেষ করে সংস্কৃতিতে, মানুষের বিনোদনে?
মাহবুব উদ্দিন: কোনো ভিন্নতা নেই। নিউ ক্লাস, নিউ লিবারেলিজম দেখছি। ভারতে মারুতি ক্লাস, আমাদেরটা লুম্পেন ক্লাস। বলতে পারেন বিএমডব্লিউ ক্লাস।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক সমীক্ষায় কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন, তা যদি নির্দিষ্ট করে বলেন? দুবাইয়ে পাঁচ কিশোরীকে ড্যান্সার করার কথা বলে নাইটক্লাবে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করছে বাংলাদেশি সিন্ডিকেট।
মাহবুব উদ্দিন: আমরা সমীক্ষায় দেখেছি, দেশে একটা নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি, নব্য বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান ঘটছে। আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে একটি থিসিস করিয়েছিলাম। এতে আমরা দেখার চেষ্টা করেছি, এই বুর্জোয়া শ্রেণি কীভাবে তৈরি হলো, তাদের অর্থ কী করে তৈরি হলো? নানা অবৈধ পথের মধ্যে মানব পাচার করে অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়টিও আমরা পেয়েছি। এসব করে দেশে একটি ধনিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। এই ধারাকে পরাস্ত করতে হলে সরকারকে গণমুখী করা দরকার। মানব পাচারের মতো অপরাধ সরকারকেই বন্ধ করতে হবে। জনগণের পক্ষে এটা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
প্রথম আলো: আমরা গত কয়েক দিনে দেখছি, অভিযানগুলোতে মাদকের দায়ে মানুষকে সাজা দেওয়া হচ্ছে মোবাইল কোর্টে। অথচ মাদকবিরোধী যুদ্ধে চার শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাল। আবার একই সঙ্গে সংসদ এমন আইন তৈরি করল, যে কারণে এখন মাদক মামলার বিচার বন্ধ।
মাহবুব উদ্দিন: বর্তমান সরকারের মূল কাজ হচ্ছে নানা কায়দায় জনগণকে প্রলুব্ধ করা এবং এর মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় করা। এই সমর্থন খোঁজার জন্য সরকারকে প্রচারণার আশ্রয় নিতে হয়। খারাপটাকেও ভালো বলতে হয়, যা ছিল না, তাকে নিয়ে আসতে হয়। এখন প্রচুর আলোচনা টিভিতে। বলা হচ্ছে, এসব অপকর্ম আসলে বিএনপি শুরু করেছিল। আওয়ামী লীগের ভেতরে অনুপ্রবেশ করে তারা আওয়ামী লীগকে খারাপ রাস্তায় নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের বদনাম করছে। এসব তারা বলছে, কারণ তাদের জনসমর্থন আদায় করা দরকার। এই যে কিছু অভিযান ও ধরপাকড় হলো, এর প্রতি জনগণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এতে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কিন্তু একই সঙ্গে যারা এক্সপোজড হচ্ছে, তাদেরকেও সরকারের বাঁচানো দরকার। তাই সূক্ষ্মভাবে আইনের বিভিন্ন প্যাঁচ দিয়ে তাদের জন্য একই সঙ্গে একটা দায়মুক্তির পথও তৈরি করা হচ্ছে। সে কারণে আপনি দেখবেন, চলমান অভিযানের কোনো স্বচ্ছতা নেই। ধরপাকড় করে কখন জনপ্রিয়তা আদায় করা যায়, তা বিভিন্ন পালাবদলের সময়ে আমরা দেখেছি। র্যাব গঠনের পরে ক্রসফায়ার এমনভাবে করা হলো, সেটা জনগণের একধরনের সমর্থন পেয়েছিল। আমরা দেখলাম, এই জনসমর্থন আদায় করার পর তাদেরকে লক্ষ্য অর্জনের কাজে ব্যবহার করা শুরু হলো। এসবেরও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাজনৈতিক ভিন্নমত বন্ধ করে দেওয়া।
প্রথম আলো: শিক্ষকতায় আপনার সুবর্ণজয়ন্তী ছুঁইছুঁই। সামনে কী দেখছেন? কেমন সমাজ চান?
মাহবুব উদ্দিন: সারা বিশ্বে যা ঘটছে ও ঘটবে, তারই একটা অংশ হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একটি স্যাটেলাইট দেশে পরিণত হচ্ছে। রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব নিয়ে থাকা তার জন্য কষ্টকর হবে। তার কারণও হচ্ছে এই ক্লাউড টেকনোলজি। যে অবস্থা তৈরি হচ্ছে ডিটেরিটরিয়ালাইজেন। এর অর্থ হলো ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদ আর থাকছে না। আপনি মাল্টিপল আইডেনটিটি দেখবেন। উত্তর আধুনিকতার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাল্টিপল আইডেনটিটি। যেমন আমরা বলি বাংলাদেশি ক্যানাডিয়ান। অর্ধেক কানাডীয়, অর্ধেক বাংলাদেশি। আমাদের একটা বাংলাদেশি পরিচিতি আছে আবার একটা সর্বভারতীয় পরিচিতিও আছে। আবার জাতিরাষ্ট্রের ধারণা থেকে সরে গিয়ে আমরা বৈশ্বিক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছি। আমাদের নদীমালার উৎস কিন্তু বাংলাদেশে নয়, সেটা আরেক দেশে। কার্যকর কিছু করতে গেলে সংশ্লিষ্ট সব দেশকে নিয়েই করতে হবে এবং সে জন্য একটা সুশাসনের দরকার। জাতিসংঘভুক্ত থাকার প্রক্রিয়ায় আমরা অনুধাবন করেছি যে একটি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা দরকার। কিন্তু সেটা যেহেতু অনুপস্থিত, সে কারণে সবকিছুই দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে করতে হচ্ছে। সেখানে শক্তির ভারসাম্যে টিকতে পারা কঠিন এবং আমাদের ছাড় দিতেই হচ্ছে।
প্রথম আলো: আমরা শুরু করেছিলাম ক্যাসিনো কালচারের ব্যাপ্তির প্রসঙ্গ নিয়ে...
মাহবুব উদ্দিন: হ্যাঁ। আমার সংস্কৃতির মধ্যে ওই ছাপগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিক বলে তার যে নিজস্বতা, সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল দেখি, সেটা কিন্তু ভারতীয় টিভি চ্যানেলে লেপ্টে আছে। ভারতীয় চ্যানেল বেশি জনপ্রিয়। মানুষ বাংলাদেশি চ্যানেল কিছুটা দেখে খবর ও টক শোর জন্য, আর বাদবাকি অনুষ্ঠানগুলোর জন্য ভারতীয়। সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে দেখছি, আগে আমাদের যে স্থানীয় সংস্কৃতি ছিল, সেখান থেকে আমরা বিশ্বায়নের দিকে যাচ্ছি। এটা যদি সংস্কৃতির মধ্যে ঘটে, অর্থনীতিতে ঘটে, তাহলে রাজনীতিতেও ঘটবে। রাজনীতি কেন আমরা আলাদা ভাবব? যা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, তা হচ্ছে, আগে যে সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতবাদ ছিল, সেটা প্রথমে লুপ্ত হবে এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে এটা একটা ভার্চ্যুয়াল স্টেটে পরিণত হবে।
প্রথম আলো: আমাদের যে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি বা খেলাধুলা ছিল, সেগুলো একেবারে হারিয়ে কি ক্যাসিনো কালচার জেঁকে বসবে, না দুই ধারাই পাশাপাশি চলবে?
মাহবুব উদ্দিন: এখন একই সঙ্গে চলছে বটে। তবে আস্তে আস্তে নিজস্বতা হারিয়ে যাবে। আমরা যদি আমাদের খাবারের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখবেন যে, বিশেষ করে রেস্তোরাঁগুলোতে আমাদের খাবারের ধরন বদলে গেছে। এখানেও বিশ্বায়ন দেখছি। কিছুটা থাই, চায়নিজ, জাপানি ও কোরিয়ানের মিশেল ঘটছে। তবে বেশি ঝোঁকটা পাশ্চাত্যের দিকেই। এখনো আমরা মনে করি যা কিছু উত্তম, তা-ই পাশ্চাত্যের। খাবার, ড্রেস, বিনোদনে ধারণা, মনে হয় পাশ্চাত্যে শ্রেষ্ঠতর।
প্রথম আলো: ১৭ কোটি মানুষের দেশ এবং প্রায় ২ কোটি মানুষের রাজধানীতে তাহলে বিনোদনের ব্যবস্থা এই বিশ্বায়নের যুগে কী হবে? ঢাকার বাইরে হাউজির মতো খেলা নিয়ে হাইকোর্টে প্রায়ই রিট হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে জুয়া নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল।
মাহবুব উদ্দিন: এ প্রসঙ্গে আমরা একটা সহজ সূত্র বলতে পারি। সেটা হলো ‘ডাইজ ফাংশনাল ল’। আমরা আইন ও নিয়মকানুন তৈরি করি একটা পর্যায় পর্যন্ত। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি আইনকে পরিবর্তন করা না হয়, তা হলে আইন টিকে থাকে শুধু বাহ্যিকভাবে। বাস্তবে তা কার্যকর থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল আইন তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ১৯২১ সালের আইনটি এখন পর্যন্ত সংশোধন করা হয়নি। যেমন যদি কোনো ছেলে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তাহলে প্রক্টরের অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় তাকে আট আনা জরিমানা দিতে হবে। এখন এই বিধানটি হাস্যকর। এমন আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যাতে আমাদের দেশের জনগণের কোনো অংশ অভ্যস্ত এবং সমাজে এর চল রয়েছে কিন্তু তাকে আমরা আইনসিদ্ধ করিনি। তাহলে আমরা কী দেখব? আমরা চাই বা না চাই একসময় এটা সিদ্ধ হয়ে যাবে। আমরা যদি অবাস্তব আইন করি বা পুরোনো আইনকে সে রকমই রেখে দিই, তাহলে কে আমাদের সমাজকে সুরক্ষা দেবে? প্রশ্ন হলো, আমরা কেন ভাবব, আইন সমাজের বাইরের একটি ধারণা? আইন কোনো স্থির বিষয় নয়, এটা সব সময় পরিবর্তনশীল। সমাজের অর্থনীতি ও রাজনীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেও সেখানে পরিবর্তন আনতে হয়। সতীদাহ ও বিধবাদের বিবাহ না করার প্রথা কি টিকে আছে? যুগে যুগে সচেতন মানুষেরা যা করেছেন, তা হচ্ছে আইনের আশ্রয় নিয়ে নতুন আইন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে মানুষকে কার্যকর আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়। অথচ আমরা কি করছি? আমরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি যে আইন মানার দরকার নেই। আইন একটা থাকবে বটে কিন্তু সেটা মানার দরকার নেই। এটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমরা সংবিধানে অনেক কিছুই লিখি, যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে চর্চা করি না।
প্রথম আলো: আমাদের কী করা দরকার? কোথা থেকে শুরু করতে হবে?
মাহবুব উদ্দিন: এই যে এত কিছু ঘটছে, নানা কালচার দেখা যাচ্ছে, এর সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার একটা সম্পর্ক রয়েছে। ইংরেজি, ধর্মীয়, জাতিগত ইত্যাদি আলাদা শিক্ষা বিলোপ করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। উঁচু-নিচু ভেদাভেদ পুষলে চলবে না। কুদরাত-এ-খুদা কমিশন থেকে সেই চেষ্টা চলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বঙ্কিমরা তো বাংলা ও ইংরেজিতে পারদর্শী ছিলেন। সেই উত্তরাধিকার বহন করতে হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুব উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।