প্রথম আলো: বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সংবিধান মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে কতটা কাজ করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
রিদওয়ানুল হক: বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সংবিধানের সফলতা যেমন রয়েছে, তেমনি ব্যর্থতাও রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলগুলো কার্যকর হওয়ার আগেই আমাদের সংবিধানে মানবাধিকার বিষয়ে একটি অধ্যায়, অর্থাৎ তৃতীয় অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। খসড়া আগে করা হলেও মানবাধিকার নিয়ে দুটি বড় আন্তর্জাতিক দলিল কার্যকর হয় ১৯৭৬ সালে। অন্যদিকে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয় ১৯৭২ সালে। এককথায় আমি মনে করি, আমাদের সংবিধান মানবাধিকার বা নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে চমৎকার একটি দলিল। কিন্তু একই সঙ্গে সংবিধানে কিছু বিরোধ, কিছু অস্পষ্টতা আছে। কিছু বিধান রয়েছে, যেগুলো গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে সেগুলো কিন্তু মূল সংবিধান রচনার বেশ পরে যুক্ত করা হয়েছে।
নিবর্তনমূলক আটকাদেশ দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়েছিল। লক্ষণীয় হলো, সংসদ যাতে এ আইন করতে পারে, তার জন্য ১৯৭৩ সালে সংবিধান সংশোধন (দ্বিতীয় সংশোধনী) করা হয়। সংবিধান সংশোধন না করলে আইনটি মৌলিক অধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী হিসেবে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা সহজ হতো। একই সঙ্গে সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বিষয়টিও যুক্ত করা হয়। জরুরি অবস্থার মানে হলো এ সময় আইন ও নির্বাহী ক্ষমতাবলে কিছু মৌলিক অধিকার, যেমন বাক্স্বাধীনতা স্থগিত করা যাবে। আমাদের সংবিধানে সরকারকে এ বিষয়ে একটা ‘ব্ল্যাংক চেক’ বা ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জরুরি অবস্থার সময় কিছু মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা গেলেও তার একটা সীমা থাকতে হয়। আমাদের সংবিধানে যেভাবে আছে, সেই বিধান আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
সংবিধানে এ ধরনের কিছু বিধান রয়েছে, যেগুলো গণতান্ত্রিক অধিকারের বিপরীতে কাজ করছে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে সংবিধানের কিছু ব্যর্থতা আছে। তবে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে এগুলোর জন্য সংবিধান নয়, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই দায়ী। মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন বা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জন্য মূলত দায়ী আমাদের নির্বাহী বিভাগ, অর্থাৎ সরকার, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ক্ষেত্রে সংসদেরও কিছু দায় আছে। সংসদে এমন কিছু আইন করা হয়েছে, যা মানবাধিকার বা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। কিছু ক্ষেত্রে আদালতেরও ব্যর্থতা আছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা না করতে পারার দায় সামগ্রিকভাবে নির্বাহী, আইন ও বিচার—সব বিভাগেরই।
প্রথম আলো: সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় সংবিধানের অভিভাবক বা রক্ষক। তাহলে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন বাতিলের ক্ষেত্রে আদালতের তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না কেন?
রিদওয়ানুল হক: একটা সময় ছিল যখন মৌলিক অধিকার রক্ষা বা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন বাতিল করার ক্ষেত্রে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট অনেক অগ্রণী ও সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। আদালত তো নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে কোনো আইন বাতিল করেন না বা করতে পারেন না। সেটার জন্য একটা সচেতন জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন হয়, যাঁরা ভুক্তভোগী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে অথবা জনস্বার্থে মামলা বা রিট করেন। এর মাধ্যমে অসাংবিধানিক আইনগুলো চ্যালেঞ্জ করা যায়। কিন্তু গত এক দশকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে।
এখন আগের মতো মৌলিক অধিকারবিরোধী আইন নিয়ে রিট করতে দেখা যায় না। বাস্তবতার কারণেই হয়তো আদালতও বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন না। নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব রয়েছে। উচ্চ আদালত যদি সত্যিই ভূমিকা রাখতে পারতেন, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আইন বাতিল হয়ে যেত। এসব ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা যে আশানুরূপ নয়, সেটা স্বীকার করতেই হবে।
প্রথম আলো: রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে সংবিধানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে বলে আমরা জানি। অনেকেই মনে করেন, আমাদের এখানে অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যে উত্থান, তার বীজ এ সংবিধানের মধ্যেই ছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধানের দাবিও তুলেছেন। অন্যদিকে আবার বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরত যাওয়ার কথাও বলেন কিছু মানুষ। সংবিধান নিয়ে এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
রিদওয়ানুল হক: সংবিধান নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি। এটা গণতান্ত্রিক চর্চারই একটা অংশ। এখন যে কর্তৃত্ববাদী শাসন বা প্রবণতা আমরা দেখছি, তার জন্য সংবিধানই শুধু দায়ী—এমনটা আমি মনে করি না। সামরিক শাসনের অবসানের পর আমরা যখন আবার সংসদীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি, তখন গণতন্ত্রকে যতটুকু সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন ছিল, সেটা সংবিধানের মধ্যে আমরা দিতে পারিনি। আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে অতিরিক্ত ক্ষমতায়িত করা হয়েছে। তবে এটাও প্রধান কারণ নয়। এর জন্য দায়ী আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঘাটতি এবং ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা ছাড়তে না চাওয়ার কারণেই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার উদ্ভব হয়েছে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের সংবিধানে এখন পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এই সংশোধনীগুলো কি সংবিধানের মূল কাঠামোকে অনেকখানি দুর্বল করে দিয়েছে?
রিদওয়ানুল হক: সংবিধান কোনো স্থির বিষয় নয়, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এ কারণে সংবিধান সংশোধন একটি স্বাভাবিক বিষয়। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কিংবা সংবিধানকে আরও উন্নত করতে সংশোধনীর প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমাদের সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়নি। সংবিধানে এমন কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে, যা সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। ১৭টি সংশোধনীর মধ্যে ৩-৪টি আছে একেবারেই ‘নির্দোষ’ সংশোধনী। বাকি সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকারকে সুবিধা দিতে।
উদাহরণস্বরূপ, চতুর্দশ সংশোধনী (সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স বৃদ্ধি করা) ও পঞ্চদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা)—এ দুটি সংশোধনীর কথা বলা যায়। এভাবে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন সরকার তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সংবিধানকে ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া করেছে। ফলে সংবিধানের মূল কাঠামো অনেকখানি দুর্বল হয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রথম আলো: সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল। উচ্চ আদালত তা অবৈধ ঘোষণা করেন। এটা নিয়ে বহু ধরনের বিতর্ক আছে। এ রকম একটি রাজনৈতিক বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত দেওয়াকে কীভাবে দেখেন?
রিদওয়ানুল হক: সাংবিধানিক আইনে একটি তত্ত্ব আছে, যেটাকে রাজনৈতিক প্রশ্নতত্ত্ব বলে। এর মূল কথা হলো, রাজনৈতিক বিষয়ে আদালত হস্তক্ষেপ করবেন না বা সিদ্ধান্ত দেবেন না। কিন্তু অনেক সময় রাজনীতি ও সাংবিধানিক আইনকে আলাদা করা যায় না। সে ক্ষেত্রে আদালতই সিদ্ধান্ত নেবেন—বিষয়টা রাজনৈতিক, না আইনগত।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রে আদালত মনে করেছেন, এটা সাংবিধানিক প্রশ্ন। এ কারণে আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আমিও মনে করি, বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক নয়, এর সঙ্গে আইনের একটা সম্পর্ক আছে। তবে এটা মোটাদাগে রাজনৈতিক প্রশ্ন। এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হয়। সেই বিবেচনায় কিছু অসংগতি বা ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ আছে।
আদালত যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘অসাংবিধানিক’ ও ‘অগণতান্ত্রিক’ বলেছেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এসেছিল সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তাহলে এটা কীভাবে অগণতান্ত্রিক হয়? ত্রয়োদশ সংশোধনী তো রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতিফলন। সুতরাং এটাকে অসাংবিধানিক বলা যুক্তিযুক্ত নয়। ভিন্নমত পোষণকারী আপিল বিভাগের তিনজন বিচারপতি এই রায় বৈধ কি না, তা নির্ধারণের জন্য জনগণের মতামত নেওয়ার কথা বলেছিলেন।
আদালত যে প্রক্রিয়ায় রায়টি দিয়েছেন, সেটা নিয়েও কিছু প্রশ্ন আছে। খুব তড়িঘড়ি করে এ রায় দেওয়া হয়েছিল। এ রায়ের ফলে কী ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে এবং ক্ষমতাসীন দল তার নিজের স্বার্থে এটাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারে, সেগুলোর কোনো কিছুই বিবেচনা করা হয়নি। আদালতের রায়ের পর সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এসেছিল। এ কারণে তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংসদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি।
প্রথম আলো: ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের একটি ফল হলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। বাংলাদেশের মতো বিবদমান রাজনৈতিক পরিসরে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, এটা কি বাস্তবসম্মত? গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কতটা আশাবাদী হতে পারি?
রিদওয়ানুল হক: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিবেচনায় রেখে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। ১৯৭২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস হলো অনাস্থা, অবিশ্বাস ও সংবিধান লঙ্ঘনের ইতিহাস। সেই দিক থেকে আমি মনে করি, যে দল ক্ষমতায় থাকবে, সেই দলের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, এটা একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়। দলীয় সরকারের অধীন ১৯৭৩ সালের নির্বাচন তুলনামূলকভাবে ভালো হয়েছিল। এর একটা কারণ হলো, সেই সময়ে বিরোধী দল অতটা শক্তিশালী ছিল না। সামরিক শাসকদের সময় যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোকে প্রকৃত অর্থে নির্বাচন বলা যায় না। সেগুলো ছিল একধরনের ‘সিলেকশন’। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়েছে।
এগুলো বাদে দলীয় সরকারের অধীন যে নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটাই সুষ্ঠু হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে দুটি নির্বাচন হলো, সেগুলো ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ আরও কিছু দল অংশগ্রহণই করেনি। ৩০০টির মধ্যে ১৫০টির বেশি আসনে সরকারি জোটের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ভোট দেওয়ার হারও ছিল অনেক কম। অপর দিকে ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও সেই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। দেশি-বিদেশি অনেক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে নানা রকম অসংগতি ও কারচুপির কথা বলা হয়েছে। এ রকম অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীন আগামী নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে।
প্রথম আলো: জাতীয় নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকলে সংসদ সদস্যরা তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন এবং তাঁরা নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সুযোগ পান বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন?
রিদওয়ানুল হক: অনেক দেশেই দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হয়। সেসব দেশে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। আর সংসদ বহাল থাকলে সংসদ সদস্যরা অন্য প্রার্থীদের তুলনায় বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে গত দুটি নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল থাকায় সংসদ সদস্যরা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন। আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংসদ বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, এটা একটা দুরূহ ব্যাপার। এটা গণতন্ত্রের মূল চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
প্রথম আলো: সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এ নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে কি না এবং নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে কি না, সেই সংশয় এখনো কাটেনি। ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ। দলটির পক্ষ থেকে সংবিধান ‘রক্ষার’ হাঁকডাক দেওয়া হচ্ছে। অপর দিকে বিএনপির দাবি, সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন দিতে হবে। দুই দল এমন অনমনীয় অবস্থানে থাকলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কি সম্ভব? সংবিধানের মধ্যে এর কোনো সমাধান আছে কি?
রিদওয়ানুল হক: অনমনীয় অবস্থান বজায় থাকলে বর্তমান সংবিধানের মধ্যে এ সংকটের সমাধান নেই। ১৯৯৬ সালেও একই রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই সময় একতরফা একটা নির্বাচন করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং কিছুদিন পর তারাই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এগুলো সবই হয়েছিল রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে।
সুতরাং বর্তমান সংকটের সমাধান করতে হলেও রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সংবিধানের ভেতরে-বাইরে অনেকভাবেই উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এমনকি রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন না করেও একটি নির্বাচনকালীন বা ক্রান্তিকালীন সরকারের অধীন নির্বাচন হতে পারে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র নিয়ে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন কী?
রিদওয়ানুল হক: সংবিধান প্রণয়নের পর ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। নানা প্রতিকূলতা ও বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান এখনো টিকে রয়েছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সাংবিধানিকতার বড় দুটি চ্যালেঞ্জ হলো অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রিদওয়ানুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।