সোহরাব হাসান: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় কীভাবে?
শামসুর রহমান খান : ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর নির্দেশেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ হলো, নিখিল পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছিল শাহ আজিজের নেতৃত্বে। এম এ ফাইনাল বর্ষের ছাত্র আবদুর রহমান চৌধুরী(পরবর্তীকালে বিচারপতি) বললেন, ‘আমাদের নেতা এসে গেছেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শেখ মুজিব ভর্তি হলেন। আমরা ঘনিষ্ঠ হলাম। আইন বিভাগে থাকতে আমরা একত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে যুক্ত হই। ১৯৪৮ সাল জিন্নাহ যেদিন রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা দিলেন, আমি সেখানে ছিলাম। তাঁর সম্পর্কে আমার খুব উঁচু ধারণা ছিল না। তিনি ঘোষণা দিলেন, উর্দু, উর্দু উইল বি দা স্টেট ল্যাংগুযেজ অফ পাকিস্তান। জিন্নাহ মনে করতেন, বাম ও হিন্দুরা ছাড়া সবাই উর্দু চায়। এ কারণে জিন্নাহর ভাষণের পর রেসকোর্সে ফেস্টুন ছেঁড়া হয়। এরপর আমার ছাত্রত্ব শেষ হয়। ১৯৫১ সালে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই।
সোহরাব হাসান: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যুক্ত হলেন কীভাবে?
শামসুর রহমান খান: বেশির ভাগ সময় আমার পদায়ন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ষাটের দশকে করাচিতে কমান্ডার মোয়াজ্জেমের বাসায় শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনি বললেন, ‘তোমরা যদি কিছু পারো, করো। যদি করে ফেলতে পারো, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। এই ব্যাটাদের সঙ্গে থাকা যাবে না।’
মোয়াজ্জেম খুব রোমান্টিক ছিলেন। তিনি সেনা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন। শেখ মুজিব স্টুয়ার্ড মুজিবকে আগরতলা পাঠালেন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। নিজেও একবার আগরতলা গেলেন। রেজা আলী তাঁকে সহায়তা করেছিলেন। আমি বলব, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ঘটনা ছিল অপরিপক্ব ও বালখিল্য। তবে তারা বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে বিশ্বাস এসেছিল, ‘এটা এক দেশ নয়, দুই দেশ।’ এরপর আমি ইকোনিমিক কাউন্সিলর হিসেবে জাকার্তায় চলে যাই। ১৯৬৮ সালে আমাকে জাকার্তা থেকে ডেকে পাঠানো হলো। ইসলামাবাদে পৌঁছানোর পর গ্রেপ্তার হলাম। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় পাঠানো হলো। অন্য আসামিদের সঙ্গে আমার ঠিকানাও হলো সেনানিবাসে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমাকে জড়ানোর আরেকটি কারণ হলো ভারতীয় উপ–দূতাবাসের প্রথম সচিব পি কে ওঝা আমার বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন।
সোহরাব হাসান: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তো আপনারা সবাই বেকসুর খালাস পেলেন। এরপর কী করলেন?
শামসুর রহমান খান: এরপর আমি ব্যবসা শুরু করি। আইয়ুবকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এলে নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়। শেখ মুজিব একবার খবর পাঠালেন। আমি তাঁর বাসায় যেতেই জিজ্ঞেস করলেন, নির্বাচন করব কি না। আমি বললাম, রাজনীতিতে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। সত্তরের নির্বাচনের পর এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। অনেক হাসিঠাট্টা হলো। তিনি বললেন, ঠিকমতো চলো। না হলে পড়ে যাবা। আমি বললাম, ‘আমি পড়ে গেলে একাই পড়ে যাব। তুমি পড়ে গেলে হাজার হাজার লোক পড়ে যাবে।’ সেখানে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, জেলখানায় আপনাদের কোনো কষ্ট দেওয়া হয়েছে? আমি বললাম, শেখ সাহেব ও তিন সিএসপি অফিসারকে কষ্ট দেওয়া হয়নি। অন্যদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। এরপর পাকিস্তান অবজারভার লিখে দিল, ‘শামসুর রহমান সেইজ, নান সাফার লেস দ্যান শেখ’। আমি বিস্মিত হলাম। এ রকম কোনো কথা তো আমি বলিনি।
সোহরাব হাসান: স্বাধীনতার পর কবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার দেখা হলো? কীভাবে মস্কোয় রাষ্ট্রদূত হয়ে গেলেন।
শামসুর রহমান খান: ১০ ফেব্রুয়ারি বাসায় বসে আছি। পরের দিন সকালে গণভবনে যাওয়ার আগেই শেখ মুজিব টেলিফোন করে বললেন, সন্ধ্যায় বাসায় এসো। সন্ধ্যায় ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়ে দেখি ঘরভর্তি লোক। তাঁর মা-বাবাও এসেছেন গোপালগঞ্জ থেকে। আমাকে দেখে বললেন, ‘শামসুর এদিকে এসো।’ এরপর কোলাকুলি করে বললেন, ‘মস্কো যাবা নাকি?’ এর মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ চলে এলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনার চাকরি হয়ে গেছে।’ আমি শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘খেদাইবার চাও কেন?’ তিনি বললেন, তাহলে কাল আসো। সকাল সাড়ে সাতটায় টেলিফোন করে বললেন, ‘আইবা না?’ সন্ধ্যাবেলায় এসো। জানো আমি কে? স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। টেলিফোনেও স্যালুট পাচ্ছি। বললেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট বানাতে হবে না? এটা পাকিস্তান নয়। এ দেশে রাষ্ট্রপতির শাসন চলবে না। প্রধানমন্ত্রী দেশ শাসন করবেন। কাল নয়টায় আসো। পরদিন গেলাম। বারান্দায় বসে আছি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ঠিক করলা?
সোহরাব হাসান: তখন কি সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বীকৃতি দিয়েছিল?
শামসুর রহমান খান: মস্কো তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমি বললাম, সেই দেশের সম্মতি তো লাগবে। শেখ মুজিব বললেন, আমি পাঠালে দেরি করবে (স্বীকৃতি দিতে)? ১৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লি হয়ে মস্কো গেলাম। ১৫ ডিগ্রি মাইনাস তাপমাত্রা। সোভিয়েত কূটনীতিকেরা আমাকে কিছু বলতেই দিলেন না। বঙ্গবন্ধুর সফরের কথা শুনে খুব খাতির করলেন। প্রতিটি দপ্তরে শীর্ষ ব্যক্তি কথা বললেন। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি পরিচয়পত্র গ্রহণ করলেন। মস্কো তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। লেখা হলো অ্যাম্বাসেডর ডেজিগনেট।
সোহরাব হাসান: বঙ্গবন্ধু মস্কো গেলেন কবে?
শামসুর রহমান খান: বঙ্গবন্ধু মস্কো গেলেন ১৯৭২ সালের ১ মার্চ। সেখানে তিনি ব্যাপক সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের নেতার প্রতি সোভিয়েত জনগণেরও আগ্রহ ছিল।
সোহরাব হাসান: মস্কো থেকে তো আপনি দিল্লিতে এলেন।
শামসুর রহমান খান: সেটা অনেক পরে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে। মস্কো থাকতে আমি মাঝেমধ্যে দেশে আসতাম। বঙ্গবন্ধু বলতেন, মস্কোর খবর দেবা। বাংলাদেশের অবস্থা নিয়েও আলোচনা হতো। দিল্লি যাওয়ার মাসখানেক আগে বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করে বললেন, ‘তোমার বিরহ তো আমার সহ্য হচ্ছে না। অনেক দূরে পড়ে আছো। এবার কাছে আসো।’ আমি বললাম, আমাকে নিয়ে অন্য মতলব আছে কি? তিনি বললেন, না, কোনো মতলব নেই। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বার্তা গেল, প্লিজ, কাম টু ঢাকা বিফোর দিল্লি। আমাকে আরও বলা হলো, আপনি আসার সময় মালপত্র দিল্লিতে রেখে আসবেন। ঢাকায় দেখা করে যাবেন। বিমানবন্দর থেকেই খবর পেলাম, আমাকে গণভবনে ডাকা হয়েছে। ঢুকতেই দরজার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন, দিল্লি যাচ্ছ। আমি বললাম, ‘বন্ধুদেশ, অসুবিধা কী?’ তিনি বললেন, ‘গেলেই বুঝবা।’ তিনি ভারতের বন্ধু ছিলেন, অনুগত নন।
সোহরাব হাসান: ভারতে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
শামসুর রহমান খান: আমি ভারতে গেলাম ১৯৭৫ সালের আগস্টে। ১৫ আগস্ট ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। সরকার ইন্ডিয়া গেটে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রাষ্ট্রদূতদের কয়েকটি সারি ছিল। আমি শেষ সারিতে গিয়ে বসি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্যতিক্রমীভাবে ২৫-৩০ মিনিট দেরি করে এলেন । এটা আগে কখনো হয়নি। কারণটি পড়ে বুঝতে পারলাম। তাঁর চেহারায় চিন্তার ছাপ লক্ষ্য করলাম। টিভিতে ২০ কোটি লোক এই অনুষ্ঠান দেখেছে। বক্তৃতা শেষ করে সোজা নিচে নেমে গেলেন। কারও সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমরাও নামলাম।
বাসায় এসে দারোয়ানের কাছে শুনলাম আতাউস সামাদ ফোন করেছেন। তিনি তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস)দিল্লি প্রতিনিধি। তাঁকে ফোন করতেই বললেন, খবর জানেন কি, বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে? মোশতাক আহমদ নতুন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। শেখ সাহেবের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘সকালে উঠে আমার প্রথম কাজ ছিল পিটিআই অফিসে যাওয়া। সেখানেই শিলং রেডিওতে খবরটি শুনলাম।’ এরপর আমি অপারেটরকে অন্যান্য কর্মকর্তাকে আসার জন্য খবর দিতে বললাম। আতাউল করিমকে খবর দেওয়া হলো। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঞ্জুর ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম( অধ্যাপক) ছিলেন। কামরুল হুদা ছিলেন। তাঁরা সবাই এলেন। রেডিও অস্ট্রেলিয়া শুনে একজন বললেন, আরও খবর আছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। জার্মানিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বললাম। তাঁর দিল্লি আসার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর শুনে আর এলেন না। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ফিরে গেলেন। ব্যথিত হলাম বন্ধু শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবর শুনে।
১০ দিন পর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি বললেন, হোয়াট ইজ ডান ইন বাংলাদেশ। এরপর মন্তব্য করলেন, ‘হত্যা করে ক্ষমতা দখলকে আমরা মানতে পারি না।’
সোহরাব হাসান: বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
শামসুর রহমান খান: তিনি আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। এ কারণে তাঁর প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব থাকবেই। আমি তাঁর কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছি, কম লোকই তা পেয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসক হিসেবে তিনি কী রকম ছিলেন, সেটা এখানে বিবেচ্য নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত ভা্লোবাসার কথা কখনো ভুলতে পারব না। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর এক অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে দুটি বাদে সব আসন পেল। আমাকে দেখে শেখ মুজিব বললেন, ‘কী মিয়া, তুমি কি আমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছ? আমি জবাব দেওয়ার আগেই তিনি জানান, ‘আমি ডায়েরি রাখি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসার পর ১১ বার আমাদের দেখা হয়েছে। আমার বাসায় চারবার, তোমার বাসায় সাতবার। অর্থাৎ আমি সাতবার গিযেছি, তুমি চারবার।’ আমি বললাম, ‘তোমার স্বার্থ ছিল। তুমি চেয়েছিলে আমি আওয়ামী লীগে যোগ দিই। তিনি বললেন, ‘তা-ও তো আসলা না।’
সোহরাব হাসান: স্বাধীনতার পরের কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি যা আপনাকে এখনো আলোড়িত করে?
শামসুর রহমান খান: দুবার দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এসেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও মনসুর আলী। তাজউদ্দীন আহমদ কী বলেছিলেন মনে নেই। তবে মনসুর আলীর কথাটি এখনো আমার কানে বাজে। তিনি বললেন, ‘আপনি এসেছেন, ‘ভালো করেছেন। ওনাকে (বঙ্গবন্ধু) দু-একটা কথা বলবেন। আমাদের অসুবিধা হলো দলের লোক। আপনি পারেন, সাউন্ড ব্যাক করতে। বঙ্গবন্ধু আপনাকে ভুল বুঝবেন না।’ আমি যা সত্য মনে করতাম বঙ্গবন্ধুকে বলতাম। তিনিও বুঝতেন। মনসুর আলী খুব ভুল বলেননি। আমিও দেখেছি, কোনো কোনো বিষয়ে মাঝেমধ্যে পরামর্শ চাইতেন তিনি। কখনো আমি নিজে থেকেও বলতাম। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেই আমি সেটা বলতে পারতাম।