প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর শেষ হয়েছে। সেখানে তিনি বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। আপনি এই সফরকে কীভাবে দেখছেন?
এম হুমায়ুন কবীর: অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে চীন স্বাগত জানিয়ে গত বছরের আগস্ট থেকে সরকারের গৃহীত সংস্কার কর্মসূচি ও অগ্রগতির প্রশংসা করেছে। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানেও আগ্রহ দেখিয়েছে। উভয় পক্ষ পুরো কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব আরও সুসংহত ও গভীর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যেহেতু আমাদের সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের এটি প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর, সেহেতু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশি উচ্ছ্বাস ছিল। এ সফরের দু-তিনটি মাত্রা ছিল। প্রথমত, মুহাম্মদ ইউনূস বোয়াও সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এরপর তিনি বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঋণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের আগ্রহ ছিল চীন থেকে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কী কী সুবিধা পাওয়া যায়।
সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন?
এম হুমায়ুন কবীর: প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকালে একটি চুক্তি ও আটটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। চীন ২১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণ-অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চীনের প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এগুলো ইতিবাচক। কিন্তু আমার ধারণা, বাংলাদেশের প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল।
ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ক্ষেত্রে কী অগ্রগতি হয়েছে?
এম হুমায়ুন কবীর: পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক কীভাবে প্রসারিত করা যায়, সেটা অবশ্যই আমাদের অগ্রাধিকারে ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করি। আমাদের উদ্বেগের কারণ এই নদীকে কেন্দ্র করে চীনের অনেক প্রকল্প আছে। ব্রহ্মপুত্রের উৎসস্থল চীন। উৎসস্থল থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে এ নদীর পানি প্রবাহিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনায় ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়টি গুরত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হলো চীন ও ভারতকে একসঙ্গে বসানো যাবে কি না। ব্রহ্মপুত্রে চীন প্রকল্প করলে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে। কিন্তু আমরা যখন অভিন্ন নদীতে ভারতের বাঁধ বা প্রকল্পে উদ্বেগ প্রকাশ করি, সেটি আমলে নেওয়া হয় না।
তিস্তা পানি প্রকল্প নিয়ে বহু বছর ধরেই আলোচনা হয়ে আসছিল। এ ক্ষেত্রে কি কোনো অগ্রগতি হয়েছে?
এম হুমায়ুন কবীর: খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৫০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। তারা এটা আমলে নিয়েছে, কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তিস্তার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেমন চীনের অর্থ দরকার, তেমনি ভারতের সম্মতি ও সহযোগিতারও প্রয়োজন। ভারত পানি দেওয়া বন্ধ করে দিলে কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন করা যাবে না।
বাংলাদেশের মাথাব্যথার বড় কারণ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান। সাত বছর ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করায় আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অভিঘাত তৈরির পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র ও মাদকেরও বিস্তার ঘটছে তাদের মাধ্যমে। এসব আমাদের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি তৈরি করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কোনো অগ্রগতি দেখছেন কি?
এম হুমায়ুন কবীর: এখানে নতুন কিছু দেখিনি। যৌথ ঘোষণায় চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। এর অর্থ তারা আগের অবস্থানেই আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চীনের সহায়তায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও হয়েছিল। কিন্তু একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেওয়া হয়নি।
প্রধান উপদেষ্টা আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগদানের ব্যাপারে আগ্রহের কথা জোরেশোরে বলেছেন। এর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আছে বলে মনে করেন?
এম হুমায়ুন কবীর: ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা তো আছেই। নাফ নদী পার হলেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আমি মনে করি, বাংলাদেশের আসিয়ান জোটে যোগদান অসম্ভব নয়। আর প্রধান উপদেষ্টা কেবল আসিয়ানে যোগদানের কথা বলেননি। একই সঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা—সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার কথাও বলেছেন। তবে এ মুহূর্তে আসিয়ান যে অবস্থায় আছে, নতুন সদস্য নেওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার বিভিন্ন কাঠামো বিদ্যমান। বাংলাদেশ সেগুলো ব্যবহারের কথা ভাবতে পারে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামের সদস্য আছে ২০০৪ সাল থেকে। অতএব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল।
বর্তমানে চীনের সঙ্গে আসিয়ান জোটের সম্পর্ক কেমন?
এম হুমায়ুন কবীর: চীনের সঙ্গে আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ক অনেক ভালো। ২০০১ সালে আসিয়ান জোটের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য ছিল ৫৭ বিলিয়ন ডলারের। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৭৪৭ বিলিয়ন ডলারে। অবশ্য এ সময়ে অন্যান্য অঞ্চল ও দেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যও অনেক বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে আসিয়ানে বাংলাদেশ যুক্ত হলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
কয়েক দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা বিমসটেকের সম্মেলনে যোগ দিতে ব্যাংকক যাচ্ছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সেই সম্মেলনে থাকবেন। ঢাকা চেয়েছিল সেখানে মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠক হোক। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে এখনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এম হুমায়ুন কবীর: ভারতের এ অবস্থান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের সহায়ক নয়। আসলে ৫ আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়টি ভারতের নীতিনির্ধারকেরা মন থেকে মানতে পারেননি। একদিকে তাঁরা বলছেন অংশীদারত্বের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চান। অন্যদিকে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকের জন্য বারবার আহ্বান জানানো হলেও তারা সাড়া দিচ্ছে না। ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, আমাদের যেমন তাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে, তেমনি ভারত সরকারকেও বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে হবে। দুই দেশের সম্পর্ক ভালো হলে দুই দেশের জনগণই তা থেকে লাভবান হবে। বাংলাদেশ সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব চায়। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের যদি কোনো বিষয়ে উদ্বেগ থাকে, তার সমাধানও আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে।
জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারে মানবিক করিডর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বোয়াও সম্মেলনে এ ব্যাপারে এশীয় নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
এম হুমায়ুন কবীর: আমি মনে করি, এটা ভালো প্রস্তাব। এখানে যেমন রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে, তেমনি মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গারাও কঠিন অবস্থার মধ্যে আছে। তারা নিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশের ভেতরে থাকা কিংবা বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য এ রকম একটা করিডর খুবই জরুরি।
মিয়ানমারে এখন যুদ্ধাবস্থা চলছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সেখানে এ রকম একটি মানবিক করিডর তৈরি সম্ভব কি?
এম হুমায়ুন কবীর: আমি মনে করি, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের চারটি পক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। জাতিসংঘ, মিয়ানমার সরকার, আরাকান আর্মি ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এখনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানানো হয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে তাঁদের সব ধরনের সহযোগিতার কথাও বলেছেন। প্রশ্ন হলো মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি রাজি হবে কি না। রাখাইন প্রদেশের বেশির ভাগ এখন আরাকান আর্মির দখলে। সে ক্ষেত্রে যেকোনো সমাধানসূত্রে তাদেরও সম্মতি দরকার হবে। দুই দিন আগে মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে, যাতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। মিয়ানমারের ধ্বংসযজ্ঞ এতটা ভয়াবহ যে মিয়ানমার সরকার এটা সামাল দিতে পারবে না। এ কারণে তারা সারা বিশ্বের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সাধ্যমতো সহায়তা দেওয়া। এ ধরনের উদ্যোগ মিয়ানমার সরকারের অবস্থান পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
এম হুমায়ুন কবীর: আপনাকেও ধন্যবাদ।