রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধানের নানা সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আপনারা আন্দোলন করে আসছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে চলে এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাথমিকভাবে সংস্কারের জন্য যে ছয়টি কমিশন করেছে, তার মধ্যে অন্যতম সংবিধান সংস্কার কমিশন। এ উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?
হাসনাত কাইয়ুম: হ্যাঁ, আমরা অনেক আগে থেকেই সংবিধান এবং রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে কাজ করছিলাম। আমরা যখন ’৭২-এর সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিকতা নিয়ে কথা বলছিলাম, সেটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সময়। তখন ‘প্রগতিশীলদের’ অনেকে ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছিল। তা ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭(ক) যুক্ত করে সংবিধানবিষয়ক আলোচনাকেই একটা ভয়ংকর বিষয়ে পরিণত করা হয়েছিল।
এসব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে আমরা বাংলাদেশের সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর সংস্কার এবং রাষ্ট্রের লুটপাট-পাচার ও দমনমূলক চরিত্র বদলের জন্য যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম, ক্রমে তা গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন এই দাবি বাস্তবায়নের পর্যায়ে আছে। আমরা এসব কমিশন গঠনকে জনগণের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের অর্জন হিসেবেই দেখছি।
কেউ সংবিধান বাতিলের কথা বলছেন, কেউ সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন, কেউ আবার বাহাত্তরের সংবিধানকে পবিত্র জ্ঞান করছেন। সংবিধান নিয়ে চলমান বিতর্কে আপনার বা আপনাদের অবস্থান কী?
হাসনাত কাইয়ুম: আমাদের অবস্থান বলার আগে এটা বলে নেওয়া ভালো, আমরা এ বিষয়গুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেখছি। একটা হচ্ছে চাওয়া বা আকাঙ্ক্ষা। আরেকটা হচ্ছে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যতটুকু সম্ভব সেটা বিবেচনায় রেখে, এখনই ততটুকু বাস্তবায়নে জোর দেওয়া। আমাদের আকাঙ্ক্ষা তো গণক্ষমতাতন্ত্র, সেভাবে আমরা একটা গণক্ষমতাতান্ত্রিক সংবিধান চাই। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের দাবি ছিল সংবিধানে স্বৈরতন্ত্রের যে ‘প্রাণভোমরা’ আছে, তাকে সরিয়ে ফেলা, যাতে ভবিষ্যতে সংবিধানকে ব্যবহার করে কেউ স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠতে না পারে।
আমরা বহু আগে থেকে ’৭২-এর সংবিধান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি স্বৈরতন্ত্রের প্রাণভোমরা হলো, সংবিধানের জবাবদিহিহীন এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো। এ মুহূর্তে আমরা প্রধানত এই ক্ষমতাকাঠামো অংশটার পরিবর্তন সহজ এবং সম্ভব বলে মনে করছি, তাই এটুকুই চাইছি।
এটা ব্যাপক এবং মৌলিক ধরনের পরিবর্তন, যা সংবিধান সংশোধনের প্রচলিত ধারণার চেয়ে অনেক বিস্তৃত; কিন্তু বিদ্যমান সবকিছু বাতিল করে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি করা নয়। আমরা ক্ষমতাকাঠামোর এ মৌলিক পরিবর্তনটাকেই সংস্কার বলছি।
আপনার বিবেচনায় বাংলাদেশের সংবিধানের মূল সমস্যাগুলো কী কী?
হাসনাত কাইয়ুম: সমস্যা অনেক। সাংবিধানিকভাবেই নির্বাচনের মাধ্যমে বা শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা বদলের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা এক পদে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে এবং সেই পদধারীকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য নেই। আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য রাখা হয়নি। রাষ্ট্রপতি ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছার অধীন।
অর্থনৈতিক লেনদেন ও রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসেবে স্বচ্ছতার ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় সরকারের বদলে স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তির আগে আলোচনার বাধ্যবাধকতা নেই। অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি নেই। তাদের সংস্কৃতি এবং মালিকানারীতিকে খর্ব করা হয়েছে। মৌলিক অধিকারগুলোকে প্রচলিত আইন ও নানা শর্তের অধীনে বন্দী করে নাগরিকদের অধিকারহীন প্রজায় পরিণত করা হয়েছে ইত্যাদি।
সংবিধানের এই সমস্যাগুলো আমাদের রাজনীতি, প্রশাসন, সরকারব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনায় কী কী সমস্যা তৈরি করেছে?
হাসনাত কাইয়ুম: সংবিধানের এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের রাষ্ট্রকে স্বাধীন দেশের নাগরিকের উপযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে ক্রমাগত বাধা দিয়ে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ পথে সরকার বদলের ব্যবস্থা না থাকায় হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত তথা বলপ্রয়োগের দক্ষতাকেই ‘রাজনীতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জনগণকে সেবার বদলে দমন-পীড়ন-লুণ্ঠন এবং বঞ্চিত করার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনকে বলা হয় ‘প্রশাসন’।
নাগরিকদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থ এবং শক্তি ব্যবহার করে, নাগরিকদের স্বাধীনতা, সম্পদ এবং মর্যাদা হরণ করার ‘বৈধ’ কর্তৃত্বকেই ‘সরকার’ হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে। জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত সম্পদ বিদেশে পাচার করাকেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল উদ্দেশ্যে পরিণত করা হয়েছে। এককথায় এই সংবিধান স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকের বদলে জনগণকে প্রজার চেয়ে নিকৃষ্ট স্তরে অবনমিত করেছে।
সংবিধান সংস্কারে যে কমিশন হয়েছে, তারা কীভাবে কাজটি শুরু করতে পারে? কোন প্রক্রিয়ায় এগোলে কাজটি সহজ হবে বলে মনে করেন?
হাসনাত কাইয়ুম: কমিশন সবচেয়ে সহজে এই কাজ করতে পারে, নিজেরা কোনো মত না দিয়ে সবার মতামত সংগ্রহ করার মাধ্যমে। রাজনৈতিক দল, অদলীয় সংগঠন, শ্রেণি, পেশা, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, অঞ্চলভেদে যত ধরনের সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা সংবিধানের কী ধরনের পরিবর্তন চায়, সে মতামত কমিশন সংগ্রহ করতে পারে। সংগৃহীত মতামত থেকে ন্যূনতম ঐকমত্য আছে, এমন পরামর্শগুলোকে এক ভাগে এবং অন্য পরামর্শগুলোকে অন্য ভাগে সংকলিত করতে পারে।
আমাদের চাওয়া হলো ঐকমত্য আছে, এমন পয়েন্টগুলোকে আপাতত ‘সংস্কারের রূপরেখা’ হিসেবে গ্রহণ করা। এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে, সে পদ্ধতি বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির উদ্যোগ নিতে পারে কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করবে ও তাদের পরামর্শ নেবে। আপনাদের কাছে যদি পরামর্শ চাওয়া হয় আপনারা মূল কোন কোন বিষয়ে পরিবর্তনের সুপারিশ করবেন?
হাসনাত কাইয়ুম: আমরা নির্বাচন ও ভোটব্যবস্থা, আইনসভা বা সংসদ, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং মৌলিক অধিকার—এই সাতটি ক্ষেত্র, যাকে আমরা সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোর প্রধান প্রধান ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করেছি, সেগুলোর সংস্কার প্রস্তাব আগেই দিয়েছি। আমরা এই সাতটি ক্ষেত্রের বিভিন্ন দিককে আরও বিস্তৃত ও সুনির্দিষ্ট আকারে তুলে ধরব।
সংবিধানের ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ নিজ অবস্থান রয়েছে। নীতিগত ক্ষেত্রেও দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের ক্ষেত্রে বিষয়টি কতটা সমস্যা তৈরি করবে বলে আপনি মনে করেন?
হাসনাত কাইয়ুম: আমাদের সংবিধান মোটাদাগে দুই অংশে বিভক্ত; একটা নীতি বা আদর্শগত অংশ, আরেকটা প্রায়োগিক বা ক্ষমতাকাঠামোগত অংশ। আমাদের সংবিধানের নীতিগত বা আদর্শগত অংশটার প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক প্রযোজ্যতা নেই। কিন্তু সংবিধান প্রশ্নে আমাদের যত তর্কবিতর্ক তার সিংহভাগ এই অংশটা নিয়েই।
আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যেহেতু মতাদর্শনির্ভর, তাই তারা সংবিধানে নিজেদের দলীয় মতাদর্শের প্রতিফলন দেখতে চায় এবং স্বাভাবিকভাবেই এখানেই তাদের প্রধান মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে। সংবিধানের ব্যবহারিক বা ফাংশনাল দিকটা নিয়ে আমাদের আলোচনা বা তর্কবিতর্ক প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। কিন্তু নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় দুর্ভোগ থেকে মুক্ত এবং তাদের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংবিধানের এই ব্যবহারিক অংশটার প্রতি অধিক মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকার গঠনের বেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য হলেও সংবিধানের পরিবর্তনে প্রয়োজন হয় ব্যাপক বা অধিকাংশ জনগণের ঐক্য। ঐক্য যত দৃঢ় এবং ব্যাপক হবে সংবিধান সংস্কার কিংবা পুনর্লিখন তত সহজ এবং টেকসই হবে।
যদি আমরা এ দিক সম্পর্কে সতর্ক থাকি এবং প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের ভোগান্তির যে অভিজ্ঞতা আছে, যেসব বিষয়ের সমাধানে যদি মনোযোগ দিই, তাহলে ঐকমত্যের পথ বের করাটা সহজ হবে। এদিকে মনোযোগ দিলে সমস্যাটা কমতে পারে, অন্যথায় আমাদের ঐক্য ভেঙে পড়তে পারে।
ধরুন, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে কমিশন সংবিধানের একটি প্রস্তাবিত খসড়া অন্তর্বর্তী সরকারে কাছে পেশ করল, এর পরের প্রক্রিয়া কী হবে? খসড়া নিয়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকে, তা নিরসনের পথ কী?
হাসনাত কাইয়ুম: কমিশনের কাজের ধরন এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি। তাই আমরা জানি না কমিশন কী করবে। যদি আপনার কথামতো ধরে নিই যে তারা একটি খসড়া প্রস্তাব করবে এবং এটাও যদি ধরে নেই যে খসড়া নিয়ে মতভেদ থাকবে, তবে তা নিরসন করা কঠিন হবে, যা একটি সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাই কমিশনের এমন কোনো খসড়া প্রস্তাব করা উচিত হবে না। তাদের উচিত হবে সবার সঙ্গে আলাপ করে, আগে ন্যূনতম ঐকমত্যের বিষয়গুলো বের করে আনা এবং সংস্কার প্রস্তাব বা খসড়া সেই ঐকমত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।
সংবিধানের খসড়াটি নিয়ে আলোচনা বা তা অনুমোদনের পথ কী? একটি সংবিধান সভা নির্বাচন করে সেখানে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া ভালো হবে নাকি খসড়ার ওপর গণভোট হবে? এ নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী?
হাসনাত কাইয়ুম: সংবিধান সংস্কারের রূপরেখা এবং কমিশনের কাছে প্রত্যাশা নিয়ে আমি আগেও কিছুটা বলেছি। আমরা মনে করি, কমিশনের কাজ হলো সবার মতামত সংগ্রহ করে তার থেকে ‘ন্যূনতম ঐকমত্য’ চিহ্নিত করা এবং এটাকে ‘সংস্কারের রূপরেখা’ হিসেবে উত্থাপন করা। আর অন্য প্রস্তাবগুলোকে আকাঙ্ক্ষা হিসেবে লিপিবদ্ধ রাখা।
সরকারসহ সবার উচিত হবে ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত রূপরেখা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সীমিত সময়ের জন্য ‘সংস্কার সভা’র একটা নির্বাচন করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংস্কার সম্পন্ন করা। এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে বলে আমরা মনে করি। গণভোটও একটি পদ্ধতি হতে পারে, কিন্তু তাতে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি থেকে যাবে।
সংবিধান পুনর্লিখন হোক বা সংস্কার হোক—ভবিষ্যতে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনো ঝুঁকি আছে কি? এই ঝুঁকি এড়ানোর পথ কী?
হাসনাত কাইয়ুম: সংবিধান যেহেতু একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল এবং রাজনীতি যেহেতু একটি চলমান ও পরিবর্তনশীল বিষয়, সেহেতু বড় কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলে বৈধতার প্রশ্ন ওঠাটা অসম্ভব নয়। বৈধতার ঝুঁকি দুই প্রকার হতে পারে। একটি পদ্ধতিগত ত্রুটি, আরেকটি রাজনৈতিক।
পদ্ধতিগত ঝুঁকি এড়ানোর সর্বোত্তম পথ হলো ‘সংস্কার সভা’র নির্বাচন করে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করা। শেষ বিচারে জনগণের অভিপ্রায়ই হলো বৈধতার উৎস। আর জনগণের অভিপ্রায় প্রকাশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলো নির্বাচন। সংবিধান পুনর্লিখনই হোক আর সংস্কারই হোক, ঝুঁকি এড়াতে হলে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে ব্যবহার করাই উত্তম।