সাক্ষাৎকার

পাহাড়িরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা চায়, আমরা কোনো সময় বিচ্ছিন্নতার কথা বলিনি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি, আঞ্চলিক রাজনীতি, পাহাড়ের নিরাপত্তা—এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন পাহাড়ের আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রথম আলো:

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, তাকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কীভাবে দেখছে?  

কে এস মং: পাহাড়ি জনগণ অবশ্যই ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তাই এই সরকারকে অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে পাহাড়ের জনগোষ্ঠী আশা করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রথম আলো:

নতুন সরকার আসার পর হঠাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে। এই সহিংসতাকে কীভাবে দেখেন? এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে বলে আপনারা মনে করেন কি?

কে এস মং: একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও হতাশা ছাত্র-জনতার মধ্যে আছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যাতে যথাযথ বাস্তবায়িত হতে না পারে, এর জন্য আগে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী গোষ্ঠী নানান ষড়যন্ত্র করে আসছে। ফলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে পার্বত্য জনগণ মনে করে।

চুক্তি সম্পাদনের পর থেকেই একে ব্যর্থ করে দিতে একটি মহল সচেষ্ট ছিল। বিগত সময়গুলোতে তারা তাদের তৎপরতা থামায়নি। এসব গোষ্ঠী পাহাড়ি মানুষের সমর্থন কখনোই পায়নি। শুধু তারা বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এসব গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মহলের আশীর্বাদ বা সমর্থন ছিল। এখনো সে সমর্থন প্রত্যাহার হয়েছে তা বলা যায় না।

ওই বিশেষ গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য পাহাড়িদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। ভাগ করো, শাসন করো নীতিতে তারা বিশ্বাস করে। তবে তারা তাদের তৎপরতায় সফল হতে পারেনি। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পাহাড়ে শান্তির পরিবেশ নষ্ট করা। পাহাড়িদের স্বার্থবিরোধী গোষ্ঠী এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী পাহাড়কে অশান্ত করার পাঁয়তারা করছে। পাহাড়ের জনগণ তাদের প্রকৃত বন্ধুদের চেনে।

প্রথম আলো:

পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধের পাশাপাশি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক দলগুলোর অন্তঃকোন্দল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এটা নিরসন করা যাচ্ছে না কেন? আপনারা কেন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছেন না?  

কে এস মং: তথাকথিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল যারা জনগণের প্রয়োজন বা আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্টি হয়নি, বরং বিশেষ মহলের দ্বারা বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ওই ভুঁইফোড় দলগুলো থাকার কথা নয়। সেই সময়ে পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

শুধু পাহাড়ের জনগণ নয়, সমগ্র দেশের প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রমনা মানুষেরাও পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চেয়েছে। সুতরাং আমরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ আছি। এ ক্ষেত্রে পাহাড়ের জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছে না— প্রশ্নটি অবান্তর।

প্রথম আলো:

বর্তমান সরকার নানা ক্ষেত্রে সংস্কার ও একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এর সুফল পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কীভাবে পেতে পারে? 

কে এস মং: পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বরাবরই অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বলে আসছে। আমরা কোনো সময় বিচ্ছিন্নতার কথা বলিনি, দাবিও করিনি।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার নানা ক্ষেত্রে সংস্কার ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, এটি একটি ইতিবাচক দিক বলে পাহাড়ের জনগণ অবশ্যই মনে করে। পাহাড়ের জনগোষ্ঠীরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব করতে পারলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এর সুফল পাবে। 

প্রথম আলো:

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার মৌলিক কী কী উদ্যোগ নিতে পারে? এই সরকারের কাছে আপনাদের চাওয়া কী? 

কে এস মং: পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক গঠিত পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ক্ষমতায়ন করা।

এ লক্ষ্যে স্থায়ী বাসিন্দা নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ অহস্তান্তরিত বিষয়গুলো হস্তান্তর করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন করা, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুন্ম উদ্বাস্তুদের জায়গাজমি প্রত্যর্পণ পূর্বক যথাযথ পুনর্বাসন প্রদান করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যাননিযুক্ত করণ ও বিধিমালা দ্রুত প্রণয়ন করা ইত্যাদি। এ ছাড়া পাহাড়ের জনগণের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি করা হয়েছে, সেটি দূর করার জন্য সরকার কর্তৃক দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।