বিশেষ সাক্ষাৎকার: মোহাম্মদ আবু হেনা

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইন আছে, প্রয়োগ হয় খণ্ডিত, এভাবে চলতে পারে না

মোহাম্মদ আবু হেনা। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি সরকারের সচিব ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, যাদের লক্ষ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সম্প্রতি নতুন নির্বাচন কমিশনও গঠিত হয়েছে। মোহাম্মদ আবু হেনা প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন, রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্র নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো:

প্রথম আলো: নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন গঠিত হয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন মহল থেকে সুপারিশ আসছে। আগামী নির্বাচনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী?

মোহাম্মদ আবু হেনা: আমি সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি অনেক দিন আগে। এরপর যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, আমি বাইরে থেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য কাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনটি গঠিত হলো, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান কমিশন গঠিত হলো আগের সরকারের প্রণীত আইনের ভিত্তিতে। আমি মনে করি, এটি পর্যাপ্ত নয়। আইনে ব্যক্তির বয়সের কথা বলা আছে, পদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কমিশনে যাঁরা আসবেন, তাঁদের তিনটি গুণ থাকতে হবে—সততা, ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও অঙ্গীকার।  কমিশনে যাঁরা আসবেন, তাঁদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি থাকা বাঞ্ছনীয়— যাঁদের ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারবে। 

প্রথম আলো:

কিন্তু কেবল নির্বাচন কমিশন দক্ষ হলেই কি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন?

মোহাম্মদ আবু হেনা: কমিশন একা তো নির্বাচন করতে পারবে না। এ জন্য প্রশাসনের পদাধিকারী যথাক্রমে ডিসি–এসপিসহ যাঁরা নির্বাচনী কাজে যুক্ত থাকবেন, তাঁদের প্রতি কমিশনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। একই সঙ্গে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একটি আইন করেছিলেন, যাতে নির্বাচনী কাজে যুক্ত কর্মকর্তারা অনিয়ম করলে কিংবা অর্পিত দায়িত্ব পালন না করলে তাঁদের শাস্তির আওতায় আনার কথা আছে। কমিশন তাঁদের সাসপেন্ড করতে পারবে। আইনে দুই মাস সাসপেন্ড রাখার কথা আছে। আমি মনে করি, এটা অনির্দিষ্ট হওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে আরও বেশি সময় সাসপেন্ড করা প্রয়োজন, সেই বিধানও থাকা প্রয়োজন। এতে কর্মকর্তারা ভয় পাবেন। 

প্রথম আলো:

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন? 

মোহাম্মদ আবু হেনা: আরপিওতে আছে, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট অনুষ্ঠানের পরবর্তী ১৫ দিন কমিশনের অধীনে থাকবেন। এটা ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন। অভিযোগের তদন্তকাজ ১৫ দিনে শেষ না–ও হতে পারে। আরেকটি হলো কর্মকর্তাদের সুরক্ষা। রাজনৈতিক সরকার এসে যাতে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারে, হয়রানি করতে না পারে, সে জন্যও সময়টা বাড়ানো দরকার। ছয় মাস সময়টা এ জন্য বলেছি যে এ ধরনের হয়রানি নতুন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে করে থাকে। আইনে আরও একটি বিষয় সংযুক্ত করা দরকার যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এসিআর লেখার ক্ষমতাও কমিশনকে দিতে হবে, যত দিন তাঁরা কমিশনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। 

প্রথম আলো:

নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে অনেক আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ হয় না। 

মোহাম্মদ আবু হেনা: আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঘাটতি আগেও দেখেছি। এখনো আছে। অনেক সময় আইনের খণ্ডিত প্রয়োগ দেখা যায়। কারও বিরুদ্ধে প্রয়োগ হলো, কারও বিরুদ্ধে হলো না। এই অনিয়ম চলতে পারে না। সবার বিরুদ্ধে সমানভাবে আইনের প্রয়োগ হতে হবে। আইনের প্রয়োগ হতে হবে সর্বজনীন। 

প্রথম আলো:

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেটা এড়াতে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন।

মোহাম্মদ আবু হেনা: বিচার বিভাগ থেকে লোক আনা যেতে পারে। এমনকি বেসরকারি খাত থেকে আনা যেতে পারে। আসলে তিনি কোথায় কাজ করছেন, সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হলো তিনি দক্ষ ও সৎ কি না। নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন কি না। কমিশন যদি মনে করে, নির্বাচনী দায়িত্বে প্রশাসনের বাইরে থেকে যে কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে পারে।

প্রথম আলো:

প্রতিবারই নির্বাচনের ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা হওয়ার পরও এর অবসান হয়নি।

মোহাম্মদ আবু হেনা: যাঁদের ভোট দেওয়ার বয়স হয়েছে, তাঁদের সবাইকে ভোটার তালিকাভুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে ভোটারদের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। বিশেষ করে নারী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন এবং ভোট দিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ কারণে নির্বাচনের আগেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি দায়িত্বে থাকতে একটি উপনির্বাচনে অভিযোগ পেলাম যে অনেক কেন্দ্র থেকে ভোটারদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেককে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। আমি বিষয়টি তদন্ত করে চারজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সাসপেন্ড করেছিলাম। আইনে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার দায়ে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু আইনটি প্রয়োগ তো করতে হবে। 

প্রথম আলো:

সেই উপনির্বাচনটি তো টাঙ্গাইলের একটি আসনের। সেখানে সরকারি দলের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের আবদুল কাদের সিদ্দিকী। সেই নির্বাচনের ফলাফলও তো স্থগিত করেছিলেন।

মোহাম্মদ আবু হেনা: নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগে আমি ফলাফল প্রকাশ স্থগিত রেখেছিলাম। আমি পদত্যাগ করে বিদেশে চলে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সিইসি গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন। এ কারণেও আমি আইনের প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি।  

প্রথম আলো:

আগামী নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। আশা করা যায়, নির্বাচন কমিশন তাদের কাছ থেকে সার্বিক সহযোগিতা পাবে। কিন্তু নির্বাচনের অন্যতম অংশীজন রাজনৈতিক দল ও  প্রার্থীদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?

মোহাম্মদ আবু হেনা: প্রত্যেক প্রার্থী যাতে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলেন, সে জন্য আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থী মনোনয়ন হতে হবে স্থানীয়ভাবে। সে ক্ষেত্রে তিনি স্থানীয় কমিটি, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কথা শুনবেন। আর যদি ওপর থেকে প্রার্থী মনোনয়ন হয়, তিনি কাউকে পাত্তা দেবেন না।

প্রথম আলো:

প্রার্থীদের হলফনামায় অনেক সময় তথ্য লুকানো হয়। এর প্রতিকার কী? 

মোহাম্মদ আবু হেনা: বর্তমানে প্রার্থীদের হলফনামায় আটটি তথ্য দিতে হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা, মামলা, সম্পদ ইত্যাদির বিবরণ নেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা কর শনাক্তকরণ বা টিআই নম্বর দেন না। টিআই নম্বর থাকলে প্রার্থীর সম্পদের বিবরণে কোনো অসংগতি থাকলে সহজে জানা যাবে। হলফনামায় তিনি কোনো  তথ্য লুকিয়েছেন কি না, সেটাও ধরা পড়বে। প্রার্থী আয়কর দেন কি না কিংবা কত টাকা আয়কর দেন, সেটাও ভোটারদের জানা দরকার। আরেকটি বিষয় হলো প্রার্থী ঋণখেলাপি কি না। আগে ঋণখেলাপিরা প্রার্থী হতে পারতেন না। প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যেত। এখন তাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে কিছু টাকা জমা দিয়ে পুনঃ তফসিল করিয়ে নেন। আমি মনে করি, অন্তত তফসিল ঘোষণার ছয় মাস আগে ঋণখেলাপি থাকলেও তাঁকে প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত। 

প্রথম আলো:

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা প্রতিপক্ষের নির্বাচনী সমাবেশে হামলা করে থাকেন, নির্বাচনী স্থাপনা ভেঙে ফেলেন। এগুলো ঠেকানোর
উপায় কী?

মোহাম্মদ আবু হেনা: আইন ও আচরণবিধি শতভাগ কার্যকর করতে হবে। কেউ আইন অমান্য করলে তঁার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আচরণবিধি নিয়ে আমাদের সময়ে আইন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে সেটা আরও উন্নত করা হয়েছে। যদি কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আছে। কিন্তু সমস্যা হলো আইনের প্রয়োগের। এ ক্ষেত্রে কেউ যাতে ছাড় না পান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রার্থিতা বাতিল করতে হবে। শুধু জরিমানা করলে হবে না। প্রতিটি আসনে নির্বাচনী তদন্ত কমিটি আছে, তাদের কাজ এটি। কমিটিতে অন্যদের মধ্যে বিচার বিভাগের কর্মকর্তাও থাকেন। কমিটির দায়িত্ব তথ্যপ্রমাণসহ নির্বাচন কমিশনের কাছে সুপারিশ পাঠানো। অনেক সময় প্রার্থীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত নির্বাচনের আগে নিষ্পত্তি করা যায় না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের পরও কমিশন তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। 

প্রথম আলো:

হলফনামা চালু হওয়ার পরও তো নির্বাচনে অনিয়ম ও প্রার্থীদের অনাচার বন্ধ হয়নি। এর প্রতিকার কী?

মোহাম্মদ আবু হেনা: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আদালতে রিট করে প্রার্থীদের হলফনামা দেওয়ার বিধান চালু করেছিল। এর মাধ্যমে দেশবাসী, বিশেষ করে এলাকার ভোটাররা প্রার্থীদের সম্পর্কে জানতে পারছেন। তবে এই হলফনামা কেবল নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দিয়ে রাখলে হবে না, ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। কমিশন প্রাচারপত্র ছেপেও প্রার্থীদের তথ্য ভোটারদের জানাতে পারে। প্রার্থীর বিষয়ে ভিন্ন তথ্য থাকলে সেটাও কমিশন দিতে বলতে পারে। এটা হলো কাউন্টার হলফনামা। এর মাধ্যমে ভোটাররা প্রকৃত তথ্য জানতে পারবেন। আমরা তো দেখছি প্রার্থীরা সম্পদের যে হিসাব দেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদের মালিক তাঁরা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে। কোন প্রার্থী কী কাজে কত টাকা খরচ করলেন, কমিশনের উচিত হবে সেটা খতিয়ে দেখা। একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের যে সীমা দেওয়া আছে, তার চেয়ে বেশি যেন কেউ খরচ করতে না পারেন। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর পদ্ধতি বের করতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকের মতো প্রার্থীর ব্যয়ের হিসাবও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

প্রথম আলো:

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় আপনি নির্বাচনপদ্ধতি পরিবর্তনের বিপক্ষেই মত রেখেছেন। কিন্তু অনেকেই তো আনুপাতিক ভোটের পক্ষে বলছেন। আনুপাতিক ভোট হলে সমস্যা কোথায়?

মোহাম্মদ আবু হেনা: আমাদের স্বীকার করতে হবে—দুই পদ্ধতিরই ইতিনেতি আছে। আমাদের এখানে যে ভোটপদ্ধতি চালু আছে, সেটা হলো ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি। অর্থাৎ মেজরেটারিয়ান। কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোট বেশে পেলে তিনি জয়ী হবেন। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো সংখ্যালঘু ভোট পেয়ে একজন নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন। এমনকি সরকারও গঠিত হতে পারে। আনুপাতিক ভোটে রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়া হয়। দলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী বিজয়ী প্রার্থী ঠিক করা হয়। এতে বড় সমস্যা হলো প্রার্থীর সঙ্গে ভোটারদের সরাসরি কোনো সংযোগ থাকে না। প্রার্থী যেমন ভোটারদের চেনেন না, তেমনি ভোটাররাও প্রার্থীকে চেনেন না। ফলে ভোটারদের প্রতি প্রার্থীর দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকার থাকে না। যেসব দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু আছে, সেসব দেশ যে ভালোভাবে চলছে, তা কিন্তু নয়। এ কারণেই দীর্ঘদিন আমরা যে ভোটপদ্ধতি অনুসরণ করে আসছি, সেটা রাখাই সমীচীন বলে মনে করি।

প্রথম আলো:

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মোহাম্মদ আবু হেনা: এটি আগামী নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করলেই ভালো।

প্রথম আলো:

নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আপনার আরও কোনো প্রস্তাব আছে কি? 

মোহাম্মদ আবু হেনা: প্রথম প্রস্তাব হলো, বর্তমানে নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী নেই। আমাদের সময়ে ছিল। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ছিল। পরবর্তীকালে সেই বিধান পাল্টানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী এইড টু বেসামরিক প্রশাসন হিসেবে কাজ করবে। সেটা তো তারা অন্যান্য ক্ষেত্রেও করে। নির্বাচনের বিষয়ে তাদের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। সেনাবাহিনী ছাড়া ভালো নির্বাচন করতে পারবে না। এর পাশাপাশি আমি ‘না ভোট’ চালুর পক্ষপাতী। একই সঙ্গে রিকল সিস্টেম চালু করতে হবে। অনেকে বলেন, বাংলাদেশের ভোটাররা অতটা সচতেন নন। এটা ঠিক নয়। আমাদের জনগণ সচেতন বলেই ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার আন্দোলন করছেন। জীবন দিচ্ছেন। সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানের পেছনেও ছিল ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রত্যয়। 

প্রথম আলো:

১৯৯৬ সালে আপনি যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তখনো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আপনার অভিজ্ঞতা ও এখনকার বাস্তবতার মধ্যে কোনো মিল আছে কি?

মোহাম্মদ আবু হেনা: ১৯৯৬ সালে আমি কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। তৎকালীন তত্ত্বাধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও সাবেক সচিব মুজিবুল হক আমাকে উৎসাহিত করেন। আমি ৯ এপ্রিল যোগ দিলাম। নির্বাচন হলো ১২ জুন। আমি চিন্তা করেছি, দুই মাসের মধ্যেই নির্বাচনটি করতে হবে। আমি প্রশাসনের সহায়তা পেয়েছি। এবারও অন্তর্বর্তী অর্থাৎ নির্দলীয় সরকার দায়িত্বে আছে। আমি মনে করি, আগামী নির্বাচনেও ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন সেই সুযোগ করে দেবে। আমরা সময় পেয়েছিলাম দুই মাস। এরা তো অনেক মাস সময় পাবে। আরেকটি কথা, নির্বাচনপ্রক্রিয়া থেকে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। বাছাই করার সুযোগ দিতে হবে। নির্বাচন হতে হবে প্রতিযোগিতামূলক। 

প্রথম আলো:

গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দাবি উঠেছে, হত্যা ও সন্ত্রাসে জড়িত কোনো দল ও ব্যক্তিকে ভোটে আনা যাবে না। আপনি কী বলেন?

মোহাম্মদ আবু হেনা: কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয়, এটা নির্ধারণ করার এখতিয়ার একমাত্র আদালতের। আদালত যদি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। তার আগে তো আপনি বলতে পারবেন না তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য। 

প্রথম আলো:

ছিয়ানব্বইয়ে আপনারা একটা ভালো নির্বাচন করেছেন। কিন্তু পরাজিত দল তো সেই ফল মানতে চায়নি।

মোহাম্মদ আবু হেনা: এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। একানব্বইয়ে যাঁরা পরাজিত হয়েছিলেন, তাঁরাও মানতে চাননি। রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণের জন্য আইন করা দরকার। রাজনৈতিক দলের শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আইন থাকার প্রয়োজন আছে।

প্রথম আলো:

নির্বাচন কবে হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মোহাম্মদ আবু হেনা: সংস্কারের কাজ দ্রুত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া যেতে পারে। প্রবাসীদের ক্ষেত্রে পোস্টাল ভোট চালু করতে হবে। যোগ্য নেতৃত্ব আসা উচিত রাজনৈতিক দলে। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ। 

মোহাম্মদ আবু হেনা: আপনাকেও ধন্যবাদ।