৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে অনেক সংশয়, শঙ্কা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের আয়োজন তো এখন প্রায় চূড়ান্ত। এরপর কী?
ড. মাহবুবউল্লাহ: হ্যাঁ, ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। আমরা নানা ধরনের কেনাবেচা দেখছি, দলবদল হতে দেখছি। এগুলোর কোনোটাই গণতন্ত্রের জন্য সুস্থ সংকেত নয়। এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের নামে আমরা নীতিহীনতার চর্চা দেখছি। এর ফল কী হবে, তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন, আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমি শুধু বলতে পারি, চারদিকে কেবল দুঃসংবাদ। কোনো সুসংবাদ নেই।
আপনি চারদিকে কেবল দুঃসংবাদ শুনতে পাচ্ছেন, বলছেন। এর মাধ্যমে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন?
মাহবুবউল্লাহ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের স্থিতিশীলতা ছিল। দলবদল, ফ্লোর ক্রসিং—এসব নীতিনৈতিকতাবিবর্জিত কার্যকলাপ তেমন ছিল না। এখন যে নির্বাচনের আয়োজন চলছে, তা যথেষ্ট বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ। এ নির্বাচনের ওপর ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ নির্ভর করছিল। সরকার সেটা রক্ষা করতে গিয়ে অনৈতিক পথ অবলম্বন করছে। আপনাদের কাগজেই দেখলাম, বিরোধীদলীয় লোকজন হেলমেট বাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাঙচুর, মারধর, ভয় দেখানো চলছে। এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। এ ধরনের সহিংসতা বড় ধরনের সহিংসতার জন্ম দেয়।
বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মাহবুবউল্লাহ: এই পরিস্থিতি বিপজ্জনক। আমার ধারণা, আমার মতো আরও অনেকে এ পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আরও বিপজ্জনক দিক হলো এ ধরনের কার্যকলাপ ঘটছে বিচার বিভাগের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। আইনকানুনের কোনো বালাই নেই। যে যার মতো চলছে। পিতার অপরাধে পুত্র গ্রেপ্তার হচ্ছে, পুত্রের অপরাধে পিতা। কোথাও কোথাও শিশুসন্তানেরাও হয়রানির শিকার হচ্ছে। যারা মনে করছে তারা শুধু এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যাবে, তারাই একদিন একই ধরনের আক্রমণের শিকার হতে পারে। এ পরিস্থিতি চলতে দেওয়া সমীচীন নয়।
আপনি কি বলতে চাইছেন, বাংলাদেশ ধারাবাহিক সহিংসতার দিকে চলে যাচ্ছে?
মাহবুবউল্লাহ: আমরা আইয়ুব খানের আমল দেখেছি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের ওপর সে সময় চরম নির্যাতন হয়েছিল। কিন্তু এর বাইরে পাকিস্তান আমলেও নির্যাতনের কথা আমি খুব একটা মনে করতে পারি না। আমি তো উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির মানুষ। আমার অন্তত মনে পড়ছে না। আমরা কি হঠাৎ করেই এত খারাপ, নিষ্ঠুর, নীতিনৈতিকতাবিবর্জিত মানুষ হয়ে পড়লাম? যে আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশীর সঙ্গে আমরা ওঠবস করি, চায়ের দোকানে গল্প করি, তারা এখন একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারছে না?
আসলে সব প্রতিষ্ঠান, হোক সেটা সামাজিক, আইনি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান—সবই তো ভেঙে পড়েছে। কোনো নিয়মকানুনই তো মানা হচ্ছে না। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছে। আপনারা যদি ড্যারেন অ্যাসেমগলু ও জেমস এ রবিনসনের হোয়াই নেশনস ফেইল গ্রন্থটি পড়েন, তাহলে মিল খুঁজে পাবেন। যে অবস্থা চলছে, তাতে কারোরই কোনো লাভ হবে না। সবাইকে ভুগতে হবে।
২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের পর থেকেই নানা অভিযোগে দলটির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। বিএনপি ওই দিনের পর থেকে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এতে খুব যে সাড়া পাচ্ছে, তা–ও না। বিএনপির হাতে কি বিকল্প কি কিছু ছিল না?
মাহবুবউল্লাহ: ইতিহাস বলে, এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সেটা হচ্ছে না। কারণ, যারা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেবে, তারা একসময় ক্ষমতায় ছিল এবং ক্ষমতায় থাকার সময় তারা কিছু ভুল করেছে। মানুষ তাদের কর্মকাণ্ডে আস্থা পাচ্ছে না। কিন্তু আস্থা না পেলেও মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এই ক্ষোভ খুবই বিপজ্জনক। যেকোনো সময় এটার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। দেশের জন্য এটা মঙ্গলজনক হবে না। যেভাবেই হোক, দেশ তো এগোচ্ছিল সব ভুলভ্রান্তি, অনিয়মের মধ্যেও। কিন্তু এখন এগোনো কঠিন হতে পারে। আমরা তো আশাবাদী হয়েছিলাম। বাংলাদেশকে একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো, সেখান থেকে দেশটি তো চমক দেখিয়েছে। সেই চমক তো এখন পাল্টে যাওয়ার উপক্রম।
দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে।
মাহবুবউল্লাহ: দেশে কী হয়েছে? ভারত থেকে পেঁয়াজ আনতে হচ্ছে। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছি বলে শুনছি বহুদিন ধরে। আবার শুনি, চালও আমদানি হচ্ছে। সারা দুনিয়াতেই খাদ্য পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। আমাদের যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রাও নেই। ফলে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটা সময় বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশ থেকে দুর্ভিক্ষ চিরবিদায় নিয়েছে। অথচ এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে দুর্ভিক্ষের কথা এসেছে। এটা তো ভয়াবহ। এমন পরিস্থিতিতে সব শক্তির একীভূত করা প্রয়োজন। কিন্তু সেই চেষ্টা কোথায়?
আমরা আবার যদি একটু রাজনীতিতে ফিরি, বিএনপি তো দেশজুড়ে আন্দোলন করছিল। কিন্তু এই পরিণতির কী কারণ? তারা কি যথেষ্ট বিকল্প হাতে না রেখেই সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেছিল?
মাহবুবউল্লাহ: বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তাদের সাংগঠনিক যে কাঠামো, তা মজবুত নয়। একভাষায় কথা বলার ক্ষেত্রে তাদের ঘাটতি আছে। বড় বড় বিবৃতি পড়লে বোঝা যায়, তাদের চিন্তার ঐক্যের দুর্বলতা আছে। ঐক্য না থাকলে আন্দোলন হতে পারে না। এখন পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য আর নেই, পৃথিবী এখন বহুমেরুকেন্দ্রিক। এরই মধ্যে দুটি বড় যুদ্ধ চলছে। একটি ইউক্রেনে, অন্যটি গাজায়। এমন বিশ্বব্যবস্থায় আপনি আপনার অবস্থান কীভাবে তুলে ধরবেন, সেটা বড় প্রশ্ন। এসব জায়গায় চিন্তার যে বলিষ্ঠতা, সেটা লক্ষ করা যায়নি।
দেশের অন্যতম বড় দল নির্বাচনে যাচ্ছে না। আন্দোলনও জমাতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে এ দলের ভবিষ্যৎ কী?
মাহবুবউল্লাহ: এ মুহূর্তে হয়তো নির্বাচন হয়ে যাবে। এখন আসলে আমাদের সবকিছু নজরে রাখতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে ভাববে। তবে আমার বিশ্বাস, এবার আমরা আর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখব না।
মীমাংসার কোনো আশা দেখেন?
মাহবুবউল্লাহ: সম্মানজনক, অর্থপূর্ণ আলোচনা যদি হয়, তাহলে আমি সব সময় মীমাংসার পক্ষে। কিন্তু এ মুহূর্তে দেশের ভেতরের কোনো উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। উদ্যোগটা আসতে হবে বাইরে থেকে। দ্বন্দ্ব নিরসনে এ ধরনের উদ্যোগ জরুরি। কিন্তু আমরা তো বাইরে থেকে আসা কোনো প্রস্তাবকেই গুরুত্ব দিচ্ছি না। আবারও বলি, বিশ্ব এখন বহুমেরুকেন্দ্রিক। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় শক্তিগুলো কিছু ইস্যুতে একমত হয়ে থাকে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহবুবউল্লাহ: আপনাকেও।