আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসনে আপনারা আন্দোলন করছেন। আপনাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা কী?
আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল: আমাদের সম্মিলিত ২৫ ক্যাডারের প্রধানতম দাবি হচ্ছে, উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া। চাকরিতে প্রবেশে কোটা পদ্ধতির বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এত মানুষ রক্ত দিল, চাকরিতে প্রবেশের পরও বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি থাকার কোনো নৈতিকতা থাকে না।
তাহলে কী থাকবে? উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। সিনিয়র স্কেল পর্যন্ত এ পরীক্ষাটা আছে কিন্তু উপসচিব থেকে আর এই পরীক্ষাটা নেই। আমরা চাই চাকরির সকল পদোন্নতির স্তরে পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা
দ্বিতীয়ত, ক্যাডার যাঁর, মন্ত্রণালয় হবে তাঁর। যিনি যে ক্যাডারে ঢুকবেন, তাঁর মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদ সচিবও হতে হবে সেই ক্যাডার থেকে। বিসিএস কৃষি ক্যাডারের প্রবেশ পদ হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পর্যন্ত তাঁর যাওয়ার সুযোগ আছে। ২৫ ক্যাডারের যাঁর যাঁর মন্ত্রণালয়ের কোনো পদেই তাঁদের যাওয়ার সুযোগ নেই, তাঁরা শুধু অধিদপ্তরেই থাকবেন। সে পর্যন্ত তাঁদের পদোন্নতির শেষ সুযোগ। আমরা এটির অবসান চাই।
গাড়ি কেনার জন্য প্রশাসন ক্যাডারের একজন এককালীন ৩০ লাখ টাকা পান। মাসে মাসে গাড়ি বাবদ ৫০ হাজার টাকাও। একজন মহাপরিচালক, এক নম্বর গ্রেডে যিনি সচিবের সমান বেতন পান, তাঁর জন্য গাড়ি কেনার এ সুযোগ নেই। সচিবের সমান পদমর্যাদাও তিনি পান না। এয়ারপোর্টে, সার্কিট হাউসে প্রশাসন ক্যাডারের একজন সহকারী কমিশনার গেলেও যে প্রটোকল পান, বাকি ক্যাডারের একজন মহাপরিচালকও সেটি পান না।
প্রশাসন ক্যাডারের পদ নেই, কিন্তু পদোন্নতি হচ্ছে সুপার নিউমারারিতে। এমন পদোন্নতি তো একেবারেই অনুচিত। কিন্তু সেটি হলে সব ক্যাডারের জন্য হতে হবে। কারণ, পদোন্নতির সুযোগ তো অন্যান্য ক্যাডারের কম। শিক্ষা ক্যাডারে চতুর্থ গ্রেডের ওপর যাওয়ার সুযোগ নেই। সেখান থেকেই অবসরে যেতে হয় তাদের। সমবায়, সমাজসেবা এমন অনেক ক্যাডারেরই এক নম্বর গ্রেডে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যত যোগ্য বা মেধাবীই হন না কেন, সে সুযোগই রাখা হয়নি চাকরির কাঠামোতে।
যে কোটাব্যবস্থা এখন আছে, সেটি কেমন?
আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল: প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যসংখ্যা ৬-৭ হাজার। অথচ উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতিতে তাঁদের জন্য ৭৫ শতাংশ কোটা রয়েছে। আর বাকি ২৫ ক্যাডারের সদস্যসংখ্যা ৩৬ হাজার। অথচ তাঁদের জন্য কোটা ২৫ শতাংশ। এত বড় একটি বৈষম্য থাকার কোনো যৌক্তিকতা আছে?
এখন সংস্কার কমিশন ৫০-৫০ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব দিতে চাইছে। আমরা এটিতেও একমত না। এটি তো দর কষাকষি করে কোটা বাড়ানো–কমানোর বিষয় না। কোটাবৈষম্যের কারণে আন্দোলনে নেমে আমাদের সন্তানেরা শহীদ হলো, তারা কি আমাদের কোটাসুবিধা ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এত রক্ত দিল? আমাদের শত ভাগ কোটা দিলেও আমরা রাজি না। আমরা চাই বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতিই না থাকুক।
আপনারা নিজেদের দাবিগুলো সরকার বা সংস্কার কমিটির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দিয়েছেন কী না?
আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল: হ্যাঁ, তা তো আমরা দিয়েছিই। আমরা ২৫টি ক্যাডারের প্রতিনিধিরাই সংস্কার কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি।
কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, সংস্কার কমিটি ২৫টি ক্যাডারের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে মাত্র একদিন, তাও স্বল্পসময়ের জন্য। ২৫টি ক্যাডারের সমস্যাগুলো জানা–বোঝার জন্য সবার সঙ্গে আলাদা আলাদা করে মতবিনিময়ের দরকার ছিল। একেকটা ক্যাডারের সঙ্গে অন্তত ত্রিশ মিনিট করে বসা উচিত ছিল। এখন ২৫ ক্যাডারের সঙ্গে এক ঘন্টার যে বৈঠক হলো সেখানে অনেক ক্যাডারই কথা বলার সুযোগ পায়নি। বলা হয়, দাবি ও প্রস্তাবগুলো লিখিত দিতে। এখন লিখিত দিলে তো মতবিনিময় করার জন্য ডেকে আনার দরকার ছিল না। এটিও তো আমাদের সঙ্গে এক প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ হলো।
সংস্কার কমিশনের সদস্য যাঁরা, শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি, তাঁদেরও বেশিরভাগ একটি বিশেষ ক্যাডার থেকে আসা। সব ক্যাডার থেকে অবসরপ্রাপ্ত কোনো যোগ্য, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ লোককে রাখার দাবি ছিল, সেটি তো করা হয়নি।
অন্য ক্যাডারদের ওপর প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাবটা কেমন? এতে আপনাদের কী কী সমস্যার মুখে পড়তে হয়?
আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল: জেলা পর্যায়ে ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) কমপক্ষে ১৪৬টি কমিটির প্রধান। একইভাবে উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমিটিগুলোর প্রধান। এতগুলো কমিটির মিটিংয়ে অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম চালানো একজন জেলা প্রশাসক বা ইউএনওর পক্ষে সম্ভব কি না?
ধরুন, বন্যা বা খরার কারণে কৃষকদের তাৎক্ষণিক প্রণোদনা দিতে হবে। সেই প্রণোদনার টাকার চেকটা যায় জেলা প্রশাসকের নামে। তাঁর কাছে গিয়ে কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালককে নানা অফিশিয়াল নিয়ম মেনে সেই টাকা নিয়ে আসতে হয়, তারপর খরচ করা যায়। এটি তো কৃষি বিভাগের জেলা প্রধান বা উপপ্রধানের মাধ্যমে হতে পারত। তাহলে কৃষক সেবাটা তাড়াতাড়ি পান।
জেলায় সার-বীজ মনিটরিং কমিটির প্রধানও জেলা প্রশাসক। সার-বীজের দায়িত্ব তো উপপরিচালকের (কৃষি), তাঁকেই কেন সেই কমিটির প্রধান করা হবে না।
আমাদের দাবি, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের যে যে বিভাগের প্রধানেরা আছেন, নিজ নিজ বিভাগ-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান তাঁরাই হবেন। এর ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার নিরসন হবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে, জনগণের সেবা পেতে আরও সহজ হবে।
এখন সব কমিটির প্রধান হওয়ার কারণে ডিসি-ইউএনওরা সব বিভাগে প্রভাব খাটান। ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডিসি-ইউএনওরা আমাদের ওপর খবরদারি করেন। অন্য বিভাগের জবাবদিহিও তাঁদের অধীনে আনতে চান। কথা হচ্ছে, আমার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি তো আমার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকবে। ডিসি–ইউএনওদের মেনে না চললে আমাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
আপনারা তো স্বেচ্ছায় যাঁর যাঁর ক্যাডার বেছে নিয়েছেন, তাহলে প্রশাসনে আসতে চান কেন?
আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল: প্রশাসন ক্যাডারের পদ কিন্তু সচিবালয়ের সব পদগুলো না। এখন যে উপসচিব পদে বাকিদের থেকে ২৫ শতাংশ পদোন্নতি দেওয়া হয়, সেটি কী জন্য দেওয়া হয়। এখন কেন সেটি ৫০ শতাংশ করতে চায় কমিশন? জনপ্রশাসনের সব পদ নির্দিষ্টভাবে শুধু প্রশাসনিক ক্যাডারের নয়, এসব কেন্দ্রীয় সরকারের পদ।
সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন করা হয়েছিল ১৯৮০ সালে। তখন বলা হয়েছিল, সব ক্যাডার থেকে পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব হবেন, এরপর যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব মানে বাকি সব পদে পদোন্নতি হবে। প্রশাসন ক্যাডার থেকেও সেটি হবে। প্রশাসন ক্যাডারের পদ তো জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার পর্যন্ত বা তাঁরা যেহেতু এসি ল্যান্ড হিসেবে ঢোকেন, সে কারণে ভূমিসচিব পর্যন্ত হতে পারেন। আপনি যদি বলেন কৃষি ক্যাডার কেন কৃষির সচিব হতে চান, তাহলে সহকারী সচিব (ভূমি) কী করে জনপ্রশাসনের সচিব হন, খাদ্যসচিব হন? আর কৃষি ক্যাডার হিসেবে ঢোকার পর একজনের কৃষিসচিব পর্যন্ত যাওয়ার বা আকাঙ্ক্ষা নৈতিকভাবে থাকতেই পারে। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে একজন কৃষি ক্যাডার নিশ্চয়ই প্রশাসন ক্যাডার থেকে ভালো বুঝবেন। নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাঁদের চেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবেন। আমরা তো সেটিই চাই।
এভাবে স্বাস্থ্য ক্যাডার থেকে হবেন স্বাস্থ্যসচিব, শিক্ষাসচিব হবেন শিক্ষা ক্যাডার থেকে। এটা তো একেবারেই যৌক্তিক। আমরা তো বলছি না, জনপ্রশাসনের পদগুলো আমাদের দেন।
এখন যে জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হলো, তা নিয়ে কী বলবেন?
আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল: দেখেন, একটি গোষ্ঠী অন্তর্বর্তী সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করছে। যে কারণে এ অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। এই বিশেষ গোষ্ঠী কিন্তু বিগত সরকার থেকেও বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। সেই সরকারকে তারা বিভিন্ন বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, যার কারণে সেই সরকার দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
আমাদের আন্দোলন খুবই নিয়মতান্ত্রিক, আমরা সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন করছি না। তাদের বিপদে ফেলারও কোনো সুযোগ নেই। সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধেও আমাদের অবস্থান নয়; বরং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান।
অতীতেও আমরা বড় বড় আন্দোলন করেছি, তখন আরও বড় সংগঠন ছিল আমাদের। নানা সরকার আমাদের অনেক দাবি মেনেও নিয়েছে। কিন্তু প্রশাসন থেকে এখন আমাদের বিষয়ে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সরকারের উপদেষ্টাদের। এ সরকারকেও বিপদে ফেলার জন্য তারা বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করছে বলে আমরা মনে করি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।