বিশেষ সাক্ষাৎকার : এম হুমায়ুন কবীর

ভারতকে বুঝতে হবে বাংলাদেশের মানুষ কী চায়

এম হুমায়ুন কবীর। কূটনীতিক ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি বর্তমানে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই কূটনীতিক।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান 

প্রথম আলো:

অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে তিন মাসের মাথায় বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে আছে? 

এম হুমায়ুন কবীর: আমার মনে হয়, জটিলতা বাড়ছে। দুই দেশের সম্পর্ক তো বহুমাত্রিক ও বহুমুখী। বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে অনেকটা একপক্ষীয়। আমরা বিদ্যুৎ আমদানি করছি, ডিজেল আমদানি করছি। ভারত থেকে চাল, পেঁয়াজ, আলুও আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে না। নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দুই দেশের সম্পর্ক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক। আমাদের সাংস্কৃতিক বন্ধনটাও দীর্ঘদিনের। তৃতীয় অনেক দেশের ভিসার জন্য বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীকে দিল্লি যেতে হয়। গত ১৫ বছর ভারত সহজে ভিসা দিত। গত আগস্ট থেকে ভিসা খুব সীমিত করা হয়েছে। ভিসা সহজ করা ভারতের সদিচ্ছার প্রথম ধাপ হতে পারে।

প্রথম আলো:

তাহলে দুই দেশের টানাপোড়েনটা বাড়ল কেন?

এম হুমায়ুন কবীর: ৫ আগস্টের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা তারা মানতে পারেনি। এ জন্য নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি, সমস্যা সমাধানে দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে পরিস্থিতিটা যেন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। দুই দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে, কূটনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনপরিসরে উত্তেজনা তৈরি করা যাবে না। 

প্রথম আলো:

সাম্প্রতিক কিছু কিছু ঘটনা তো পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলেছে। যেমন কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে বিজেপির সমর্থকেরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছেন। 

এম হুমায়ুন কবীর: এটি উদ্বেগজনক ঘটনা। প্রথম কথা হলো যেকোনো দেশের মিশন ও তার কর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব স্বাগতিক দেশের। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঘটনার প্রতিবাদ করার পাশাপাশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। আমরা আশা করব, এ বিষয়ে ভারত যা যা করণীয়, সেটা করবে। প্রতিবেশী হিসেবে আমরা কেউ কাউকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। আমাদেরও যেমন ভারতের প্রয়োজন আছে, তেমনি ভারতেরও বাংলাদেশের প্রয়োজন আছে। 

প্রথম আলো:

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভারতের সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননার খবর ছাপা হয়েছে। এটা নিয়ে তো তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ আছে।

এম হুমায়ুন কবীর: এটা কোনোভাবে বাঞ্ছনীয় নয়। সব পক্ষকে সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে। কারও এমন কোনো কাজ করা ঠিক হবে না, যাতে সামাজিক অস্থিরতা ও অবিশ্বাস বাড়ে। 

প্রথম আলো:

ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো কূটনৈতিক ঘাটতি আছে বলে মনে করেন? 

এম হুমায়ুন কবীর: আমাদের দিক থেকে ঘাটতি আছে, বলব না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বার্তায় স্পষ্ট ভাষায় সমতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে ভারতের সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অনেকে এসেছেন। ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও প্রধান উপদেষ্টা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চেষ্টা ছিল সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি বৈঠক করার। কিন্তু সেটা হয়নি। যদিও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। এরপর আমরা কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি দেখিনি। সেটা হওয়া উচিত ছিল।

প্রথম আলো:

ভূরাজনৈতিক বিষয়েও ভারতের উদ্বেগ আছে। তারা মনে করে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নয়ন হলে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

এম হুমায়ুন কবীর: পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ দেখি না। পাকিস্তান বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয় তাদের। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে যে বহুমাত্রিকতা আছে, সেটা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে না বাস্তব কারণেই। অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোগী। আমি বলব, এ নিয়ে ভারতের বাড়তি চিন্তার কোনো কারণ নেই। 

প্রথম আলো:

বাংলাদেশেও তো ভারতবিরোধী প্রচারণা আছে। 

এম হুমায়ুন কবীর: বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালানো হয় না। কোনো কোনো মহল চালাতে পারে। আমি বলব, সরকার ও মূলধারার রাজনৈতিক নেতারা দায়িত্বশীল আচরণ করছেন। কিন্তু ভারতের চিত্রটা ভিন্ন। সেখানে সরকার, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব প্রচারণা চলছে, সেগুলোও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এটাই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উপায়। আমার ধারণা, ভারত কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ তাতে অনুকূল সাড়া দেবে। অতীতেও দিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি থিঙ্কট্যাংক বা চিন্তক সংগঠনগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রথম আলো:

তাহলে সমস্যাটি কোথায়?

এম হুমায়ুন কবীর: সমস্যাটি হলো বাংলাদেশে যে এত বড় একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন হলো, সেটা ভারতের নীতিনির্ধারকেরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা মনে করেছেন বাংলাদেশের একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক টেকসই হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনো কখনো তাদের হস্তক্ষেপও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং কীভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিলেন, সেটা সবার জানা। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পেলাম। বাংলাদেশের মানুষ কী চায়, সেটা ভারতের নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি করতে হবে। এখানকার মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার কারণে। ক্ষমতাসীনেরা কোনো প্রকার বিরোধিতা সহ্য করেনি। কেবল বিরোধী দলের নেতা–কর্মী নয়, সাধারণ মানুষও নিগ্রহের শিকার হয়েছে। এসব কারণেই আগস্টে ছাত্র–জনতার হয়েছে। এর সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে মেলানো ঠিক নয় কোনোভাবে। 

প্রথম আলো:

অচলাবস্থা নিরসনের উপায় কী?

এম হুমায়ুন কবীর: বাস্তবতার আলোকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এতে দুই দেশের মানুষই লাভবান হবে। ভারতের ভিসা বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের পর্যটকেরা সেখানে যেতে পারছেন না। রোগীরাও আগের মতো চিকিৎসা নিতে পারছেন না। এতে যেমন বাংলাদেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশ থেকে পর্যটক ও রোগী না যাওয়ায় ভারতও তো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রথম আলো:

১০ ডিসেম্বর দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে বৈঠকের কথা আছে। বাংলাদেশ এই বৈঠক নিয়ে আশাবাদী, যা ইতিমধ্যে পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যে উঠে এসেছে। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, এখনো দিনক্ষণ ঠিক হয়নি, ঠিক হলে
জানানো হবে। 

এম হুমায়ুন কবীর: পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকটি (ফরেন অফিস কনসালটেশন—এফওসি) ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় করার জন্য প্রস্তাব গেছে দিল্লিতে। ভারতীয় একটি সূত্র বলেছে, দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলে জানিয়ে দেওয়া হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের দিকটি ঠিক রেখে এখন আস্থার জায়গা তৈরি করা জরুরি। এসব কারণেই আমি মনে করি, বৈঠকটি হওয়া প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যকার যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে হলে আলোচনার বিকল্প নেই। যদি কোনো ভুল–বোঝাবুঝি থাকে, সেটাও নিরসন করতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। আলোচনা হলে বাংলাদেশিদের ভিসা সমস্যার সুরাহা হবে। দুই দেশের জনগণের মধ্যে আসা-যাওয়া থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যও বাড়বে। এফওসি একটি নিয়মিত বিষয় হলেও ভারতের সঙ্গে এবারের এফওসির আলাদা তাৎপর্য আছে। বর্তমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল করার জন্য বৈঠকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো:

সম্প্রতি বে অব বেঙ্গল সম্মেলনে ভারতের কূটনীতিকেরাও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্যে কি পরিবর্তিত বাস্তবতা মেনে নেওয়ার লক্ষণ আছে বলে মনে করেন? 

এম হুমায়ুন কবীর: কিছু কিছু বিষয় উঠে এসেছে। পুরোটা নয়। এ ধরনের আলোচনা আরও হওয়া উচিত। 

প্রথম আলো:

দুই দেশের মধ্যকার বকেয়া সমস্যাগুলো কি পেছনেই পড়ে থাকল? যেমন তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে আলোচনা, সীমান্তে মানুষ হত্যা।

এম হুমায়ুন কবীর: দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হলে এসব বিষয়ও আসতে পারে। তবে এ মুহূর্তে জরুরি হলো দুই দেশের সম্পর্কে যে অস্থিরতা আছে, সেটা কাটানো। অর্থাৎ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। 

প্রথম আলো:

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে দাবি করে ভারত উদ্বেগ জানাচ্ছে। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর লোকসভায় বিবৃতিও দিয়েছেন। এটাকে কীভাবে দেখছেন? 

এম হুমায়ুন কবীর: ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সেটা প্রশমন করতেও তিনি এই বিবৃতি দিতে পারেন। একই সঙ্গে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন। আর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু পরিস্থিতির ওপর ভারতের নজরদারি প্রসঙ্গে আমি বলব, সবারই নিজের দিকে তাকানো প্রয়োজন। আমাদের এখানেও যাতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার নিচ্ছেও। কিন্তু সমস্যা হলো ভারতের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সমস্যাটি অতিরঞ্জিতভাবে দেখা হচ্ছে। 

প্রথম আলো:

কিন্তু ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর তো বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। 

এম হুমায়ুন কবীর: কিছু ঘটনা ঘটেছে অস্বীকার করছি না। দেখতে হবে সরকার ও জনগণ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আমি এখানে তিনটি ঘটনার কথা বলব। ৫ আগস্টের পর তিন দিন সরকার ছিল না। ৮ আগস্ট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হয়। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতৃত্ব ও জনসমাজও এগিয়ে এসেছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায়। দ্বিতীয়ত দুর্গোৎসবের সময় সরকার শান্তি রক্ষায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন ও নাগরিক সমাজও পাহারায় ছিল। এ কারণে কোনো অঘটন ঘটেনি। তৃতীয় ঘটনা হলো সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন না হওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেন। একজন আইনজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে অত্যন্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কারণে পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল এবং এখনো আছে। সে ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘাটতি ছিল, এটা বলা ঠিক হবে না। 

প্রথম আলো:

তাহলে সমাধান কী।

এম হুমায়ুন কবীর: সমাধান হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নিয়ে ভারতকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সমস্যা হলো এখনো তারা সেটি মানতে পারছে না। ৫ আগস্টের পর ভারতের বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে আমরা কথা হয়েছে। তাঁরা বাংলাদেশের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও টেলিভিশনও মতামত জানতে চেয়েছিল। আমি তাদের বলেছি, এটা ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, যাতে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিল। এর পেছনে পাকিস্তানের আইএসআই, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র আছে বলে তাদের ধারণা অমূলক। 

প্রথম আলো:

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তৃতীয় কোনো দেশ কি ভূমিকা রাখতে পারে? আমরা তো দেখেছি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে ভূমিকা রেখেছে। 

এম হুমায়ুন কবীর: বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে এসেছিলেন দিল্লি হয়ে। আবার ঢাকা থেকে ফিরেও গেছেন দিল্লি হয়ে। এ বিষয়ে কোনো পক্ষ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও আমরা মনে করি, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিলে সমস্যার সমাধান অনেক সহজ হবে। ভারতের উদ্বেগের কিছু ভিত্তি আছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে নেইও। আলোচনার টেবিলে বসলে সবকিছু নিয়ে কথা হতে পারে। আমাদের বা ভারতের উদ্বেগ কমাতে হলে আলোচনার বিকল্প নেই।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলে বহির্বিশ্বে একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ায় অনেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু সাড়ে তিন মাস পরও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তেমন সাফল্য দেখা যাচ্ছে না।

এম হুমায়ুন কবীর: ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ সব বৃহৎ শক্তিই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিল। বিশেষ করে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে ভাবমূর্তি আমরা দেখেছি, সেটা খুবই আশাব্যঞ্জক। এ থেকে আমরা কোনো সুফল পাইনি, সেটা বলা যাবে না। প্রধান উপদেষ্টার একটি টেলিফোনে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আটক অর্ধশতাধিক বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। মালয়েশিয়ায় আমাদের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে ফের সেটি চালু হয়েছে। 

প্রথম আলো:

কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা নেতিবাচক পরিস্থিতি লক্ষ করছি। বিদেশি বিনিয়োগ যে হারে আসার কথা, সেটা আসছে না। 

এম হুমায়ুন কবীর: বিনিয়োগের জন্য দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। সেই পরিবেশ আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি। একটা টালমাটাল অবস্থা। সব দেশই চায় তারা যে বিনিয়োগ করবে, সেটা যাতে ফেরত পায়। আশা করি, ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পরিবেশও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সরকার অনেকগুলো সংস্কার প্রস্তাব নিয়েছে, সেগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচনের দিকে এগোলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে আশা করা যায়। 

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ। 

এম হুমায়ুন কবীর: আপনাকেও ধন্যবাদ।