২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আসিফ নজরুলের বিশেষ সাক্ষাৎকার

নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য সংস্কারের সময় দিতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয় গত ৫ আগস্ট। ৮ আগস্ট গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। সরকারের এক মাস পূর্তিতে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের কার্যক্রম, সংস্কার, সরকারের মেয়াদ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।রাজধানীর ইস্কাটনে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গতকাল শনিবার এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং রাজীব আহমেদ

প্রথম আলো:

আপনি নাগরিক সমাজের মানুষ ছিলেন। মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন, রাজনীতি, বিচারালয় ইত্যাদি বিষয়ে আপনি ছিলেন সরকারের সমালোচক। এখন নিজেই সরকারে। নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে কী বলবেন?

আসিফ নজরুল: আমি বিভিন্ন সরকারের সমালোচনা করেছি ৩০ বছর ধরে। আর সরকারে আছি ৩০ দিন। সরকারের নানা নেতিবাচক কাজের সমালোচনা যতটা সহজে করতে পারতাম, নতুন দায়িত্ব পালন করার কাজটি ততটা সহজ হচ্ছে না। কারণ, আমার অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে একটা কথা বলতে পারি, মানুষের নিয়ত যদি সৎ হয়, দেশপ্রেম থাকে, ইচ্ছাশক্তি থাকে, তাহলে যেকোনো কাজ করা সম্ভব। বিশ্বাস করি, আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে আমি সরকারের কাজও খুব স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারব। আরেকটি দিক হলো, বিগত ১৫ বছরে সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার মাধ্যমে এবং অবাধ দুর্নীতি, অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া ও দলীয়করণের মাধ্যমে এমন একটি শোচনীয় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কাজ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং।

প্রথম আলো:

সরকারের এক মাস হলো। এই সময়ে সরকারের কোন কাজগুলোকে ভালো বলবেন? দেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে, কোন কোন ঘটনাকে আপনার অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে হয়?

আসিফ নজরুল: আমি মনে করি, এটা জনগণের সরকার, এই আস্থা তৈরি করতে পারাটাই এই সরকারের প্রথম ভালো কাজ। বিগত সরকারের আচরণ ছিল মানুষের প্রতি প্রভুসুলভ। আমরা জনগণের কাছে অল্প হলেও এই ধারণা দিতে পেরেছি যে এটা আপনার সরকার, আপনাকে সেবা দিতে এসেছে। আপনি এই সরকারের যেকোনো সমালোচনা যখন ইচ্ছা করতে পারেন। এই মুক্তির পরিবেশ তৈরি করা গেছে। বৈষম্য ও বঞ্চনা দূর করতে সরকার বেশ কিছু কাজ করেছে। যেটা বাইরে থেকে ততটা বোঝা যাবে না। যেমন রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদবঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, জনমনে সেই আস্থা সরকার তৈরি করতে পেরেছে। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিগত সরকারের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছু মিথ্যা মামলাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে, ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে, পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনতে প্রাথমিক যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সরকার তা করতে পেরেছে। মানুষকে স্বপ্ন দেখার সাহস কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। রাজধানীতে সভা-সমাবেশ হচ্ছে, সেমিনার হচ্ছে। মানুষ কথা বলছে। নানা প্রস্তাব আসছে। এমন একটি দেশই আমরা চেয়েছিলাম।

কত বছর পর আমরা তা পেলাম। মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক রীতি মেনে চলার কিছু কাজ করা এবং গুমবিরোধী জাতিসংঘের সনদে সই করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গুম বিষয়ে কমিশনও গঠিত হয়েছে।

একটা বিষয় বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। সেটি হলো, এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা ছিল। বিচারিক অভ্যুত্থান, আনসারদের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা, শ্রম খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা ইত্যাদি প্রতিরোধ করা গেছে। এর মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনাও ঘটেছে। যত্রতত্র মামলার ঘটনা ঘটছে। মামলায় আগের সরকারের মতো ঢালাও অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। আদালত প্রাঙ্গণে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

প্রথম আলো:

যত্রতত্র মামলা ও ঢালাও অভিযোগ বিষয়ে সমালোচনা আছে। সরকারের পদক্ষেপ কী?

আসিফ নজরুল: আমরা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি, মামলা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যেহেতু আগের সরকারের সময়ে আদালত ও পুলিশকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল, ঘৃণার পাত্রে পরিণত করা হয়েছিল, সেহেতু চাপের মুখে তাঁরা নৈতিক মনোবল নিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। এখন ইচ্ছা না থাকলেও ঢালাও অভিযোগের মামলাগুলো নিতে হচ্ছে। সদিচ্ছা থাকার পরও আদালত প্রাঙ্গণে আক্রমণ ঠেকাতে পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা এসব মোকাবিলার উপায় বের করার চেষ্টা করছি। যেমন আদালত প্রাঙ্গণে হামলা ঠেকাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মামলার শুনানি খুব ভোরে বা আনপ্রেডিক্টেবল (অনুমান করা যায় না) সময়ে করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর কারণে হামলা পরের দিকে বন্ধ করা গেছে। মামলার ক্ষেত্রে একটি চিন্তা হলো, এজাহার নেওয়ার আগে প্রাথমিক তদন্ত করা হবে। সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে কিছু পরিবর্তন আনার কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে একটা বার্তা দেওয়া হয়েছে, এজাহার মানেই গ্রেপ্তার নয়।

প্রথম আলো:

তাহলে বলতে পারি যে ঢালাও অভিযোগে ও ঢালাওভাবে আসামি করা একটি সমস্যা। সেটা সরকার স্বীকার করে।

আসিফ নজরুল: অবশ্যই। সরকার সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। তবে আমি বলব, এই সমস্যা বিগত সরকারের সৃষ্টি। আওয়ামী লীগ সরকার গায়েবি মামলার সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। তার পাল্টা হিসেবে কিছু কিছু জায়গায় কিছু ঘটনা ঘটছে। সব মানুষের ক্ষোভ এক দিনে দূর করা সম্ভব নয়।

প্রথম আলো:

একটু উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়ে ফিরে যাই। আপনি আইন মন্ত্রণালয় বেছে নিয়েছেন। কেন?

আসিফ নজরুল: অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে আইন বিষয়টি একটু ভালো বুঝি বলে মনে করি। আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনেক অবিচার, অন্যায় দূর করা সম্ভব। বিচারকদের অন্তত ৫০ শতাংশ আমার ছাত্র অথবা পরিচিত। এই তিন বিষয় আমাকে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে উৎসাহ দিয়েছে। ড. ইউনূস স্যার যখন আমাকে আইন মন্ত্রণালয় নিতে বলেন, তখন আমি আগ্রহের সঙ্গেই নিয়েছি। তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড. ইউনূস স্যারের সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার সময় শ্রমিকদের কষ্ট নিয়ে তাঁকে বলতাম। তিনি হয়তো সেটা মনে রেখে আমাকে এই মন্ত্রণালয় দিয়েছেন। আমি প্রবাসীদের জন্য কাজ করতে চাই। তবে আপনি দেখলেন, আমি শনিবার এখানে অফিস করছি। এটা বিগত ৩০ দিনে তৃতীয় শনিবার। এক মাসে দুটি শুক্রবার আমাকে অফিস করতে হয়েছে।

প্রথম আলো:

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানুষের যেসব আকাঙ্ক্ষা—মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত করা অনেকটাই আইন মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত। অনেক কাজ। কাজগুলো শেষ করার বিষয়ে আপনি কতটুকু আত্মবিশ্বাসী?

আসিফ নজরুল: ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার, আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার নির্দোষ মানুষের মুক্তি, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় বিগত সরকারের প্রভাবমুক্ত করা, বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের পদায়ন, বিভিন্ন নিয়োগে সহায়তা ইত্যাদি রুটিন কাজে বিগত এক মাসের অনেকটা সময় চলে গেছে। অন্য দুটি মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক কাজ ছিল, যা গতানুগতিক একটি সরকারে থাকলে করতে হয় না। সংস্কারের কাজে তাই সময় দিতে পারিনি। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু করব।

প্রথম আলো:

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার বিষয়টি নিয়ে আপনারা কাজ করছেন। সিদ্ধান্ত কি সেটাই আছে, নাকি নতুন কোনো ভাবনা আছে?

আসিফ নজরুল: ভুক্তভোগী ও তাঁদের স্বজনেরা বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত আইনে মামলা করছেন। আমরা তাঁদের বিরত রাখতে পারি না, সে অধিকার আমাদের নেই। তবে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপ্তি অনেক বড়। সেটার সুষ্ঠু বিচার করতে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করাই সবচেয়ে ভালো হবে। আমরা দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। জুলাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতাদের উপযুক্ত বিচার করার সুযোগ ও সম্ভাবনা এই আইনেই রয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের সংস্থার প্রতিনিধিদের এটা বোঝাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। ওনাদের কিছু উদ্বেগ আছে। তা হলো আইনটির সংজ্ঞায় কিছু সমস্যা থাকা, সাক্ষ্য গ্রহণের বিধিতে কিছু সমস্যা থাকা, অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনগত প্রতিকারের কিছু সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি। আমরা আইনটির সংস্কার করে এসব সমস্যা দূর করব। আমাদের লক্ষ্য প্রতিশোধ নেওয়া নয়, গণহত্যার উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা।

বিদেশিরা বলেছে, মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকায় তারা বিচারপ্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নিতে পারবে না। আমরা বলেছি, আইন সংশোধন করে তাদের পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার সুযোগ তৈরি করা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন।

প্রথম আলো:

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কি মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল থাকবে?

আসিফ নজরুল: এটা অনেক বড় নীতিগত বিষয়। আমরা চট করে এটি বদলাতে পারি না। মৃত্যুদণ্ড রদ করার মতো সংশোধনীমূলক কারাব্যবস্থা ও জনসংস্কৃতি বাংলাদেশে আছে কি না, তা দেখতে হবে।

প্রথম আলো:

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার করবেন। এ জন্য প্রত্যর্পণের অনুরোধ করবেন ভারতের কাছে। একটু বিস্তারিত বলবেন?

আসিফ নজরুল: জুলাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী শেখ হাসিনা। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। বিচার হলে স্বাভাবিকভাবেই আসবে তা কার্যকরের বিষয়টি। সে জন্য ভারতের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধের বিষয়টি আসবে। প্রধান উপদেষ্টার কথায় জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।

প্রথম আলো:

ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্দী বিনিময় চুক্তি আছে?

আসিফ নজরুল: আছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চুক্তির ব্যতিক্রম কিছু শর্তের ব্যবহারের সুযোগ থাকে। সেটা যাতে না হয়, তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হবে।

প্রথম আলো:

আমরা ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের একটি বক্তব্য শুনলাম। তিনি ভারতের সেনাবাহিনীকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছেন। এ বিষয়ে কি বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া আছে?

আসিফ নজরুল: সরকারি পর্যায়ে এটা নিয়ে আলোচনা হয়নি। আমি নিজের মত হিসেবে বলতে পারি, ভারতের বোঝা উচিত বাংলাদেশে এখন ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকার দায়িত্ব পালন করছে। এই সরকারের বিপুল জনসমর্থন, আত্মসম্মানবোধ ও দেশপ্রেম আছে। রাজনাথ সিং যেভাবে ইউক্রেন, ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আনলেন, সেখানে মনে হয়েছে বাংলাদেশের পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁদের সংবেদনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি আছে। প্রতিবেশী প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে ভারতের নীতি ব্যর্থ হচ্ছে। আমি অনুরোধ করব, ভারত যাতে এর পেছনে তার নিজের দায় পর্যালোচনা করে দেখে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক থাকবে, তবে সেটা হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে।

প্রথম আলো:

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এখন সরকার পরিচালনার অংশ। এটা একেবারেই নতুন এক অধ্যায়। আপনার অভিজ্ঞতা কী?

আসিফ নজরুল: এটা দারুণ অভিজ্ঞতা। ওদের কাজে আমি মুগ্ধ। ওরা যেভাবে উপদেষ্টা পরিষদে কথা বলে, যেভাবে কাজ করে, সেটা খুব ভালো। ওরা ভবিষ্যতে খুবই ভালো করবে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য ওদের আমি সৃষ্টিকর্তার উপহারের মতো ভাবি।

প্রথম আলো:

ফ্যাসিবাদীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসন নয়। ফ্যাসিবাদী দল ও জোটকে প্রকাশ্যে কর্মসূচি (পাবলিক প্রোগ্রাম) পালনের ক্ষেত্রেও সরকার নিরুৎসাহিত করবে—গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এ কথা বলেছেন। আপনি কি বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন?

আসিফ নজরুল: এত বড় হত্যাকাণ্ডের পর কে বলবে যে ওদের এখনই সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া উচিত। তাদের পক্ষ থেকে সরকারকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রও চলছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা আছে। আসিফ মাহমুদের বক্তব্য উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার ভিত্তিতেই এসেছে। সেখানে জনমানুষের চাওয়ার প্রতিফলন আছে। আমি মনে করি, সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমেই তাদের অপরাধের মাত্রা বোঝা যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংশোধনীতে নিজেরাই সংগঠনের বিচার করার সুযোগ রেখেছে।

প্রথম আলো:

রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার বিষয়টি বলছে। তাদের কতটা সময় যৌক্তিকভাবে ধৈর্য ধরা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আসিফ নজরুল: রাজনৈতিক দল নির্বাচন চাইতে পারে। আমার প্রশ্ন, তারা কী ধরনের নির্বাচন চায়? তারা কি আওয়ামী লীগ আমলের মতো নির্বাচন চায়, জবাবদিহিহীন সরকারব্যবস্থা চায়, আওয়ামী লীগ আমলের মতো পুলিশ, বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন চায়? এগুলো না চাইলে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য সংস্কারের সময় আমাদের দিতে হবে। সময় কতটা, তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। নির্ভর করবে অংশীজনদের কাছ থেকে আমরা কতটা সহযোগিতা পাচ্ছি।

প্রথম আলো:

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারগুলো আইনে পরিণত করার ক্ষেত্রে নির্বাচিত সরকারের ভূমিকা থাকে। অতীতে দেখেছি, অনেক কিছুই বদলে ফেলা হয়। আপনাদের সংস্কারগুলো নতুন সরকার রাখবে, সেটার নিশ্চয়তা কী?

আসিফ নজরুল: দুই কারণে আমার আত্মবিশ্বাস আছে। প্রথমত, বাংলাদেশে এত ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান আগে হয়নি, এত মানুষের মৃত্যুও হয়নি। নতুন সরকার মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে কাজ করবে না বলে আশা করি। দ্বিতীয়ত, সংস্কার করা হবে সবাইকে অংশীদার করে, যাতে তাদের মালিকানা বোধ তৈরি হয়।

প্রথম আলো:

আপনি বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে দেশকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?

আসিফ নজরুল: আমি এমন একটা দেশ দেখতে চাই, যেমন দেশ গড়ার জন্য বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। বৈষম্যহীন, শোষণহীন, দুঃখ-কষ্টহীন দেশ চাই; যাতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ সত্যিকারভাবে মর্যাদার আসনে থাকতে পারে। সে রকম একটি বাংলাদেশের যাত্রা সুস্পষ্টভাবে শুরু হয়েছে—সরকারের বিদায়ের সময় আমি তা দেখতে চাই। ব্যক্তিগতভাবে একটি প্রত্যাশা হলো, বিদায়ের সময় মানুষ যেন বলতে না পারে আমি অন্যায় করেছি। ভুল হতে পারে, তবে অন্যায় করব না।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

আসিফ নজরুল: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।