বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দিয়েই শুরু করি। কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। এ সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছেন। সরকার ব্যাংক খাতের সংকট নিরসনে যে পথরেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে এটা কতটা সংগতিপূর্ণ?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: আমাদের এখানে ঋণখেলাপির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টার প্রতিফলন, এই সিদ্ধান্ত নয়। কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে—এ সিদ্ধান্তে ঋণখেলাপিরা উৎসাহিত হবেন। এটি নিঃসন্দেহে ঋণখেলাপি সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। ঋণখেলাপিদের একধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন ছিল ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে পাওনা আদায় করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
ব্যাংক খাতের সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার ঘোষিত যে নীতি, তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত খুব একটা খাপ খায় না। একজন ঋণখেলাপি সংজ্ঞা অনুসারেই ঋণখেলাপি; প্রতিষ্ঠানগত ভেদাভেদ না করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি, তাই অন্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে তিনি ঋণ নিতে পারবেন, কিংবা সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন, এটা নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পদ্মা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। আরও কয়েকটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একীভূত হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে। বিডিবিএল যাচ্ছে সোনালীতে। একীভূতকরণের এই সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতকে কি সংকট থেকে বের করে আনতে পারবে?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর হয়ে যাবে, সেটা ঠিক নয়। ব্যাংক দুর্বল হওয়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। সেই কারণ দূর না করে একটা তথাকথিত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একটা দুর্বল ব্যাংক একীভূত করলেই দুর্বলতা আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে না। ব্যাংক দুর্বল হওয়ার প্রধান একটি কারণ হলো, ব্যাংকে সুশাসনের অভাব। সুশাসন না থাকার কারণে মন্দ ঋণ বাড়তে বাড়তে এ রকম চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। সুশাসনের অভাব ও খেলাপি ঋণের কারণেই আমাদের ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে।
সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো একীভূত করার কথা শোনা যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক একীভূত হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে। একটা কথা বলা হচ্ছে, এসব ব্যাংকের মন্দ ঋণ একটা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এতে হয়তো কাগজে-কলমে দেখানো যাবে ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ কমে গেছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোয় যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করা যায়, তাহলে এই মন্দ ঋণের প্রবাহ চলতেই থাকবে। আমাদের ব্যাংকগুলোয় বছরের পর বছর ধরে মন্দ ঋণ পুঞ্জীভূত হয়েছে।
একটা বিষয় হলো, এখানে মন্দ ঋণ যাদের আছে, তাদের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। আমাদের ব্যাংক খাতের যে দুর্বলতা, সেখানে দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে সমস্যার সমাধান হবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে ব্যাংগুলো একীভূত করলে আগামী দিনগুলোয় দেখা দেবে মন্দ ঋণ আবারও পুঞ্জীভূত রূপ নিয়েছে। মন্দ ঋণ পুঞ্জীভূত হওয়ার কারণ হলো কিছু গোষ্ঠী তাদের স্বার্থে ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করছে। এই গোষ্ঠীস্বার্থের সংস্কৃতির মূলে আমরা যদি শক্তভাবে আঘাত করতে না নিতে পারি, তাহলে ব্যাংক একীভূতকরণ হোক, আর মন্দ ঋণ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে দিয়ে দেওয়া হোক না কেন, সমস্যার সমাধানটা হবে না। বরং ভবিষ্যতে সমস্যাটা আরও প্রকট হবে।
সবল ব্যাংকগুলো তো একধরনের চাপের মধ্যে আছে...
মুস্তফা কামাল মুজেরী: দুর্বল ব্যাংকগুলোকে যদি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়া হয়, তারা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। মন্দ ঋণ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হলে সেটা হবে আমাদের এমন আরেকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ, যেটাকে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়েই চলতে হবে। ফলে সরকারের জন্য আরেকটি বোঝা সৃষ্টি হবে। ব্যাংকের কাছে থাকুক আর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে থাকুক, মন্দ ঋণটাকে আমাদের আদায় করতে হবে। মন্দ ঋণ উদ্ধার করার প্রচেষ্টা যদি না থাকে, তাহলে যে সমাধানের কথা চিন্তা করি না কেন, সেটা সত্যিকারের সমাধান হবে না।
শেয়ারবাজারে বড় একটা ধস দেখতে পেলাম। দেড় মাসে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। এত বছরেও আমরা কেন একটা টেকসই ও স্থিতিশীল শেয়ারবাজার প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: আমাদের এখানে শেয়ারবাজারের ধস নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিছুদিন পরপর এ রকম একটা ধস নামে। এর মানে হলো শেয়ারবাজারটা এখনো স্থিতিশীল পরিবেশের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ আছে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতার অভাব রয়েছে। মানুষ শেয়ারবাজারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আস্থাহীন একটা শেয়ারবাজার কখনো আমাদের উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে না। শেয়ারবাজারে যেভাবে কারসাজি করা হয়, তার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। শেয়ারবাজারে যেসব সাধারণ বিনিয়োগকারী যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। এটা একধরনের অশনিসংকেত।
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেয়ারবাজারের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। শেয়ারবাজার সঠিকভাবে পরিচালিত হলে সেটা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু শেয়ারবাজারে যদি একের পর এক ধস নামে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যদি সর্বস্বান্ত হতে থাকেনই, তাহলে ফলাফলটা উল্টো হবে। এই যে এক মাসে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এক লাখ কোটি টাকা খুইয়ে ফেললেন, এতে নির্দিষ্টভাবে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা শ্রেণি লাভবান হয়েছে। শেয়ারের মূল্যটাকে কারসাজি করে তাঁরা অবৈধভাবে লাভবান হচ্ছেন।
শেয়ারবাজারে মূল্য ওঠানামা করা একটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু তার তো একটা সীমারেখা থাকতে হবে। নির্দিষ্ট কারণও থাকতে হবে। এখানে যেটা ঘটছে, সেটা কারসাজি। এখন প্রশ্ন হলো, এই কারসাজি কারা করছে? শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম—এমন ক্ষমতাবানেরাই সেটা করছে। একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী যেমন ব্যাংক খাতকে দুর্বল করছে ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে, একইভাবে একটা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী শেয়ারবাজারটাকে অস্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করছে, শেয়ারবাজারকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে—এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করছে এই গোষ্ঠীই।
রোজার সময় সরকার ২৯টি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে কার্যকর করতে পারেনি। চালের দাম আবার বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটা কতটা বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বাজারভিত্তিক অর্থনীতি চালু রয়েছে। আগে যেমন অনেক জায়গায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু ছিল, এখন তো সেটা নেই। যেকোনো পণ্যের মূল্য বাজারেই নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশে একটা বাজারভিত্তিক অর্থনীতি চালু রয়েছে। সরকার ২৯টি পণ্যের মূল্য বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু সেই মূল্যে সরকার ক্রেতার কাছে পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি। সেটা হওয়ার কথা নয়। কারণ, সেটা সম্ভবপর নয়। বেঁধে দেওয়া মূল্যে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছাতে হলে সরকারকেই সেটা বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারব্যবস্থার ওপর নির্ভর করলে হবে না। পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া বাজারব্যবস্থার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সেটা কার্যকর করা সম্ভব নয়।
বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। আজ আলুর দাম বাড়ল তো কাল ডিমের দাম বাড়বে। সরকার মনে করছে মূল্য বেঁধে দিলেই এই সমস্যার সমাধান হবে। বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে এটা কোনো সমাধান নয়। বরং আমাদের বের করতে হবে, কী কারণে এটা ঘটছে। সে কারণ দূর করতে পারলে মূল্যটা স্থিতিশীল হবে। বাজারে যে মূল্যশৃঙ্খল আছে, মূল সমস্যা সেখানে। বাজারে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক থেকে ভোক্তাপর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক অংশগ্রহণকারী রয়েছে। বাজারব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগটা নিয়ে মূল্যশৃঙ্খলের কোনো কোনো অংশগ্রহণকারী পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়াতে পারছে। মূল্যশৃঙ্খলের কোন জায়গায় দুর্বলতা আছে, আমাদের সেই জায়গা বের করতে হবে। সেই দুর্বলতা দূর করে বাজারের মূল্যশৃঙ্খলকে আমরা যদি প্রতিযোগিতামূলক, কার্যকর করতে পারি, তাহলে সিন্ডিকেট অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ানোর সুযোগ নিতে পারবে না। সরকার সেটা না করে পণ্যের দাম বেঁধে দিচ্ছে। সেটা আদতে কোনো কাজে আসছে না।
আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, রাজনীতি ঠিক না থাকলে অর্থনীতিও ঠিক হবে না। রাজনীতি এখন কী অবস্থায় আছে? রাজনীতি ঠিক হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছেন কি? শেয়ারবাজারে ধসের পেছনেও কি কোনো রাজনীতি আছে বলে মনে করেন?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: আমাদের মতো উন্নতিশীল দেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি—কোনোটাই কোনোটার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি প্রতিটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাজনীতিটা যদি সঠিকভাবে চলে, একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ যদি বজায় থাকে, তার একটা সুফল অর্থনীতিতে পাওয়া যায়। অর্থনীতি যদি ঠিক পথে থাকে, রাজনীতি তার থেকে উপকৃত হয়। আমাদের বর্তমান যে অর্থনৈতিক সংকট, তার পেছনে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট যেমন আছে, আবার অনেকগুলো কারণ আছে অভ্যন্তরীণ। এর মধ্যে নির্দিষ্ট করেই রাজনীতিটা একটা কারণ।
আমাদের রাজনীতিটা সুস্থকর নয়। অসুস্থ রাজনীতির কারণেও অর্থনীতি একটা সংকটে পড়েছে। সেই সংকট থেকে এখনো উত্তরণ ঘটেনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বের হয়ে কিংবা সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এনে আমরা এখনো উন্নয়নের আগের ধারায় ফিরে আসতে পারিনি। নির্বাচনের পরে আমরা রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। নির্বাচনটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। যার ফলে নির্বাচনের পরে এমন একটা স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেটা কিনা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে, সে রকম পরিবেশ আমরা দেখছি না। আগামী দিনে সেটা কতটা হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
আমাদের অর্থনীতি যে রাস্তায় চলার কথা, সেই রাস্তা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির হারটা কমেছে। আমাদের যেখানটায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ৭, ৮, ৯ শতাংশ; সেখানে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। কোভিডের পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা প্রবৃদ্ধির সঠিক পথরেখায় ফিরে যেতে পারিনি। আর্থিক খাত থেকে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ—কোনো জায়গাতেই আমরা আগের অবস্থানে যেতে পারিনি। আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপথে যাওয়ার জন্য যে রকম স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দরকার, সেটা অর্জিত হয়নি।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সব দ্বিধা কেটে গেছে। অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
মুস্তফা কামাল মুজেরী: এটা আসলে একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। কোনটাকে সমস্যা বলব আর কোনটাকে সমস্যা বলব না, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। অর্থনীতিতে সমস্যা নেই—এই বিবৃতি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, সেটা হলো অর্থনীতির যে বিশেষ দিকগুলো দেখা দরকার, সেগুলো সঠিকভাবে দেখা হচ্ছে না। গত কয়েক বছর আমাদের অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো প্রকটভাবে দেখা গেল, সেগুলো কি কেটে গেছে? আমরা যদি মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখব যে প্রায় দুই বছর ধরে আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বের হতে পারিনি। আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। ব্যাংক খাতের দুর্বলতা থেকে আমরা বের হতে পেরেছি? শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে বের হতে পেরেছি? বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি বাড়াতে পেরেছি?
পৃথিবীতে এমন কোনো অর্থনীতি নেই, যেখানে সমস্যা থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, চীনের অর্থনীতি, রাশিয়ার অর্থনীতি—সব অর্থনীতিতেই সমস্যা রয়েছে। সেটাই সত্য। সমস্যাগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে, সেটাই বাস্তবতা। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে, আমাদের উন্নয়নকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারব না। সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। সমস্যা অস্বীকার করা খুব একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হবে না।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কি ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করেন? উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন কি?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, সেটা স্বল্প সময়ের মধ্যে ২০ বিলিয়নে নেমেছে। অনেক কারণে এটা ঘটেছে। আমরা এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়নে ধরে রেখেছি, তার জন্য আমাদের অনেক সংকোচনমূলক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। আমদানিটাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। আমদানি আমাদের অর্থনীতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। আমাদের এখানে কাঁচামাল থেকে শুরু করে উৎপাদনের জন্য যে যন্ত্রাংশ দরকার, তার প্রায় সবটাই আমদানি হয়ে আছে। জ্বালানির একটা বড় অংশ আমদানি করতে হয়। খাদ্যপণ্যও আমাদের আমদানি করতে হয়।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যাতে আরও কমে না যায়, তার জন্য আমদানিটা কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রেখেছি। এটা সাময়িকভাবে করা যেতে পারে। কিন্তু নীতিটাকে দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণ করলে সেটা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরূপ ফলাফল নিয়ে আসবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব নীতি—সবটা মিলিয়ে সামগ্রিক একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যদি আমরা না নিয়ে আসতে পারি, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপটা থাকবেই।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্স একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি তো বাড়ছে না।
মুস্তফা কামাল মুজেরী: রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি না বাড়ার ক্ষেত্রে বিনিময় হার একটা বড় ভূমিকা রাখছে। সাধারণভাবে এখানে রেমিট্যান্স বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধ পথে বা হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। অবৈধ পথে বা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো যদি লাভজনক হয়, তাহলে সেই পথেই রেমিট্যান্স আসবে।
গত দু-তিন বছরে আমাদের যে সংখ্যক লোক বিদেশে গেছেন, তার সঙ্গে রেমিট্যান্সের প্রবাহকে যদি তুলনা করি, তাহলে রেমিট্যান্স আরও অনেক বেশি আসার কথা। এই যে লোকগুলো যাঁরা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমিক। তাঁদের বেশির ভাগই ঋণ করে গেছেন। তাঁদের সেই টাকা শোধ করতে হচ্ছে। পরিবারের কাছেও টাকা পাঠাতে হচ্ছে। সেই টাকা পাঠাতে তাঁরা বাধ্য। তাঁরা সেই টাকা পাঠাচ্ছেনও। কিন্তু সেটা বৈধ পথে আসছে না। সেটাই মূল সমস্যা। সেই আয় বৈধ পথে আনতে গেলে বিনিময় হারটা প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। আমরা এখন সেই বিনিময় হারটাকে ধরে রাখছি। বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে আমরা যেতে পারিনি। এখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ অনেক বেড়েছে। ব্যাংক আছে, ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠানো যাচ্ছে। বিনিময় হারটা বাজারভিত্তিক করা গেলে বৈধ পথে রেমিট্যান্সের প্রবাহ অনেক বেড়ে যেত।
আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এই চাপটা আরও বাড়বে। এই চাপ আমরা কীভাবে সামলাব?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: ইআরডির তথ্য–উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দুই–তিন বছরের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। আমরা এসব ঋণ বহুপক্ষীয় সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি থেকে না নিয়ে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে নিয়েছি। এসব ঋণ পরিশোধ করার সময়সীমা কিন্তু কম। এসব ঋণ পরিশোধের পরিমাণ আগামী বছরগুলোতে ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে।
রিজার্ভের ওপর অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি হবে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দুটো উৎস—রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়। আমাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রধান দুর্বলতা হলো আমাদের দেশ মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর। আবার সেই বাজারও খুব বিস্তৃত নয়। রপ্তানি বহুমুখী করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটি সেভাবে সফল হয়নি। এ ক্ষেত্রে যে নীতি ও চেষ্টা তা যথেষ্ট নয়। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই অদক্ষ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল। দেশটি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল? আমরা তাদের থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি?
মুস্তফা কামাল মুজেরী: শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি খাদের কিনারে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই জায়গা থেকে দেশটি দ্রুত উঠে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধ ও টেকসই। বিভিন্ন সূচকে তারা এগিয়ে আছে। শ্রীলঙ্কা কিছু ভুল নীতি নিয়েছিল, সেটা সংশোধন করেই দ্রুত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করেছে। শ্রীলঙ্কা থেকে আমরা যে শিক্ষাটি নিতে পারি, সেটা হলো সমস্যার স্বীকৃতি দেওয়া। সমস্যা অস্বীকার করলে সমস্যার সমাধান আসবে না।
আমাদের দুর্বলতা হলো অনেক ক্ষেত্রে অনেক ভালো নীতি নিই। কিন্তু সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি না। একটা গোষ্ঠী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যখন তারা দেখে যে নীতি তাদের পক্ষে যাচ্ছে না, তখন তারা সেটা নাকচ করে কিংবা বাধাগ্রস্ত করে। এর বড় উদাহরণ মন্দ ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকও এটা কমিয়ে আনার কথা বলেছে। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করতে গেলে ওই গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত আসবে। আলু–পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ নেই। গোষ্ঠীবিশেষের বাধার কারণে আমাদের অনেক নীতিই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি বেগবান করতে চাইলে এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতেই হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মুস্তফা কামাল মুজেরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।