বিশেষ সাক্ষাৎকার : সাঈদ ফেরদৌস

সংস্কার না হলে দেশ উল্টো পথেই যাত্রা করবে

সাঈদ ফেরদৌস। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপ-উপাচার্য। এর আগে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর লেখালেখি ও গবেষণার বিষয় সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশ বিভাগ। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের গতিপ্রকৃতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই শিক্ষাবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো:

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তন কী হলো? 

সাঈদ ফেরদৌস: এই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্ররা পুরো ভাগে ছিলেন। এরপর কিন্তু জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশ নেয়। কয়েক দিন আগেও মনে হতো, শেখ হাসিনার সরকার বোধ হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁকে সরানো গেছে। আন্দোলনের পেছনে তো জনগণের বিরাট আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা হলো, আমরা এ রকম দেশ চাই না, আমরা এ রকম ভয়াবহ দুর্নীতি, নজিরবিহীন নিপীড়ন ও কণ্ঠরোধ আর দেখতে চাই না।

এখন অনেকে অনেক রকমভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন। কেউ বলবেন স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে, কেউ বলবেন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। আসলে গণঅভ্যুত্থানের পর কী ঘটতে পারে, তা আমাদের অভিজ্ঞতায় ছিল না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গেও ৫ আগস্টকে মেলানো যাবে না। নব্বইয়ে এতসংখ্যক মানুষ মারা যায়নি। এতসংখ্যক মানুষও রাস্তায় নামেননি। পাঁচ সপ্তাহের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে আমরা হতবাক হয়ে যাই। একজন শাসক তার নিজ জনগোষ্ঠীর ওপর কীভাবে এরকম হত্যা-নির্যাতন চালাতে পারে? 

এরশাদের সময় তো একটা লাশ পড়লে তোলপাড় হয়ে যেত। এবারে এক ঘণ্টায় কত লোক মারা গেল। এরশাদের সময়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সমাজের সেই অংশ, আমরা যাদের বিবেক, অগ্রবর্তী ও প্রগতিশীল অংশ মনে করি; এবার কিন্তু তারা নেতৃত্বে ছিলেন না। বরং আমরা যাদের পশ্চাৎপদ অংশ ভাবতাম, তারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। 

প্রথম আলো:

পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। 

সাঈদ ফেরদৌস: ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন এবং আমরা বিজয় উৎসব করছি, তখনো জানি না ওই দিনও কত মানুষ মারা গেছেন। তত্ত্বগতভাবে আমরা জানি, স্বৈরশাসকের কবলে পড়লে একটা দেশের অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা তার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি নাই। রাষ্ট্রযন্ত্রের সবখানে ঘুণ ধরে গেছে। যারা ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘটালেন, তারাও তো পনেরো বছর হাসিনার শাসনের অধীন বসবাস করেছেন। এই সময়ে তো বাংলাদেশের মানুষ আপস করতে শিখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা র‍্যাগিংয়ের মতো ভয়াবহ অবস্থা মেনে নিয়েছে। তারা তো এই লোভ ও ভয়ভীতির বাতায়নে তৈরি হওয়া মানুষ। আমরা এই বাস্তবতায় রাতারাতি বিশাল কোন পরিবর্তন হবে, তা কী করে আশা করতে পারি?

প্রথম আলো:

ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবার বিজয় দিবস উদ্‌যাপিত হচ্ছে। এর ভিন্ন তাৎপর্য আছে বলে মনে করেন? 

সাঈদ ফেরদৌস: আওয়ামী লীগ ১৫ বছরের শাসনে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবসকে তাদের ক্ষমতার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হাস্যকর অভিধায় পরিণত করেছে। তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্সি দাবি করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ ছিল, যাতে দলমত-নির্বিশেষে সমগ্র জাতি অংশ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় যুদ্ধে ও ব্যবসার উপাদানে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটাও হাস্যকর করে তুলল। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চে তো আমরাও ছিলাম। যতই দিন যেতে লাগল, এটাকেও তারা দলীয়করণ করে ফেলল। আওয়ামী লীগ এটাকে যখন বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তখনই ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই যে প্রবঞ্চনা, তার অবসান ঘটল ৫ আগস্ট। সেই কারণেই এই বিজয় দিবস নতুন স্বপ্ন ও নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে হাজির হলো। 

প্রথম আলো:

১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের মধ্যে যোগসূত্র বা ভিন্নতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? 

সাঈদ ফেরদৌস: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে সাতচল্লিশ ও একাত্তর পরস্পরের অ্যান্টিথিসিস। সাতচল্লিশকে মনে করা হয় পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকে যাওয়া।

কিন্তু আমরা বলতে চাই, সাতচল্লিশও মুক্তির লড়াই ছিল। কিন্তু সাতচল্লিশের পর বায়ান্নো, উনসত্তর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। বাংলাদেশের মানুষ মুসলিম লীগকে সাত বছরের মধ্যে ছুঁড়ে ফে্লে দিয়েছে। কিন্তু সাতচল্লিশ তো বাঙালি মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল শ্রেণি হিসেবে তার বিকাশ, চাকরির সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি, হিন্দু সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসা-- ইত্যাদিকে ঘিরে। আমরা সেই সত্যকে এত দিন স্বীকার করিনি।

আমাদের মনে রাখতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সমাজে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা যাদের সমাজের প্রগতিশীল ও অগ্রসর শ্রেণি মনে করেছি, তারা একে অস্বীকার করেছে। কিন্তু সমাজের বৃহত্তর অংশ তো তা মনে করে না। আমরা মনে করেছি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে যে বৃহত্তর জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছি, এটাই শুভ। কিন্তু আমরা তো সমাজের বৃহত্তর অংশকে সেখানে নিয়ে আসতে পারিনি। ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকান, শ্রীলঙ্কায়ও ধর্মের আধিপত্য প্রবল।

প্রথম আলো:

কিন্তু নেপাল তো অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা ধর্মভিত্তিক দেশ থেকে সেক্যুলার দেশ হয়েছে। 

সাঈদ ফেরদৌস: সেখানকার জনগণ চেয়েছে বলে সেটি হয়েছে। জনগণ না চাইলে সেটা হতো না। আমাদের এখানে সাতচল্লিশকে এভাবে মুছে দেওয়া একটা বড় বোকামি হয়েছে। এটা রাজনৈতিক ভ্রান্তি ছিল। তবে আপনি যদি পক্ষ-বিপক্ষ বিচার করেন, বলতে পারেন যে সাতচল্লিশে ওই পক্ষ বিজয়ী হয়েছে, একাত্তরে অন্য পক্ষ। কিন্তু এই পক্ষ-বিপক্ষের উর্ধে উঠে বিহারিদের কথা ভাবুন। সাতচল্লিশে জিতল, একাত্তরে হেরে গেল। আর একাত্তরে যারা জিতেছে বলছি, সেই হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ কী করেছে; ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য কী করেছ? কিছু করেনি।

প্রথম আলো:

অনেকের অভিযোগ, চব্বিশকে একাত্তরের বিপরীতে দাঁড় করানো চেষ্টা হচ্ছে। আপনার মন্তব্য কী? 

সাঈদ ফেরদৌস: চব্বিশের আন্দোলনকে কেউ যদি একাত্তরের বিপরীতে দাঁড় করাতে চায়, একাত্তরকে ঢাকতে চায়, সেটা ভ্রান্তি হবে। 

প্রথম আলো:

আপনি প্রথম আলোর একটি লেখায় বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ নিয়ে পুনর্ভাবনা প্রয়োজন। সেই পুনর্ভাবনাটা কী? 

সাঈদ ফেরদৌস: শুরুতেই বলে নেই, আমি কিন্তু জাতীয়তাবাদী নই। জাতীয়তাবাদ তখনই চলে, যখন এটি ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। জাতীয়তাবাদ যখন মাঠে লড়াইয়ের শক্তি, তখন গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয়তাবাদের বিপদ হচ্ছে, সে একটি স্মারক বাদে অন্য সকল কিছুকে অস্বীকার করে। জাতিরাষ্ট্রের একটি গ্রহণবর্জনের রাজনীতি থাকে এবং কোনো জাতীয়তাবাদই শেষ বিচারে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়না। সবাইকে একত্র করতে পারেনা।

আজ যাঁরা দায় ও দরদের রাজনীতির কথা বলছেন, যাঁরা সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্তি করতে চাইছেন, তাঁদের এবিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। একদিকে আমরা দায় ও দরদের কথা বলছি, অন্যদিকে আমাদেরই কোন কোন সহযোদ্ধা যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কিংবা সংখ্যালঘুকে হেনস্তা করে তখন তো দায় ও দায়দের রাজনীতিকে আরও সোচ্চার হতে হবে। আর তা যদি না হয়, পুরো আন্দোলনই মাঠে মারা যাবে।

প্রথম আলো:

চব্বিশের আন্দোলন অনেক আশা জাগিয়েছে। এর কোনো ঝুঁকির দিক আছে কি? 

সাঈদ ফেরদৌস: চব্বিশের আন্দোলনের একটা বড় শক্তি ইসলামপন্থীরা হওয়াতে আমরা যারা নিজেদের সমাজের অগ্রবর্তী মানুষ মনে করে থাকি, তাদের অনেকেই আশংকা করছেন, এই বুঝি ধর্মনিরপেক্ষতা গেল, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত সব চলে গেল। আমি সেটা মনে করি না। মাঠে অনেক রকম শক্তি ক্রিয়াশীল। এই আন্দোলনে বহু মত ও পথের মানুষ ছিলেন, আছেন। কেউ কেউ খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলেন; আমি মনে করি না, তারা বৃহত্তর অংশের সমর্থন পাবেন। এমনকি ধার্মিক মানুষও চাইবে না খেলাফতের রাজনীতি এখানে চালু হোক। বিভিন্ন ডানপন্থী দলের মধ্যে বিভাজন আছে, তর্ক আছে। আবার তাদের কারো কারো মাঝে উদার রাজনীতি বিকাশের সম্ভাবনাও আছে। অন্যদের মতকে অগ্রাহ্য করে কেউ এককভাবে তার মতটা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, এই দফায় এমনটা হবে বলে মনে করিনা।

প্রথম আলো:

৫ আগস্টের পর বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করছেন কি? 

সাঈদ ফেরদৌস: বিএনপি ও জামায়াত লিবারেল ডেমোক্রেসির চর্চা করতে চায় বলে আমার ধারণা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে যে ধরনের সংযম ও সহিষ্ণুতার কথা বলা হচ্ছে, সেটা সবার চোখে পড়েছে। জামায়াতও সহিষ্ণুতার কথা বলছে। বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার কথা বলছে, তারা যে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলছে, ভারতের পক্ষ থেকে আসা সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায়ও দল ও নাগরিক হিসেবে তারা যে অবস্থান নিয়েছে, আমি তাকে ইতিবাচক বলে মনে করি। এটা, আমি বলব ৫ আগস্টের ফল। এর আগে এই দলগুলো যে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তাতে করে হয়তো তাদের এই উপলব্ধি হয়েছে যে বাংলাদেশকে আর স্বৈরশাসনে ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। বাংলাদেশ এত রক্তপাত দেখেছে, অনাচার দেখেছে, এরপর রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহিষ্ণুতার কথা না বলে, আত্মসমালোচনা না করে, তাহলে টিকে তারা থাকতেই পারবে না।

প্রথম আলো:

সমাজে এমন আলোচনা আছে যে ৫ আগস্টের পর ঢালাওভাবে অনেক কিছু বাদ দেওয়া বা মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। আপনার মন্তব্য কী? 

সাঈদ ফেরদৌস:  এটা হয়নি, আমি তা বলব না। ৫ আগস্ট সমগোত্রীয় শক্তি ঘটায়নি। এদের মধ্যে বহু রকমের উপাদান ছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুছে ফেলার রাজনীতি করছে। পাঠ্যপুস্তক পরিবীক্ষণ সমন্বয় কমিটি নিয়ে যা হলো, খুবই অন্যায়। সরকার যেভাবে পিছু হটল, সেটা দুঃখজনক।

মনে রাখতে হবে ৫ আগস্টে বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। ৫ আগস্ট ছিল আন্দোলনের শীর্ষবিন্দু। বিপ্লব হলে তো বিপ্লবী সরকার গঠিত হতো। আমরা সরকার গঠনের নেপথ্যে নানা ধরনের যোগাযোগ হতে দেখলাম, ছয় ঘণ্টা বিমানবন্দর বন্ধ থাকল। অনেকেই পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। কিছু মানুষকে সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হলো-এসব বিপ্লবের চিহ্ন নয়। ৫ আগস্ট বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিপ্লব হয়নি। আমার এক বন্ধু সেদিন বলছিলেন যে, ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়ানকে আসতে ১০ বছর সময় লেগেছিল। তাই আমরা যাতে অধৈর্য হয়ে না পড়ি।

আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্যও ধরে রাখতে হবে। সত্য হলো, মুছে ফেলার রাজনীতির বিরুদ্ধে যেমন দাঁতভাঙা জবাব কেউ দেয়নি, আবার যাঁরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা এটাকে উৎসাহিতও করেননি। করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। এমনকি ব্রিগেডিয়ার আযমী যখন জাতীয় সংগীত বদলানোর কথা বললেন, জামায়াতে ইসলামী কিন্তু তাঁকে সমর্থন করল না।

প্রথম আলো:

আমরা অতীতে দেখেছি যে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সমাজের অগ্রবর্তী অংশ বড় ভূমিকা রেখেছেন, এবারে তার ব্যতিক্রম হলো। তাঁরা অনেকটা পেছনের সারিতে ছিলেন। 

সাঈদ ফেরদৌস: শেখ হাসিনা খুব সহজ রাস্তা নিয়েছিলেন। অনেকটা ভাত ছিটালে কাকের অভাব হবে না—এই নীতি। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন বাড়ালেন, কিন্তু কাজের জবাবদিহি বাড়ালেন না। শিল্পী সাংবাদিকদের মাঝে টাকা ছিটিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিনি টাকা দিয়ে সয়লাব করে দিলেন, কিন্তু গবেষণায় কোনো অর্থ দিলেন না। বিল্ডিং বানাতে টাকা দিলেন। বিল্ডিং বানানো মানেই হলো লুটপাট। আরেকদল ছিলো, যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের ওপর চরম নির্যাতন নেমে এসেছে, তাতে অন্যরা প্রতিবাদ করতে ভয় পেয়েছেন। এই যে তথাকথিত অগ্রসর অংশের অনুপস্থিতি, আমি বলব, এটাই ছিল আন্দোলনের অনন্যতা। প্রথম দিকে ছাত্ররা নেতৃত্ব দিলেও আন্দোলন হলো সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণে। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের হিসাব নিয়ে দেখেন, বেশির ভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। ছাত্ররা মারা গেছেন। নামহীন-গোত্রহীন মানুষ মারা গেছেন। শিক্ষকদের মধ্যে কজন আওয়াজ তুলেছেন? চাকরিজীবী পেশাজীবীরা চুপ ছিলেন।

প্রথম আলো:

আপনি এই আন্দোলনে সাধারণ মানুষের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা বললেন। সেই মানুষের সামনে কোনো সম্ভাবনা আছে কি? 

সাঈদ ফেরদৌস: এখনো নেই। তারা তো দীর্ঘ মেয়াদে কী হবে, সে জন্য অপেক্ষা করতে পারেন না। তারা দেখছে্ন, বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় খাবারটি কিনতে পারছে কি না। তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন, বলবেন, কোনো লাভ হয়নি। আরও খারাপ হয়েছে। আমরা বলছি আন্তর্জাতিক বাজার, যুদ্ধ ইত্যাদির কথা। কিন্তু তারা তো এত কিছু বুঝতে চাইবে্ন না। আমি মনে করি, সরকার তাদের দারুণভাবে হতাশ করেছে। অথচ এই সরকারের গণভিত্তি ছিল অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসা এই সরকারের আরও বেশি সাহসী ও দৃঢ় ভূমিকা নেওয়ার কথা। বিশেষ করে বাজার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। দুই ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেট মোকাবিলা করতে সরকারের উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করা। অনেক পরে ভারত ইস্যুতে তারা সেটি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কার্যকর সংলাপের উদ্যোগ শুরু থেকেই ছিল না। প্রফেসর ইউনূসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বাজার নিয়ন্ত্রণ তাঁর কাজ নয়। এই সরকারের পক্ষে সেটি সম্ভবও নয়। তাদের উচিত ছিল শুরু থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে কাজ করা। এক্ষেত্রে একটা স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা যেত।

প্রথম আলো:

দীর্ঘদিন আপনি শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পদে আছেন। অনেকেই বলেন, শিক্ষার অবস্থা শোচনীয়। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের উদ্যোগ নেই। 

সাঈদ ফেরদৌস: দীর্ঘদিন আপনি শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পদে আছেন। অনেকেই বলেন, শিক্ষার অবস্থা শোচনীয়। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের উদ্যোগ নেই।
সাঈদ ফেরদৌস: আমি নিজেই এ নিয়ে খুশী নই। আরও অন্তত দুটো বিষয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছিল-শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সর্বত্র দুর্নীতি। এগুলোয় হাত দেওয়া অপরিহার্য ছিল। শিক্ষকদের একটা অংশ বছরের পর বছর ক্লাস না নিয়ে বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে বেতন দেওয়া হয়, তা দিয়ে তো একজন শিক্ষকের সংসার চলে না। আপনি শিক্ষকদের ভালো বেতন দেবেন না, জবাবদিহির মধ্যে আনবেন না, ভাববেন শিক্ষার উন্নতি হবে-- এটা কী করে হয়! কলেজগুলোয় মাসের পর মাস ক্লাস হয় না। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য মহৎ মানুষ তৈরি করা। আরেকটি উদ্দেশ্য পুঁজিবাদী বাজারে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। আমাদের তো এত এত ডিগ্রিধারী বেকারের তো প্রয়োজন নেই। অন্তর্বতী সরকারের সময়ও যদি শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র না ভাবে, তাহলে কখন ভাববে?

প্রথম আলো:

নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন দ্রুত নির্বাচন হওয়া উচিত। কারও মতে সংস্কারকাজ শেষ করেই নির্বাচন হতে হবে। আপনার মতামত কী? 

সাঈদ ফেরদৌস: সরকার অনেকগুলো ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে তারা এগোতে পারছে্ন না। এ কারণে জনগণ ভাবছেন রাজনৈতিক সরকার এলে এসব সমস্যার সমাধান হবে। এ কারণে দ্রুত নির্বাচনের দাবিটি সামনে এসেছে। আমি মনে করি, নির্বাচনের আগে কিছু বিষয়ে মৌলিক সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। পুলিশ, জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং সংবিধান তার মধ্যে অন্যতম। সাবেক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ব্যবসায়ী দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে। তাদের অনেকেরই কেশাগ্র স্পর্শ করা যায়নি। আমরা শুনতে পাচ্ছি, তাদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে, চ্যানেলের হাতবদল হচ্ছে, ব্যাংকের হাতবদল হচ্ছে। সংস্কার না হলে তো দেশ উল্টো পথেই যাত্রা করবে। এগুলো কোনোভাবে কাম্য ছিল না। সরকার যদি ঘোষণা দেন, যে তার সংস্কার কাজ শেষ হতে এত দিন লাগবে এবং এরপর নির্বাচন হবে, তাহলে হয়তো মানুষ আশ্বস্ত হবে।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ। 

সাঈদ ফেরদৌস: আপনাকেও ধন্যবাদ।