প্রথম তিন দফা ভোটের পর একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেকায়দায় পড়েছেন। ২০১৯ সালেও একই রকম একটা গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, অন্তত পুলওয়ামার ঘটনার আগে। এই গুঞ্জনের কি আদৌ কোনো যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে, নাকি এটা মোদিবিরোধী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটা অংশের আশাবাদের বহিঃপ্রকাশ?
দেবাশীষ রায়চৌধুরী: ২০১৯ এবং ২০২৪-এর নির্বাচন দুটি সম্পূর্ণ পৃথক নির্বাচন। ২০১৯ সালে অবশ্যই পুলওয়ামার আবেগের ভিত্তিতে নির্বাচনী লড়াই অনেকটাই হয়েছিল। একটা ‘যুদ্ধের আবহ’ তৈরি ছিল, যা যুক্তি দিয়ে ভেবেচিন্তে ভোট দেওয়ার প্রবণতাকে অনেকটাই চেপে ধরেছিল।
২০২৪ সালের পরিস্থিতি সেটা নয়। ২০১৯ সালে একটি সামগ্রিক অনুভূতি ছিল যে মোদির আরও সময়ের প্রয়োজন। এই অনুভূতিকে তিনি ভালোভাবে কাজেও লাগিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে ৭০ বছরের অরাজকতাকে মাত্র পাঁচ বছরে (২০১৪-১৯) তিনি কীভাবে শুধরে দেবেন।
এই যুক্তি এবার আর মানুষ নিচ্ছে না। ১০ বছরের যদি আপনি কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তন না আনতে পারেন, তবে আর কখনো আনতে পারবেন না—মানুষ হয়তো এবার এটাই ভাবছে। আমার মনে হয়, এ ছাড়া আরও দুটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।
এক. সাম্প্রদায়িকতা—এই বিষয়টিকে বিজেপি বড় বেশি ব্যবহার করে ফেলেছে। এর ফলে এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা ক্লান্তি বা একঘেয়েমি তৈরি হয়েছে।
দুই. দেশের অর্থনীতির কোনো বিশেষ উন্নতি হচ্ছে না, কর্মসংস্থান বা চাকরির সংকটও কমছে না। সার্বিক সঞ্চয় ঐতিহাসিকভাবে এতটা কম কখনো ছিল না। মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ফলে এবারের নির্বাচনের সময় সামগ্রিক চিত্রটা ২০১৯-এর থেকে একেবারেই আলাদা।
(গত ২৪ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘হাউ ইন্ডিয়াস ইকোনমি হ্যাজ রিয়েলি ফেয়ার্ড আন্ডার মোদি’ প্রবন্ধে দেবাশীষ রায়চৌধুরী মোদির নেতৃত্বে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা তুলে ধরেছেন।
পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় অর্থনীতি উদারীকরণের পরে জিডিপির হার মোদির দ্বিতীয় মেয়াদে সর্বনিম্ন এবং মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি গত ১০ বছরে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন এক দশকের তুলনায় অর্ধেক। পাশাপাশি শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীর আয় কমেছে, হ্রাস পেয়েছে বিদেশি ও বেসরকারি পুঁজির লগ্নি। কমেছে ক্রয় ক্ষমতাও, যেমন কমেছে পরিবার পিছু সঞ্চয়ের পরিমাণ। চাপে রয়েছে ব্যাংকও। কারণ, মানুষ টাকা রাখছে কম। অন্যদিকে বেড়েছে কর্মহীনতা।)
আপনি কি মনে করেন যে গত কয়েক সপ্তাহে কংগ্রেসের দুর্বলতা কিছুটা কমেছে এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে?
দেবাশীষ রায়চৌধুরী: আমি মনে করি, সাংগঠনিকভাবে কংগ্রেস আরও অনেক ভালো করতে পারত। তবে যোগাযোগের দিক থেকে তারা ভালোই করেছে। তারা যে এখন ন্যারেটিভ (বক্তব্য বা আখ্যান) নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, এটা একটা বিরাট ব্যাপার। তাঁরা মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা নিয়ে কথা বলে অবশ্যই একটা বার্তা দিয়েছে যেটা বিজেপি একেবারেই স্পর্শ করেনি।
প্রাক্-নির্বাচন জরিপগুলো দেখিয়েছে যে বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি ভোটারদের জন্য উদ্বেগের প্রধান কারণ। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কংগ্রেসকে বারবার স্পর্শকাতর ও সাম্প্রদায়িক বিতর্কে টেনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সব চেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেস বারবারই অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেছে এবং ক্ষমতায় এলে তাদের কর্মসূচি কী হবে, তার ওপর গুরুত্ব দিয়েই তারা তাদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
আমার মনে হয়েছে যে প্রতিটি দফার নির্বাচনের পর কংগ্রেসের আত্মবিশ্বাস উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই আত্মবিশ্বাস বাড়ার আরও একটা কারণ হতে পারে, যত সময় যাচ্ছে, তত আরও বেশি করে স্পষ্ট হচ্ছে, কোনো ‘মোদি হাওয়া’ সেই অর্থে নেই।
তৃতীয় মেয়াদে ভারতের জন্য বিজেপির কোনো পূর্ণাঙ্গ দীর্ঘমেয়াদি নীতি বা পরিকল্পনা নেই। বিজেপির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ অবশ্যই হিন্দু রাষ্ট্র, যার জন্য সংবিধানের আমূল রূপান্তর প্রয়োজন। এটি এমন একটা বিষয় নয় যা নিয়ে বিজেপি খুব বেশি কথা বলতে পারে বা খুব বেশি চর্চা করতে পারে। কিন্তু আবার এটা ছাড়া তাদের বলার মতো কিছু নেইও। এই কারণেই আমরা এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে বিশেষ কিছু শুনিনি যে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে বিজেপি কী কী কাজ করতে চায়।
তিন দফা ভোটের পর এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুব একটা জোর দিয়ে বলতে দেখা যাচ্ছে না যে বিজেপি ৩৭০ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স ৪০০ আসন পাবেই। বরং প্রথম পর্বের নির্বাচনের পরে তিনি অনেকটাই সাম্প্রদায়িক বক্তব্য রাখছেন বলে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ উঠছে। এই ৩৭০ আসনের দাবি গোড়া থেকেই একটা অবাস্তব দাবি ছিল, নাকি এর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল? এখন এই দাবির আর বিশেষ গুরুত্ব নেই কেন? দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা থেকে আমরা কী বার্তা পেতে পারি?
দেবাশীষ রায়চৌধুরী: ভারতীয় ভোটারদের সম্পর্কে যে জিনিসটি লক্ষ করা গেছে; তা হলো, তাঁরা বেশির ভাগই ‘আনকমিটেড’ (নির্দিষ্ট দলের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়) ভোটার। তাঁরা সাধারণত সেই দলকেই ভোট দেন, যে দল বা যে দলের প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ, যাঁর জেতা উচিত বলে তাঁরা মনে করেন, তাঁকে ভোট না দিয়ে এমন দল বা প্রার্থীকে দেন, যাঁর জেতার সম্ভাবনা বেশি।
এর পেছনে যে যুক্তিটা কাজ করে, তা হলো, তাঁরা তাঁদের ভোট নষ্ট করতে চান না। সুতরাং, একটি দল বা প্রার্থী যত বেশি তাঁদের জয়ের সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে পারবেন বা প্রকাশ্যে আনতে পারবেন, তাঁদের জেতার সম্ভাবনাও তত বেড়ে যাবে।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির লক্ষ্য ছিল ২০০ আসন পাওয়া। তাদের এই দাবি হাস্যকর ছিল। কারণ, সে সময়ে বিধানসভায় তাদের তিনটি আসন ছিল। কিন্তু এই ‘প্রজেকশন‘ খুবই সফল হয়েছিল, কারণ, শেষ পর্যন্ত তারা তিন থেকে সত্তরের ওপরে আসন পেয়েছিল।
সে সময়ে অনেকেই মনে করেছিলেন, এটি বিজেপির বিরাট পরাজয়। কারণ, তারা ২০০ আসনের লক্ষ্য নির্ধারিত করে শেষ পর্যন্ত ৭০-এর কিছু বেশি আসন পেয়েছে। কিন্তু যাঁরা এ কথা বলেছিলেন, তাঁরা এটা ভেবে দেখেননি যে এটা কত বড় জয়। একটা দল রাতারাতি ৩ থেকে ৭০-এর ওপরে চলে গেল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ, তারা মানুষকে বোঝাতে পেরেছি যে তারা জয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছিল ওই ‘টার্গেট ২০০’ স্লোগান দিয়েই।
ফলে ‘আব কি বার ৪০০ পার’ (এবারে ৪০০ পার) বা ‘বিজেপি পাবে ৩৭০’- এই ধরনের সব স্লোগান দেওয়া হয়েছে একটা ‘আবহাওয়া’ তৈরি করার জন্য, যাতে এটা মনে হয় যে বিজেপির ৩৭০ বা এনডিএর ৪০০ পাওয়াই তো স্বাভাবিক। আর এটা ধরে নিয়ে মানুষ যাতে ভোট দেয় সেটা মাথায় রেখেই এটা করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক প্রচারণার প্রসঙ্গে আসি। সাম্প্রদায়িক প্রচারণা প্রধানত আমাদের তিনটি জিনিস দেখিয়ে দিচ্ছে। এক. বিজেপির ১০ বছরের ক্ষমতায় দেখানোর মতো বিশেষ কিছুই নেই।
দুই. যে ভোটটা তাদের নিশ্চিত ভোট নয়, মানে যে ভোটটা যে কোনো দিকে যেতে পারে, সেই ভোটের কথা ভুলেই যান; বিজেপি এখন এমনকি এটা বুঝতে পারছে যে তাদের প্রতি সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভোটারও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ফলে এই সাম্প্রদায়িক বিবৃতি বা ভাষণ জরুরি হয়ে পড়ছে, যাতে বিজেপির এই সমর্থকদের সম্পূর্ণভাবে ধরে রাখা যায়।
তিন. তৃতীয় মেয়াদে ভারতের জন্য বিজেপির কোনো পূর্ণাঙ্গ দীর্ঘমেয়াদি নীতি বা পরিকল্পনা নেই। বিজেপির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ অবশ্যই হিন্দু রাষ্ট্র, যার জন্য সংবিধানের আমূল রূপান্তর প্রয়োজন। এটি এমন একটা বিষয় নয় যা নিয়ে বিজেপি খুব বেশি কথা বলতে পারে বা খুব বেশি চর্চা করতে পারে। কিন্তু আবার এটা ছাড়া তাদের বলার মতো কিছু নেইও। এই কারণেই আমরা এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে বিশেষ কিছু শুনিনি যে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে বিজেপি কী কী কাজ করতে চায়।
প্রথম তিন দফায় ভোটের হার কম। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
দেবাশীষ রায়চৌধুরী: ভোটারদের মধ্যে উদাসীনতা দেখাই যাচ্ছে। বিজেপির প্রতি গভীর হতাশা স্পষ্ট, কিন্তু বিরোধীদের জন্যও বিরাট কোনো উৎসাহ নেই। এখানে একটা বড় প্রশ্ন হলো মানুষ আসলে কতটা আসলে বিক্ষুব্ধ। এটা বলা সব সময়ই কঠিন এবং অঞ্চলভেদে এটার একটা পরিবর্তন হয়। মানুষ কি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য তৈরি? তারা কি যথেষ্ট ক্ষুব্ধ?
যদি খুব বেশি ভোট পড়ত, তাহলে হয়তো সেটা বলা যেত। কম ভোট থেকে এটা বলা সম্ভব না যে মানুষের মধ্যে বিজেপিকে হারানোর জন্য একটা তীব্র ইচ্ছা তৈরি হয়েছে। অবশ্যই তাদের মধ্যে একটা স্বপ্নভঙ্গের ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু সেই স্বপ্নভঙ্গের ফলে বা তাদের আশা পূর্ণ না হওয়ার ফলে বিজেপি যে ভোট পাবে না এবং হারবেই—এটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
আমি যেমন আগেই বলেছি, নির্বাচনে হার-জিতের বিষয়ে অনুমান করা সব সময়ই কঠিন। মনে রাখা প্রয়োজন, এটা জাতীয় নির্বাচন হলেও একাধিক স্থানীয় কারণও এই নির্বাচনে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই এমন রাজ্যের একজন ভোটারের বিজেপির প্রতি বিরক্ত হওয়ার কারণ কম। তাঁর সমস্যার জন্য বিজেপিকে দোষারোপ করার কারণও তাঁর কাছে কম।
মোদি এখনো ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক তারকা, যাকে দেখতেই অনেক মানুষের ভিড় হয়। দল হিসেবে বিজেপি কি সম্পূর্ণভাবে এই নির্বাচনে তাঁর ওপর নির্ভরশীল?
দেবাশীষ রায়চৌধুরী: হ্যাঁ, অনেকটাই তা-ই। আপনি বিজেপির ইশতেহারে দেখতে পাবেন যে প্রতিটি অধ্যায়ই মোদির ‘স্বপ্ন’ নিয়ে। ৭৬ পৃষ্ঠার নথিতে তাঁর নাম করা হয়েছে ৬৫ বার এবং তাঁর ছবি দেওয়া হয়েছে ৫৩ বার। আমি মনে করি না যে বাস্তবে তাঁর দল সম্পূর্ণরূপে তাঁর ওপর নির্ভরশীল। তবে তিনি অবশ্যই চান যে লোকেরা এটাই ভাবুক।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
দেবাশীষ রায়চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।