প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডারের দ্বন্দ্বের কারণটা কী?
আবু আলম শহীদ খান: আমরা যে আমলাতন্ত্র পেয়েছি, তার শুরু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র এর উত্তরাধিকার বহন করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো ভারত স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পেশাদার আমলাতন্ত্র লালন করলেও পাকিস্তান সেটা করেনি। সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিই ছিলেন না। সামরিক শাসকেরা দেশ চালিয়েছেন। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানও স্বাধীন, সৎ ও নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র গঠনের উদ্যোগ নেননি। তবে বর্তমানে জনপ্রশাসনে যে বিরোধ, এটার উদ্ভব পঁচাত্তরের পর। জিয়াউর রহমান ২৮টি ক্যাডার তৈরি করলেন। তখন থেকেই বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
এ সমস্যার সমাধান কী?
আবু আলম শহীদ খান: সমাধান হলো স্বাধীন, মেধাবী ও দক্ষ গণকর্মচারীদের নিয়ে জনপ্রশাসন তৈরি করা। অন্যথায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র বা সুশাসন—কোনোটাই নিরাপদ নয়। গণকর্মচারীরা দলবাজ হলে তো প্রশাসন তো ঠিকমতো কাজ করবে না। জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।
ক্যাডার সমস্যা তো দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিক কালে সেটি এমন চরম রূপ নিল কেন?
আবু আলম শহীদ খান: এ সমস্যার জন্য আমি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে দায়ী করব। ১৭ ডিসেম্বরের বৈঠকে কমিশনের একজন সদস্য সাংবাদিকদের লেখাপড়া করে আসতে বললেন। সাংবাদিকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন। সভাপতি হিসেবে তাঁর কর্তব্য ছিল সবাইকে শান্ত থাকতে বলা। সেটা না করে তিনি আগুনে ঘি ঢাললেন। সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫০+৫০ ফর্মুলা দিলেন। তিনি আরেকটি কথা বললেন, সচিব পদে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা দিতে হবে। এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। এরপর অন্য সার্ভিসের কর্মকর্তারা আন্দোলন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কেননা, নতুন ফর্মুলায় তাঁরা লাভবান হবেন।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বেশি সুবিধা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
আবু আলম শহীদ খান: সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষার সময় প্রার্থীরা ক্যাডার পছন্দ করেন। কে কোন ক্যাডার পাবেন, সেটা মেধার ভিত্তিতে হয়। ধরুন, কেউ ৭০০ নম্বর পেয়ে প্রশাসন ক্যাডার পেয়েছেন। আবার কেউ ৫০০ নম্বর পেয়ে মৎস্য ক্যাডার পেলেন। এখন দুটিকে এক করে দেখলে তো হবে না।
২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আপত্তি হলো, তাঁরা যেসব মন্ত্রণালয়ে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ছড়ি ঘোরাবেন কেন?
আবু আলম শহীদ খান: মাঠপর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা আর মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদ এক নয়। স্বাস্থ্যসচিবকে ডাক্তার হতে হয় না। তিনি সেই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজে দক্ষ কি না, সেটাই দেখা হয়। একজন প্রশাসনিক কাজে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আরেকজন মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন, দুটিকে এক মাপে দেখলে হবে না। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দেখুন। কোনো কৃষি কর্মকর্তা কৃষিসচিব হন না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবও আসেন প্রশাসন থেকে। আমি মনে করি, জনপ্রশাসনে যাঁরা আছেন, সবাই গণকর্মচারী। ক্যাডার দিয়ে বানরের পিঠা ভাগ করার নীতি বন্ধ করতে হবে।
গত ১৫ বছরে তো প্রশাসনে পদ ছাড়াই ঢালাও পদোন্নতি হয়েছে।
আবু আলম শহীদ খান: এটা তো চাপের কারণে হয়েছে। প্রশাসন ঠিকমতো চলেনি। এখন যাঁদের সংখ্যা বেশি, তাঁরা যদি আন্দোলন করে দাবি আদায় করেন, তখন আরেকটি সমস্যা তৈরি হবে। আমাদের সময়ে বিসিএসে ১৬০০ নম্বরের পরীক্ষা ছিল। তখন বাংলা ও ইংরেজিতে ৪০০ নম্বর ছিল। ১০০ নম্বরের ইংরেজি ও ১০০ নম্বরের বাংলা রচনা লিখতে হতো। টেকনিক্যাল লোকদের চাপে ১০০ নম্বর তুলে দেওয়া হলো।
জনপ্রশাসনে সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার ফল কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে?
আবু আলম শহীদ খান: অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বড় পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। তবে নির্বাচিত সরকারের উচিত হবে পুরো বিষয় নিয়ে ভাবা ও একটি স্বাধীন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র তৈরি করা। ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকান, সেখানে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডারের লোক—আইএসএস, সিএসপি। সেখানে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
এ মুহূর্তে প্রশাসন ও ২৫ ক্যাডার মুখোমুখি হওয়ায় জনপ্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর নিষ্পত্তি কীভাবে হবে।
আবু আলম শহীদ খান: ৫০+৫০ ফর্মুলা তো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। সরকারের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমাদের সামনে বড় ইস্যু ছিল নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে এবং সামগ্রিকভাবে জনপ্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে করণীয় ঠিক করা। কিন্তু মুয়ীদ চৌধুরী একটা নন–ইস্যুকে ইস্যু করেছেন। এখন এর সমাধানও তাঁকে দিতে হবে।
সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ২২৭ জন বিসিএস পরীক্ষার্থীকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে যেভাবে বাদ দেওয়া হলো, সেটা কীভাবে দেখছেন? আওয়ামী লীগ আমলেও একই কাণ্ড হয়েছে।
আবু আলম শহীদ খান: আওয়ামী লীগ আমলে সেটা হতে পারে, তারা ছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে প্রার্থীদের বাপ–দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর ঠিকুজি খোঁজা ঘোরতর অন্যায় ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো ঘোষণা দিয়েছিল, তারা কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না, কাউকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করবে না। এখন আগের সরকারের আমলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে যাঁরা বঞ্চিত হয়েছিলেন, তাঁদের নিয়োগও দেওয়া হলো। আবার এই সরকারের আমলেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যে এভাবে কাউকে বঞ্চিত করা অনৈতিক ও মৌলিক অধিকারবিরোধী।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা আবেদন করলে পুনর্বিবেচনা করা হবে।
আবু আলম শহীদ খান: এটা কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না। আপনি তাঁদের প্রতি অন্যায় করে বললেন, আবেদন করো। আমি তো সচিবালয়ের সামনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের কান্নাও শুনেছি। পুনর্বিবেচনার আবেদন আহ্বান তাঁদের প্রতি মশকরা ছাড়া কিছু নয়। রাষ্ট্রের উচিত তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ঘটনার জন্য পুলিশপ্রধান ও র্যাবপ্রধান দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। জনপ্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ক্ষমা চাইবেন না কেন?
আবু আলম শহীদ খান: গণকর্মচারী তো কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নন। সব ক্যাডারের কর্মকর্তা–কর্মচারীই আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেননি। আমি মনে করি, সচিব, ডিসি, এসপি থেকে শুরু করে নিচের শ্রেণির কর্মচারী কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তবে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। ১২ লাখ কর্মচারী তো ক্ষমা চাইতে পারেন না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু আলম শহীদ খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।