বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. সেলিম রায়হান
কর কমিয়ে জ্বালানির দামের সমন্বয় করা যেত
সরকার এক ধাপে সব ধরনের জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি করেছে। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে সেটি কার্যকর হয়েছে। কোন প্রেক্ষাপটে জ্বালানির এ মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা, এর অর্থনৈতিক প্রভাব ও করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এক ধাপে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির চাপ জনজীবনে কতটা পড়বে? এমনিতেই করোনার অভিঘাত, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সীমাহীন কষ্টের মধ্যে আছে।
সেলিম রায়হান: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সম্প্রতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিটা অবধারিত ছিল। কিন্তু দেশে এক ধাপে জ্বালানির দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, সেটা অস্বাভাবিক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় দাম বৃদ্ধি আর হয়নি। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে, কোভিড–পরবর্তী একটা পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছিল এবং জনজীবনে মূল্যস্ফীতির বড় ধরনের চাপ রয়েছে—এ পরিস্থিতিতে এত অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক বলে মনে হয় না। আরেকটা কারণে এই মূল্যবৃদ্ধিটা অস্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন তেলের দাম নিম্নমুখী। তাহলে এই সিদ্ধান্ত কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় নেওয়া হলো? এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বড় ধরনের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। যদি মূল্যবৃদ্ধিটা একটা যৌক্তিক পর্যায়ে হতো, তাতে প্রভাবটা সহনীয় থাকত। এখন অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিবহনে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, সেটা আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। কৃষিতেও প্রভাব পড়বে। সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির আরেকটা বড় ধাক্কা পড়বে জনজীবনে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: জ্বালানি তেলের দাম এক ধাপে বাড়ানো হলো, জনজীবনে এর যে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে, তা কমাতে কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান আমরা দেখছি না কেন?
সেলিম রায়হান: প্রশ্ন হলো, সরকার কি বিবেচনায় নিয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনে কতটা প্রভাব পড়তে যাচ্ছে? সে রকম একটা বিশ্লেষণ ও বিবেচনা যদি থাকত, তাহলে এত অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আগে সরকার ভাবত। তাৎক্ষণিক প্রভাব পরিবহন খাতে দেখছি। এর কারণে সড়কে একটা অরাজকতাও দেখতে পাচ্ছি। আমরা অতীতে দেখেছি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসসহ পরিবহন খাতে যে ভাড়াটা বাড়ে, সেখানে সব সময় স্বচ্ছতার অভাব থাকে। মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বাড়ানো হয়। এ বিবেচনাগুলো না করে এ ধরনের বড় একটা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো অর্থেই সুচিন্তিত নয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এত বড় ধাক্কা সাধারণ মানুষ কীভাবে সামলাতে পারবে?
সেলিম রায়হান: সাধারণ মানুষ নানাভাবেই এ ধরনের ধাক্কা সামলে নিতে চেষ্টা করে। এর আগে করোনা মহামারি, মূল্যস্ফীতি—এ ধরনের সংকটগুলো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সাধারণ মানুষ কম খেয়ে, চিকিৎসা-শিক্ষায় ব্যয় কাটছাঁট করে পরিস্থিতি মানিয়ে নেয়। কিন্তু এভাবে মানিয়ে নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের স্বস্তির জায়গাগুলো কতটা নিশ্চিত করা হলো? এর জন্য সরকার কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? এ ধরনের বড় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কি একটা জবাবদিহি থাকবে না? দরিদ্র জনগণ এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে যাঁরা অতিরিক্ত চাপে আছেন, তাঁদের জন্য সরকারের কর্মসূচি কী? যে বিশাল চাপটা সৃষ্টি হলো, সেই চাপটা শিথিল করার জন্য সরকার কী করবে, সেটা মোটেই পরিষ্কার নয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বলা হচ্ছে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে জ্বালানিতে ভর্তুকি তুলে নিচ্ছে সরকার। কোনো বিকল্প কি ছিল না?
সেলিম রায়হান: জ্বালানি খাতের পুরো ব্যাপারটা একটা সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নেই। যেহেতু স্বচ্ছ কোনো প্রক্রিয়া নেই, সে জন্য আমরা আশ্চর্য হই, সিদ্ধান্তটা কীভাবে নেওয়া হলো। আইএমএফের সঙ্গে ঋণ নিয়ে যে আলোচনা চলছে, সেটা তো মাত্র শুরু হয়েছে। আইএমএফ অবশ্যই বলতে পারে, জ্বালানি খাতে তোমরা বড় যে ভর্তুকি দিচ্ছ, সেটা বাজেটে একটা বড় চাপ সৃষ্টি করছে, সেই জায়গাটা সমন্বয় করতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে জ্বালানির পুরো ভর্তুকি তুলে ফেলতে হবে। আইএমএফের সঙ্গে দর-কষাকষির যথেষ্ট সুযোগ আছে। তারা যা বলবে তার পুরোটাই মানতে হবে, এমন কথা নেই। নীতিনির্ধারণের অনেক জায়গায় দেশের বাস্তব পরিস্থিতিকে বিবেচনায় আনতে হবে। আমার মনে হচ্ছে অনেক সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত নেওয়া হচ্ছে। বিবেচনার জায়গাগুলোও খুব দুর্বল। এগুলো পুনর্মূল্যায়ন করার সুযোগ আছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এ পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় কী বলে মনে করছেন।
সেলিম রায়হান: সরকারের সামনে এখন চারটি করণীয় রয়েছে। প্রথমত জ্বালানি তেলের মূল্য যেটা বাড়ানো হলো, তা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন লোকসান দিচ্ছে সেই যুক্তি মানছি, কিন্তু একটা সময় তো তারা বড় লাভও করেছে। সেখান থেকে সহজেই সমন্বয় করা যেত। সরকারকে যৌক্তিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এত বছরেও আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণটা কোন প্রক্রিয়ায় হয়, সেটা পরিষ্কার নয়। এর সূত্র কিংবা প্রক্রিয়াটা কী? এ ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া থাকা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে এখানেও স্বচ্ছ ওই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় দাম বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সঙ্গে খুব দ্রুত দাম কমানোর জায়গাটা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতে নিয়মিত জ্বালানি তেলের দামের সমন্বয়টা হয়। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। কিন্তু আমাদের কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নেই।
তৃতীয়ত, জ্বালানিতে মূল্য সংযোজন করসহ একটা বড় কর নির্ধারণ করা আছে। এটা ৩০-৩২ শতাংশ। এ সংকটের সময় সরকার কর কমাতে পারত। তাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এতটা করা প্রয়োজন হতো না। জ্বালানিতে সরকার দুভাবে লাভ করার চেষ্টা করছে। বিপিসি যেন কোনোভাবেই লোকসান না করে, সে জন্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় করছে। আবার জ্বালানির ওপর কর আরোপ করে রাজস্ব আদায় করছে। এই সংকটকালে দুই নীতি বহাল রাখা উচিত নয়। সরকার বলছে মূল্য সমন্বয় করছে, তাই সমন্বয়ের মধ্যে কোথায় কোথায় কর ছাড় দেওয়া যেতে পারত, সেটা মূল্যায়ন করা উচিত।
চতুর্থত, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও মধ্যবিত্তের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ অনেক অর্থনৈতিক খাতের উদ্যোক্তারা অত্যধিক চাপে পড়বে। তাদের জন্য সরকার কী ধরনের সহায়তা কর্মসূচি নিচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষি খাতে পরপর দুটি বড় সিদ্ধান্ত এসেছে। সারের মূল্যবৃদ্ধির পর ডিজেলের দামও এক ধাপে অনেকটা বাড়ল। সারের ক্ষেত্রে কৃষকেরা খরচ একটু কমিয়ে মানিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে সেচে একটা বড় খরচ বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি খাতে সরকারকে চলমান সহায়তা কর্মসূচি অবশ্যই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কৃষকদের জন্য ডিজেল কার্ড করা যায় কি না, সে বিষয়ে সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। ডিজেল কার্ডের মাধ্যমে প্রত্যেক কৃষক ডিজেলে একটা ভর্তুকি পাবেন। এটা না করা গেলে কৃষি খাতে বড় ধাক্কা আসবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।