মতামত
‘শ্রীলঙ্কার স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে সময় লাগবে’
শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি এখনো শান্ত হয়নি। সেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে রাজনীতিভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য কনভারসেশন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক নিল ডেভোটার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
প্রশ্ন :
দ্য কনভারসেশন: শ্রীলঙ্কার সর্বশেষ অবস্থার গতিপ্রকৃতি কী?
নিল ডেভোটা: যা ঘটে গেল, তা সত্যিই বিপ্লবী ঘটনা। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন প্রেসিডেন্ট চূড়ান্ত অপমানজনকভাবে পদত্যাগ করলেন। এর আগে গোতাবায়া রাজাপক্ষে বলেছিলেন, তিনি শিগগিরই প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে চান; কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেননি, কারণ পদত্যাগ করলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যে মামলা থেকে দায়মুক্তির সুবিধা পাচ্ছিলেন, তা আর থাকছিল না। ফলে তিনি পদত্যাগ করার বদলে দেশ ছেড়ে প্রথমে মালদ্বীপ এবং পরে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান। শোনা যাচ্ছে, তিনি এখন সৌদি আরব কিংবা দুবাই যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সমালোচকেরা বিদ্রূপ করে বলছেন, গোতাবায়া নিজের গদি পোক্ত করার জন্য ইসলামবিদ্বেষ উসকে দিয়েছিলেন, আর সেই তিনিই এখন মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে আশ্রয় খুঁজছেন।
গোতাবায়ার পদত্যাগের পেছনে অনুঘটক ছিল জনতার প্রতিবাদী আন্দোলন। তবে তাঁদের প্রতিবাদ আন্দোলন পুরোপুরি সফল হয়নি। আংশিকভাবে তাঁরা সফল হয়েছেন। তাঁরা রাজাপক্ষে ও তাঁর ভাইদের বহিষ্কার চেয়েছিলেন। তবে অনেকে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহের ক্ষমতাচ্যুতিও দাবি করেছিলেন। বিক্রমাসিংহে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসেননি এবং আইনসভার শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় তালিকার মাধ্যমে একটি আসন তিনি পেয়েছিলেন। সেই তিনি এখন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। অর্থাৎ কোনো জনসমর্থন নেই, এমন একজন ব্যক্তি এখন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। এটি মানুষকে এখনো ক্ষুব্ধ করে রেখেছে।
প্রশ্ন :
দ্য কনভারসেশন: এই দাবানলের প্রথম স্ফুলিঙ্গ ছিল কোনটি?
নিল ডেভোটা: এর শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের এপ্রিলে যখন রাজাপক্ষে সার, ভেষজনাশক এবং কীটনাশক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আসল স্ফুলিঙ্গটির শুরু তখনই। শ্রীলঙ্কার সরকারগুলো দীর্ঘকাল ধরে তাদের সাধ্যের বাইরে ‘জীবনযাপন’ করেছে এবং দেশকে চালু রাখতে ঋণ রোলওভার কৌশল অবলম্বন করে এসেছে। দেশটি তার ঋণ পরিশোধের জন্য পর্যটন খাত থেকে পাওয়া অর্থ এবং আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স থেকে আয়ের ওপর নির্ভর করে এসেছে। পাশাপাশি তারা ধার করে ধারের অর্থ শোধের নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল।
কোভিড-১৯ আসার পর পর্যটন খাত তছনছ হয়ে যায়। এরপর থেকেই দেশটির পক্ষে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধ অসম্ভব হয়ে ওঠে। এটি সরকারকে আকস্মিকভাবে আগাছানাশক ও সার আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বাধ্য করেছিল। সরকার আশা করেছিল, এর ফলে বার্ষিক আমদানিতে ৪০ কোটি ডলার সাশ্রয় করা যাবে। বিশেষজ্ঞরা আগেই বলেছিলেন, এটি করলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। এতে কৃষক বিক্ষোভ দেখা দেয়। এরপর ডলারের ঘাটতি কৃষির বাইরেও আঘাত হানে। একপর্যায়ে ওষুধ ও গুঁড়ো দুধের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে অন্যান্য খাতের লোকজনও প্রতিবাদ করে।
এ ছাড়া সরকার পণ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য টাকা ছাপছিল। এটি অনিবার্যভাবে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করেছে, যা ৫০ শতাংশের ওপরে চলছে। সর্বশেষ অবস্থায় লোকেরা দেখতে পেল, তারা আর রান্নার গ্যাস এবং জ্বালানির জন্য অর্থ দিতে পারছে না। তখন তারা ফুঁসে ওঠে।
প্রশ্ন :
দ্য কনভারসেশন: তাহলে এটাকে আপনি কি নিখাদ অর্থনৈতিক সংকট বলবেন?
নিল ডেভোটা: পুরোপুরি না। যদিও স্ফুলিঙ্গটি অর্থসংকটের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এই জগাখিচুড়ি অবস্থার মূলে আছে একটি গভীর জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদ, যা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং স্বল্পমেয়াদিবাদকে উৎসাহিত করেছে। ১৯৫০–এর দশক থেকে শ্রীলঙ্কা সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের কবলে রয়েছে। সিংহলিরা জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ, তামিলরা প্রায় ১৫ শতাংশ এবং মুসলমান ১০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সিংহলিরা অনেক আগে থেকেই অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। এটি শুধু দেশের সংখ্যালঘুদেরই নয়, এটি শাসনব্যবস্থারও ক্ষতি করেছে। এটি স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বিস্তারে সাহায্য করেছে।
রাজাপক্ষে ভাইয়েরা তিন দশকের তামিল বিদ্রোহকে নির্মমভাবে দমন ও পরাজিত করেছিলেন, যা সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের শক্তিশালী করেছে। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের অবসানের পর রাজাপক্ষেরা দেশটিতে বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলেন। এর বদলে দেশটি যা পেয়েছিল, তা হলো অনুৎপাদনশীল কিছু ব্যয়বহুল প্রকল্প। এগুলোর বেশির ভাগের অর্থায়ন করেছে চীন। এসব প্রকল্প দুর্নীতিতে ডুবে ছিল।
প্রশ্ন :
দ্য কনভারসেশন: ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার দশা কী হবে?
নিল ডেভোটা: শ্রীলঙ্কার অগ্রসর হওয়ার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটি ছাড়া আপনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাবেন না। আইএমএফ, এডিবি এবং বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক নেতাদের সহায়তা ছাড়া শ্রীলঙ্কার পক্ষে এই অর্থনৈতিক জগাখিচুড়ি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। এর জন্য ভারত, জাপান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো অংশীদারদের সাহায্যও প্রয়োজন। ফলে শ্রীলঙ্কার এ অবস্থা থেকে বের হতে সময় লাগবে।
শ্রীলঙ্কার বড় আকারের ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রয়োজন। এটি ঘটতে হলে সরকারকে তার দ্বিপক্ষীয় ঋণ পুনর্গঠন করতে হবে। শ্রীলঙ্কাকে চীনের ঋণ শোধ করার জন্য আইএমএফ অর্থ দেবে না। ফলে শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হবে।
দ্য কনভারসেশন থেকে নেওয়া
●অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ