বিশেষ সাক্ষাৎকার : মো. তানজীমউদ্দিন খান

উপাচার্য তাঁকেই করুন, যিনি শিক্ষার্থীদের ভাষা পড়তে পারেন

মো. তানজীমউদ্দিন খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অধিকার সুরক্ষায় এবং সরকারি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ভূমিকা রেখে আসছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভূমিকা ছিল সাহসী ও জোরালো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অচলাবস্থা ও এর উত্তরণ—এসব নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রথম আলো:

কোটা সংস্কারের মতো একটা নিরীহ আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে একটা চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন হলো। সামগ্রিকভাবে এই আন্দোলন থেকে আমাদের রাজনীতির শিক্ষাটা কী?

তানজীমউদ্দিন খান: এটা সত্য, প্রথম পর্যায়ে এটা একটা নিরীহ আন্দোলন ছিল। সেই নিরীহ আন্দোলনকে সহজভাবে বুঝতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে হাসিনা সরকারকে। বাংলাদেশের সব কর্তৃত্ববাদী সরকারের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। সরকার যত বেশি দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মানুষ এমন এক জায়গায় পৌঁছে যায় যে তাদের বাঁচতে হলে সরকারকে হটাতে হবে।

যাঁরা ক্ষমতাসীন হন, তাঁদের এটা বোঝা জরুরি যে হত্যাকাণ্ড, গুম, দমন-পীড়ন দিয়ে আসলে নিজেকে টিকিয়ে রাখা যায় না। যত বেশি নিপীড়ন হবে, মানুষের মধ্যে ঐক্যের বোধটা তত বেশি জোরালো হবে।

সবার মধ্যে যখন এই ঝোক তৈরি হয় যে এখন বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে, তখন রাজনীতি, ধর্ম, জাতি, গোত্র ঘিরে সমাজে যতই বিভেদ থাকুক না কেন, সবাই একতাবদ্ধ হয়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।

প্রথম আলো:

কিন্তু অভ্যুত্থানটি তো আমাদের ইতিহাসের আগের যেকোনো অভ্যুত্থান থেকে ভিন্ন...

তানজীমউদ্দিন খান: আন্দোলন দমাতে যেভাবে নিপীড়ন চালানো হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমনটা দেখা যায়নি। অনেকটা শাপলা চত্বরে মাদ্রাসার এতিম শিক্ষার্থীদের যেমন করে দমন করা হয়েছিল, তারই একটা চূড়ান্ত মাত্রার অনুশীলন এবার জাতীয় পর্যায়ে আমরা দেখেছি। সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস, হেলিকপ্টারের সঙ্গে বৈধ-অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ছিল, সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় মাস্তানদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। তারা নির্বিচার সেই অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। এগুলো ছিল ভয়ানক মারণাস্ত্র। ফেসবুক, ইউটিউবের ভিডিওতে আমরা দেখেছি স্নাইপার রাইফেল, একে-৪৭-এর মতো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এটা এবারের আন্দোলনের একটা ভিন্নমাত্রা নিয়ে আসে।

এর ফলে মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যখন একটা শিশু খেলতে গিয়ে নিরাপদ থাকছে না, একটা শিশু ঘরের মধ্যে নিরাপদ থাকছে না, তখন ওই শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তার অভিভাবকেরা, শিক্ষকেরা, রিকশাচালক, শ্রমজীবী মানুষ সবাই রাস্তায় নেমেছেন। এটা তখন আর শুধু অ্যাকটিভিস্টদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

দমন-নিপীড়নটা প্রতিটি মানুষ টের পাচ্ছিলেন, তাঁরা টের পাচ্ছিলেন তাঁরা কতটা অনিরাপদ। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করেই টিকে থাকে। কিন্তু অনিরাপত্তার অনুভূতিটা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে সেই বিভাজনরেখাটি মুছে দিয়েছে। ফলে সবাই সরকার পতনের এক দফা দাবিতে নেমে এসেছেন। এটা একদমই ভিন্ন এক বাস্তবতা।

প্রথম আলো:

৫ আগস্টের অভ্যুত্থান একদিকে যেমন স্বতঃস্ফূর্ত, আবার এর সম্ভাবনাও তো বিপুল। কী মনে করছেন?

তানজীমউদ্দিন খান: সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হচ্ছে সবাই এটাকে বলছেন, ১৯৭১ সালকে আমরা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছি। বিশেষ করে যাঁদের নেতৃত্বে এই আন্দোলন সংঘটিত হলো, সেখানে বাম, ডান, মধ্যপন্থী—সবাই ছিলেন। সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গের মানুষের অংশগ্রহণ সেখানে ছিল। গত ১৬ বছরে যে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, অলিগার্কির শাসন—সেই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিত্তি করা হয়েছিল। সেই চেতনার ওপর ভর করে তারা সীমাহীন অন্যায় ও দুর্নীতি করেছে। পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলেছে। কোনো কিছুর প্রতিবাদ করলে যে কাউকে তকমা দেওয়া হয়েছে জামায়াত-বিএনপি, কিংবা ‘রাজাকার’ বলে। এটা মানুষের আত্মসম্মান বোধে তীব্রভাবে আঘাত করেছে।

প্রথম আলো:

সবখানেই একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আশা, উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো কতটা প্রস্তুত পরিবর্তনের এই বিশাল শক্তিকে ধারণ করতে?

তানজীমউদ্দিন খান: একটা রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন কোন অবস্থায় গেলে আয়নাঘরের মতো বন্দিশালা তৈরি হতে পারে। সত্তর-আশির দশকে লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশেও আয়নাঘরের মতো আন্ডারগ্রাউন্ড বন্দিশালা তৈরি করে হাজার হাজার মানুষকে আটকে রেখেছিলেন। আমাদের মায়ের ডাকের মতো সেখানকার মায়েরাও কিন্তু সংগঠিত হয়েছিলেন তাঁদের সন্তানদের গুম-হত্যার প্রতিবাদে। আমাদের রাষ্ট্রটা এ রকম একটা চরম স্বৈরতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল।

বাংলাদেশে সবাই এখন নতুন স্বাধীনতার কথা বলছে। যদিও এটা নতুন স্বাধীনতা নয়। এটা আসলে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের যে স্পিরিট; অর্থাৎ স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মমর্যাদাপূর্ণ একটা জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা—সেটাই মানুষ ফেরত পেতে চায়। আমাদের পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা বেদখল হয়ে গিয়েছিল। গুটিকয় ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের একটা শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হয়েছিল। তাঁরা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দখল করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় তাঁদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এর ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর সাধারণ মানুষের যে মালিকানা, সেটা হারিয়ে গিয়েছিল।

সেদিক থেকে এবারের গণ-অভ্যুত্থান জাতীয় ঐক্যের যে বোধটা তৈরি করেছে, সেটা নতুন বাংলাদেশ তৈরির ক্ষেত্রে একটা বিপুল সম্ভাবনা। এর আগেও নব্বইয়ে আমরা দেখেছি, স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর এ ধরনের সম্ভাবনা এসেছিল। ২০০৭-০৮-এ একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সে সময়কার আন্দোলনগুলো ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক দলনির্ভর। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব মতাদর্শ ও এজেন্ডা ছিল। সেটার ওপর ভিত্তি করে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী মাঠে নেমেছিল। কিন্তু এবার সেটা ঘটেনি।

প্রাইভেট-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা-ইংরেজি-মাদ্রাসা—সব জায়গার শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে এসেছেন, কৃষক-শ্রমিক-জনতা এখানে অংশ নিয়েছেন। এটা সবচেয়ে বড় শক্তির দিক। নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পারছে কি না, কিংবা এর জন্য তারা প্রস্তুত কি না, সেটাই মূল চ্যালেঞ্জ।

মো. তানজীমউদ্দিন খান
ছবি : সাজিদ হোসেন
প্রথম আলো:

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তো কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী নয়। সে ক্ষেত্রে তো একটা রাজনৈতিক ঝুঁকিও থাকছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত জাতির সামনে কোনো কর্মপরিকল্পনা দেয়নি।

তানজীমউদ্দিন খান: এটা সত্য যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক শক্তি নন। তাঁদের সুসংগঠিত কোনো দলীয় কাঠামো নেই। সুনির্দিষ্টভাবে সরকার পরিবর্তনকে ঘিরে তাঁরা এ আন্দোলন করেননি। সেটা থাকলে সরকার পরিবর্তনের পর কী করবেন, তা নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা থাকত। তাঁরা এ ধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে যাননি, যার ফলে ঝুঁকির দিক থেকেও তাঁরা ভিন্ন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছেন।

এবার যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো, সেটাও কিন্তু আমাদের ইতিহাসের পুরোপুরি ভিন্ন একটা ঘটনা। নব্বইয়ের পরে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তার সঙ্গে এটাকে মেলানো যাবে না। এটাকে আমি বিপ্লবী সরকারও বলতে চাই না। তাৎক্ষণিক একটা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত একটা সরকার। এর জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার জায়গাটা হলো, পরিবর্তনের জন্য একটা জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে।

এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। অন্তর্বর্তী সরকার জন-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করার জন্য কতটা প্রস্তুত এবং কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করছে সেই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব কি না, নাকি আগের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে। এখানে সবার সমর্থন জরুরি।

গত ৫৩ বছরে এখানকার সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক দলগুলো ধারণ করতে পারেনি। মানুষ এখন আর পুরোনো ধারায় ফিরতে চায় না। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রতিষ্ঠান—সবখানেই একটা কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার, সেটা দ্রুতই করতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে, সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে, সেই ব্যবধান ঘোচানো ও বিচ্ছিন্নতা কাটানোর জন্য সরকারের উচিত, দ্রুতই তাদের কর্মপরিকল্পনা হাজির করা।

একটা টাস্কফোর্স গঠন করে এই কর্মপরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য যেমন একটা রূপরেখা দেওয়া প্রয়োজন। আবার দীর্ঘ মেয়াদে কোন লক্ষ্যে কাজ করবে, তারও একটা রূপরেখা প্রয়োজন। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আসতে হবে।

প্রথম আলো:

আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের একটা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ৫ আগস্টের আগের ও পরের সময়টাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

তানজীমউদ্দিন খান: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক শুধু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সক্রিয় ছিল না। নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা অনেক আগে থেকেই প্রতিবাদ করে আসছি। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবি, তাঁদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন কিংবা আমাদের সহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য শিক্ষক নেটওয়ার্ক সব সময় কাজ করে আসছে। ঘটনাক্রমে এবারের আন্দোলনেও আমাদের একটা অংশগ্রহণ ছিল।

৫ আগস্টের আগের ও পরের সময়ের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে আমার অনুভূতি হচ্ছে, আমরা বেঁচে গেলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সবাই বেঁচে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে আমাদের কীভাবে দমন করা হবে, তার একটা তালিকা করা হয়েছিল। এটা অনেকটা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের কথা মনে করিয়ে দেয়। যে তালিকা করা হয়েছিল, তার শীর্ষে আমার নামটা ছিল। এর ফলে আমাদের মনে হয়েছিল, আমাদের যদি বেঁচে থাকতে হয়, স্বৈরাচারী সরকার না থাকাটাই শ্রেয়। এর ফলে আমরা যে বেঁচে থাকতে পারছি, এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

এই আন্দোলন শিক্ষক নেটওয়ার্কের সামনে একটা বড় সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারে আমাদের শিক্ষার্থীরাও নেতৃত্বে আছেন, আমরা তাঁদের পাশে থাকতে চাই, তাঁদের জবাবদিহির মধ্যে রাখতে চাই। আমরা যে কাজগুলো আগে করতাম, সেই কাজগুলোই এখন আরও স্বাধীনভাবে করব।

নতুন যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানোর জন্য ৩ আগস্ট আমরা একটা বিকল্প সরকারের রূপরেখা দিয়েছি। সেখানে আমরা বলেছিলাম, সংবিধান নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের একটা অঙ্গীকার ছিল ছায়া সরকারের। এগুলো নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি। খুব দ্রুতই বিষয়গুলো জনপরিসরে নিয়ে আসব।
     

প্রথম আলো:

অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারে কেন শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি থাকল না। এ বিষয়ে আপনাদের ব্যাখ্যা কী?
   

তানজীমউদ্দিন খান: শিক্ষক নেটওয়ার্কের কেউ স্টাবলিশমেন্টমুখী নন। এ ধরনের সরকার গঠন নিয়ে যখন দর-কষাকষি হয়, তখন অনেকগুলো পক্ষ থাকে। এ রকম কোনো পক্ষের কাছে গিয়ে আমাদের নিজেদের জন্য বলা, শিক্ষক নেটওয়ার্কের কারও মধ্যেই এই মনোবৃত্তি নেই। শিক্ষক নেটওয়ার্কের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে আমাদের কারও পদ-পদবি নেই। পদহীন বলেই আমরা হয়তো এত দিন টিকে আছি। ফলে স্টাবলিশমেন্টে থাকার চেয়ে যারা স্টাবলিশমেন্টে আছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনাটাকেই আমরা আমাদের কাজ বলে মনে করছি। শিক্ষক নেটওয়ার্ক একটা প্রেসার গ্রুপ  হিসেবে কাজ করতে চায়।  

প্রথম আলো:

শিক্ষক-লেখকদের সমন্বয়ে আপনারা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটি করার উদ্দেশ্য কী?

তানজীমউদ্দিন খান: আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনা যেমন তৈরি হয়েছে, সেই সঙ্গে নতুন সংকট আসারও শঙ্কা আছে। একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা যাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি না করতে পারে, সেই সব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা কিংবা আমাদের তরফ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা এবং নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে, সাধারণ মানুষের অধিকারের প্রশ্নে সবাইকে একটা প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত করার উদ্দেশ্য থেকেই গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি করা হয়েছে। প্রাথমিক ধারণা থেকে এই কমিটির কার্যক্রম শুরু হলেও কাজের মধ্য দিয়ে এটার বিস্তৃতি ঘটানোর সুযোগ রয়েছে। শুধু শহরনির্ভর মধ্যবিত্ত অংশ নয়, তৃণমূলের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা ভালো প্ল্যাটফর্ম হতে পারে এই কমিটি।

প্রথম আলো:

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক স্তরে গণপদত্যাগের হিড়িক দেখছি। উপাচার্য থেকে আবাসিক শিক্ষক—সবখানেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন প্রশাসনশূন্য। এ রকম একটা অভাবনীয় পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো। উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

তানজীমউদ্দিন খান: বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হয়েছে, সেটাকে রাজনীতিকরণ বললে আসলে কম বলা হবে। স্বৈরাচারী যে সরকার ছিল, তাদেরই সম্প্রসারিত অংশ হয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য থেকে শুরু করে দারোয়ান—সবাই রাজনৈতিক দলকে প্রতিনিধিত্ব করতেন। সেই রাজনৈতিক দলের বন্দনা ছাড়া তাঁদের আর কোনো কাজ ছিল না। তাঁরা যে শিক্ষক, সেই আত্মমর্যাদা বোধই তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের যে শিক্ষক সমিতি, তাদেরও কিন্তু একই অবস্থা হয়েছিল। এখানে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের উচ্ছেদ মানে তাদেরও উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেটাই দেখছি আমরা।

এই শিক্ষকেরা কখনো শিক্ষার্থীদের পাশে থাকেননি, যার ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের ভয়ংকর অনাস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের আস্থার সম্পর্কটা কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে, সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এতসংখ্যক শিক্ষক তো নেই, যাঁরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্কটা নিশ্চিত করতে পারেন। উপাচার্যসহ প্রশাসনিক পদে নিয়োগগুলো এমন ব্যক্তিদের দিতে হবে, যাঁরা শিক্ষার্থীদের বুঝতে পারেন, তাঁদের ভাষা পড়তে পারেন। এটা অনস্বীকার্য যে একাডেমিকভাবে অত্যন্ত মানসম্পন্ন শিক্ষকদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।

কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বিবেচনা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের তাঁদের ওপর আস্থা আছে কি না। এই দুইয়ের সম্মিলন না হলে এখন সংকটের যে ধরন, সেটা থেকে উত্তরণ সহজ হবে না। আমার মনে হয়, শীর্ষপর্যায়ের যে নেতৃত্ব, বিশেষ করে উপাচার্যের পদে যদি সঠিক ব্যক্তিকে নির্বাচন করা যায়, তাহলে সংকট উত্তরণটা কঠিন হবে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তিটা কে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের মতামতটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো:

সবখানেই সংস্কারের কথাটি জোরেশোরে আসছে। সবাই বলছেন, আন্দোলন যেখানে শুরু হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম সংস্কার শুরু করা দরকার।

তানজীমউদ্দিন খান: সংস্কারের এই আলাপটা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম রাষ্ট্র মেরামত ও রাষ্ট্রসংস্কারের দাবি করেছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কার রাষ্ট্রসংস্কারের ভিন্ন কিছু নয়। রাষ্ট্রের বনিয়াদটাই নির্ধারিত হয় প্রজন্ম তৈরির প্রতিষ্ঠান কীভাবে আমরা তৈরি করছি, তার ওপরে। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক তৈরির প্রক্রিয়া কী হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু করাটাই শিক্ষা খাতে সংস্কারের প্রথম ধাপ হওয়া উচিত। স্কুল প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের স্বার্থটা কীভাবে সংরক্ষিত হবে, সেটা নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের স্কুল-কলেজের গভর্নিং বডিগুলো ক্ষমতাসীন দলকেই প্রতিনিধিত্ব করে। সেই ঘেরাটোপ থেকে স্কুল-কলেজকে বের করে আনা দরকার।

আমাদের এখানে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—যে চরিত্রেরই হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করতে হলে প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিকল্পিতভাবে গবেষণাধর্মী করা প্রয়োজন। গবেষণাধর্মী করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য, একাডেমিক পরিবেশ ও শিক্ষকদের বেতনকাঠামো সামগ্রিকভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক হওয়া উচিত।

প্রথম আলো:

১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক স্বাধীনতা অনেকটাই নিশ্চিত করা হয়েছে, তারপরও কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হলো?

তানজীমউদ্দিন খান: ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ নিয়ে আমরা গর্ব করি। এতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একাডেমিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও ১৯২১ সালের প্রশাসনিক কাঠামোর অনেক স্বৈরতান্ত্রিক উপাদান বহাল রয়ে গেছে। বিশেষ করে উপাচার্যের একচ্ছত্র যে ক্ষমতা, সেখানে ভারসাম্য আনা জরুরি। উপাচার্যের একচ্ছত্র ক্ষমতা এমনই যে সিনেট–সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যদিও এখানে বিধিটা ব্যতিক্রম কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই চর্চাই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।

উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারসহ ওপরের স্তরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের সুবিধা অনেক বেশি। এটা অনেক বড় বৈষম্যের জায়গা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যে বাড়িতে থাকেন, সেটা তো আসলে বৈষম্য ও ঔপনিবেশিক শাসনামলের একটা নিদর্শন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার যে লোভ তৈরি হয়, তার প্রথম ধাপ এই বাড়ি।

উপাচার্যের বাড়িকে বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর কিংবা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন। এ ধরনের অতিরিক্ত সুবিধা একজন সাধারণ অধ্যাপক থেকে একজন উপাচার্যকে কার্যত খুব শক্তিশালী করে তোলে। তার মধ্যে একটা স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি ও দম্ভ তৈরি করে। উপাচার্যদের যে বিপুল সুযোগ-সুবিধা এবং যে বড় বড় দালানকোঠায় তাঁদের বসবাস, সেখান থেকে সাধারণ অধ্যাপকদের পর্যায়ে তাঁদের নিয়ে আসা প্রয়োজন।

প্রথম আলো:

অনেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা বলছেন। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে সমস্যার সমাধান হবে?
     

তানজীমউদ্দিন খান: শিক্ষার্থীরা যে ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বের করে দিলেন, সেটা রাজনীতির বাইরের বিষয়? মুহসীন হলে একটা ব্যানার আমি দেখেছি, ‘এখন থেকে কেউ কোনো শিক্ষার্থীকে গেস্টরুম ও রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নিতে পারবে না।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট যে তাঁরা কোন ছাত্ররাজনীতি থেকে মুক্তি চাইছে। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি হবে। পুরোনো ছাত্ররাজনীতির মূল সংকটটা হলো, তারা মূল রাজনৈতিক দলের গুন্ডা বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। এ জায়গাটি বুঝে ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করা দরকার।

ছাত্ররাজনীতি গুন্ডানীতির মধ্যে থাকব নাকি সত্যিকারের শিক্ষার্থীদের কল্যাণমুখী নীতির চর্চা করবে। কল্যাণমুখী নীতির চর্চা করাটাই তো রাজনীতি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যে সরকার পতনের এক দফায় গেল, সেটা কিন্তু পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক পরিণতি। রাজনৈতিক পরিণতি ছাড়া কোনো আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা যায় না। নাগরিকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কটা রাজনৈতিক সম্পর্ক। সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষির পরিসরটা তৈরি করে রাজনীতি। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে সেই পরিসরটাই থাকবে না।

প্রথম আলো:

ছাত্র আন্দোলন নিয়ে যতটা জোরালোভাবে আওয়াজ শোনা যায়, শিক্ষকরাজনীতি নিয়ে ততটা নয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, তার বীজটা তো শিক্ষকরাজনীতির মধ্যেই গেড়ে বসে আছে।

তানজীমউদ্দিন খান: বিশ্ববিদ্যালয়ে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষকরাজনীতি সবচেয়ে বড় অনুঘটক। শিক্ষকরাজনীতিটা তৈরি হয় শিক্ষক সমিতি ঘিরে, পদ-পদবি ঘিরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের সঙ্গে আনুগত্যের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক নেতৃত্বকে সামনে আনে। উপাচার্য সরকারপ্রধানের সঙ্গে আনুগত্যের সম্পর্কের ভিত্তিতে নিযুক্ত হন। আবার তিনি নিযুক্ত হওয়ার পর তার অনুগত শিক্ষকদের প্রশাসনিক নেতৃত্বে আনেন। এই আনুগত্যের কাঠামো থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করা দরকার। প্রভোস্ট, হাউস টিউটর সব ধরনের নির্বাচন একটা জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হতে হবে। কিন্তু এসব পদে উপাচার্য তাঁর মর্জিমাফিক নিয়োগ দেন। এসব জায়গায় পরিবর্তন না গেলে শিক্ষকরাজনীতিতেও পরিবর্তন আসবে না।