মহানগর সরকার ছাড়া ড্যাপ বাস্তবায়ন অসম্ভব

আদিল মুহাম্মদ খান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন ঢাকা মহানগরের নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) বিভিন্ন দিক এবং এর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

আদিল মুহাম্মদ খান

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ঢাকা মহানগরের নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ সাধারণভাবে কেমন হলো?

আদিল মুহাম্মদ খান: ২০১০ সালে করা আগের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার নির্ধারিত মেয়াদ ২০১৫ সালে পার হওয়ার কারণে ঢাকা শহরের পরিবর্তিত নগরবাস্তবতায় নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আধুনিক নগর-পরিকল্পনার বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্লক ডেভেলপমেন্ট, কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণ, মেট্রোস্টেশনভিত্তিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি), জনঘনত্ব পরিকল্পনা, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট (টিডিআর), ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্পন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন শহরের মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করবে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আঞ্চলিক পার্ক, জলকেন্দ্রিক পার্ক, ইকোপার্ক তৈরি, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো তৈরি ও বাইসাইকেল লেনকে উৎসাহিত করা এবং অযান্ত্রিক পরিবহনকে সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করা—এসব বিষয় ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

যেকোনো পরিকল্পনা দলিলে অনুসৃত পরিকল্পনা কৌশল, পন্থা ও দিকনির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক সদিচ্ছা, যথাযথ প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন ও জনস্বার্থ-জনকল্যাণ রক্ষায় পরিকল্পনা ও নীতিনির্দেশনার নির্মোহ ও যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর। অতীতে ঢাকা মহানগরের জন্য প্রণয়ন করা কাঠামোগত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা কিংবা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার দলিলগুলো সঠিক ও পূর্ণ বাস্তবায়নের অভাবেই ঢাকা ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আমরা আশা করব, এবারের ড্যাপের ক্ষেত্রে এমনটি যেন না হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আগের ড্যাপে যে সমস্যাগুলো ছিল, তার সব নতুন ড্যাপে দূর হয়েছি কি?

আদিল মুহাম্মদ খান: আগের ড্যাপের তুলনায় নতুন ড্যাপে নগর-পরিকল্পনার বেশ কিছু আধুনিক ধারণার সংযোজন হয়েছে। এবারের ড্যাপে সিএস, আরএস ও এমএস মৌজায় চিহ্নিত নদী, খাল ও পুকুরের সুস্পষ্ট ডিজিটাল উপাত্ত–ভিত্তি প্রস্তুত করা হয়েছে, যা আগের ড্যাপে সেভাবে ছিল না। মিশ্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে আবাসিকের সঙ্গে অনাবাসিক ব্যবহারের অনুমোদনযোগ্য পরিমাণ ও অনুমোদিত ব্যবহারের ধরন সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। আগের ড্যাপে ব্লকভিত্তিক আবাসনপদ্ধতির দিকনির্দেশনা ছিল না, যা এবারের ড্যাপে বিশদভাবে এসেছে। একইভাবে বিদ্যালয়ভিত্তিক অঞ্চল, ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট কিংবা উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন ধারণা এবারের ড্যাপে নতুনভাবে এসেছে। উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন (টিডিআর) ব্যবস্থার বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানাধীন খাল, জলাশয়, জলাভূমি, পুকুর সংরক্ষণ করা যেতে পারে। বাস্তবসম্মত নীতি ও পরিপূর্ণ তদারকির অভাবে আগে এসব এলাকা সেভাবে রক্ষা করা যায়নি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নতুন ড্যাপের মূল বৈশিষ্ট্য বা দিকগুলো কী কী?

আদিল মুহাম্মদ খান: নতুন ড্যাপে অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা দর্শনকে উপজীব্য করে বিনিয়োগের সর্বজনীন স্বাধীনতা, নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ব্যবহার, এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবিধাদির সম্প্রসারণ এবং বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি বলা হয়েছে। পাশাপাশি নগর জীবনরেখার ধারণা হিসেবে টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে সড়কপথ, রেলপথের পাশাপাশি জলপথের ওপর গুরুত্বারোপ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অযান্ত্রিক যান ও পদচারী চলাচলের অগ্রাধিকার এবং নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের আবাসনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে এই ড্যাপে। এলাকাভিত্তিক পার্ক ও সবুজ এলাকা তৈরির প্রস্তাব হিসেবে ৬টি অঞ্চলে ৫টি আঞ্চলিক পার্ক, ৫৫টি জলকেন্দ্রিক পার্ক ও ১৪টি ইকোপার্ক তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদির বিপরীতে জনঘনত্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন এলাকার জন্য ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর), কাঠাপ্রতি পরিবারের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, যা নগর এলাকার জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এবারের ড্যাপে সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই প্লটভিত্তিক আবাসন প্রকল্পকে নিরুৎসাহিত করে ফ্ল্যাটভিত্তিক ও ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা ঢাকা শহরের পরিকল্পিত উন্নয়নে ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এসব প্রস্তাবের সফলতা নির্ভর করবে কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর। কেননা, অতীতে দেখা গেছে পরিকল্পনাগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন ও কার্যকর নজরদারির অভাবে অনেক পরিকল্পনায় সফলতা পাওয়া যায়নি এবং ঢাকা মহানগর ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যানজট ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি। নতুন ড্যাপ পরিস্থিতি কতটা সহনীয় করতে পারবে বলে মনে করেন?

আদিল মুহাম্মদ খান: ঢাকা মহানগরের বিদ্যমান নগরবাস্তবতা এবং রাষ্ট্র ও জনগণের আর্থসামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থাপনা নীতিমালা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিংয়ে গুরুত্ব প্রদানের পাশাপাশি অযান্ত্রিক বাহন ও পদচারীবান্ধব পরিকল্পনা ও অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ড্যাপে। নগরজীবনরেখার অংশ হিসেবে কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে ৫৭৪ কিলোমিটার জলপথ, ১ হাজার ২৩৩ কিলোমিটার অযান্ত্রিক যানবাহনের পথ, ২০২ কিলোমিটার সাইকেলপথে তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে।

যোগাযোগ চাহিদা ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য সাধনে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের নির্দেশনা আছে। একই সঙ্গে বেশ কিছু নতুন রাস্তা নির্মাণ ও রাস্তা সম্প্রসারণের প্রস্তাব আছে। এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের কার্যকর জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ঢাকার যানজট পরিস্থিতির কিছুটা উন্নয়ন সম্ভব।

ঢাকা শহরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা এসটিপি ও আরএসটিপিতে প্রস্তাবিত এমআরটি ও বিআরটি রুটের প্রস্তাবগুলো এবারের ড্যাপে আত্তীকরণ করা হয়েছে। এবারের ড্যাপে ঢাকা শহরের যানজট সমাধানে চলমান বিভিন্ন প্রস্তাব ও প্রকল্প নির্মোহ বিশ্লেষণ করার একটা প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। এই বিশ্লেষণের বিপরীতে পরিবহন ও নগর-পরিকল্পনায় আরএসটিপিতে কী ধরনের সংশোধনী আনা যেতে পারে, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা থাকার প্রয়োজন ছিল ড্যাপে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নতুন ড্যাপের যে মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বললেন, সেগুলো কতটা বাস্তবসম্মত বা বাস্তবায়নযোগ্য?

আদিল মুহাম্মদ খান: বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা দলিলটি একটি মাল্টিসেক্টরাল বা বহু খাতভিত্তিক পরিকল্পনা। ফলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সফলতা নির্ভর করবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার যথা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের যথাযথ ভূমিকা পালন এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুমোদন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখাকে যথাযথভাবে শক্তিশালী না করা হলে ভূমি ব্যবহার তদারকি, মিশ্র ব্যবহার ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা অনুমোদন, কৃষিভূমি ও বন্যাপ্রবাহ এলাকা সংরক্ষণ প্রভৃতি অনুষঙ্গের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নতুন ড্যাপ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি কী? কীভাবে শুরু হতে পারে? এখানে কোনো অগ্রাধিকারের বিষয় আছে কি?

আদিল মুহাম্মদ খান: ড্যাপের প্রস্তাবগুলো মোটাদাগে ব্যবস্থাপনা, নীতিনির্দেশনা, ভৌত পরিকল্পনা ও অবকাঠামো উন্নয়নসংক্রান্ত। ব্যবস্থাপনাগত ও নীতিনির্দেশনা–সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে আশু বাস্তবায়ন সম্ভব। ভৌত ও অবকাঠামো–সংক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা অর্থায়ন পরিকল্পনা ও সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা দ্রুত করে ফেলার জন্য সরকারের তরফ থেকে যথাযথ নির্দেশনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ড্যাপেও সীমিত আকারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। স্কুল, হাসপাতাল, পার্ক-উদ্যান প্রভৃতি নাগরিক সুবিধার প্রস্তাবের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য ‘ভূমিব্যাংক’ করার উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে। নাহলে পরবর্তী সময়ে ভূমি অধিগ্রহণ কঠিন ও সরকারের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: জলাবদ্ধতা, জলাধার রক্ষা, বন্যার পানিপ্রবাহ রক্ষা করা—ঢাকা শহরের এসব সমস্যার কথা দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত। নতুন ড্যাপে এ বিষয়গুলোর ওপর কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?

আদিল মুহাম্মদ খান: এবারের ড্যাপে মৌজাভিত্তিক নদী, খাল, পুকুর, জলাশয়, জলাভূমিকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এগুলোকে সংরক্ষণ করার কৌশল হিসেবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন কৌশল যুক্ত করা হয়েছে। এটি ইতিবাচক। ড্যাপে প্রস্তাবিত জলকেন্দ্রিক পার্কসহ জলাধার, জলাশয় রক্ষার প্রস্তাবগুলো সঠিক বাস্তবায়িত হলে জলাবদ্ধতার প্রকোপ কিছুটা কমবে। তবে জলাবদ্ধতার বিষয়টি সার্বিক নগর-পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পর্কিত। ভবন নির্মাণের সময় বাধ্যতামূলক অনাচ্ছাদিত স্থান সংরক্ষণ করার জন্য ড্যাপে প্রস্তাবিত নির্দেশনা সঠিকভাবে প্রতিপালন করলে বৃষ্টির সময় ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর চাপ কমবে, যা জলাবদ্ধতা কমাতে ভূমিকা রাখবে।

একই সঙ্গে আগের ড্যাপের বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলকে এবারের ড্যাপে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অঞ্চল (ওভারলে জোন) হিসেবে চিহ্নিত করে মুখ্য জলস্রোত এলাকা ও সাধারণ জলস্রোত এলাকা হিসেবে আলাদা করা হয়েছে। মুখ্য জলস্রোত এলাকায় উন্নয়ন ও ভূমির তল উন্নীতকরণ নিষিদ্ধ করা হলেও সাধারণ জলস্রোত এলাকায় সীমিত আকারে জনস্বার্থ–সংশ্লিষ্ট প্রকল্প, অবকাঠামো ইত্যাদি করার প্রবিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে কৃষি এলাকায় একক বাসস্থানের পাশাপাশি শর্তসাপেক্ষে ইকো রিসোর্ট, কৃষিভিত্তিক শিল্প, একক মালিকানাধীন বাড়ি প্রভৃতির অনুমোদন দেওয়া রয়েছে। এসব অনুমোদনপ্রক্রিয়া ও পরবর্তী সময় উন্নয়ন নজরদারি যথাযথ করার জন্য রাজউক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। না হলে উপরিউক্ত প্রস্তাবগুলো ভালো ফল বয়ে আনবে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নগর-পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি খুব জরুরি। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি কতটা গুরুত্ব পেয়েছে?

আদিল মুহাম্মদ খান: জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ভবনের ভেতর আলো-বাতাসের প্রবেশ নিশ্চিত করা, এলাকাভিত্তিক পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ তৈরি, বায়ুমানের উন্নতি, নদী, খাল, জলাশয়ের পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি পদক্ষেপ খুবই জরুরি। ড্যাপে এলাকাভিত্তিক পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ করার প্রস্তাব এসেছে। এগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার সুনির্দিষ্ট কার্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জনঘনত্ব পরিকল্পনার প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবনে আলো-বাতাস প্রবেশ কিছুটা বাড়ানো যাবে; কিন্তু পরিপূর্ণভাবে প্রতিটি আবাসিক ইউনিটে আলো-বাতাস নিশ্চিত করার জন্য ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রস্তাব সংযুক্ত করতে হবে। জলাশয়দূষণ রোধ করার জন্য শিল্প এলাকায় শিল্পায়ন ও এ এলাকার পাশে ‘সবুজ বেষ্টনী’ তৈরির ব্যাপারে নির্দেশনা আছে ড্যাপে। তবে বিদ্যমান শিল্পকারখানার ক্রমাগত দূষণ রোধ ও পয়োবর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করা গেলে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান বা ইটিপি ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগ ও তদারকির পাশাপাশি দূষণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর যথাযথ ‘পরিবেশদূষণ ফি’ আরোপ করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আমাদের সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার ওপর চাপ কমানোর ক্ষেত্রে নতুন ড্যাপ কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন?

আদিল মুহাম্মদ খান: ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াতে ঢাকার আশপাশের নগর ও অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ড্যাপের প্রস্তাব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকার সঙ্গে আশপাশের অঞ্চলের দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করার জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য রিংরোড, রেডিয়াল রোডসহ গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নয়নের সুপারিশ আছে ড্যাপে। ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে জনঘনত্ব ব্যবস্থাপনা ও ব্লক ডেভেলপমেন্টের সুপারিশের পাশাপাশি ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড পরিকল্পনার ধারণা ঢাকার ওপর চাপ কমাতে ভূমিকা রাখবে। তবে এ ক্ষেত্রে বর্ধিত নগর এলাকায় যেন মানসম্মত নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করা যায় ও আকর্ষণীয় নাগরিক সুবিধাসংবলিত উপকণ্ঠ (নেইবারহুড) তৈরি করা যায়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের গতানুগতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব হবে না, এ জন্য পৃথক পরিকল্পনা মান (প্ল্যানিং স্ট্যান্ডার্ড) ও পরিকল্পনার কৌশল ঠিক করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ঢাকা শহর পরিচালনার সঙ্গে অনেক সংস্থা জড়িত। সমন্বয় নিয়ে সমস্যার কথা দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। ড্যাপ বাস্তবায়নে সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়োজন। কাজটি করবে কে?

আদিল মুহাম্মদ খান: ঢাকা শহরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উদ্যোগগুলোর কার্যকর সমন্বয়ের জন্য ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। এবারের ড্যাপেও ‘মহানগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার কথা সংগতভাবেই এসেছে। এটি স্থানীয় নগর সরকার তথা সিটি করপোরেশনের মেয়রদের সমন্বয়ে গঠিত ‘চিফ কাউন্সিল’–এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, রাজউক ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে ড্যাপ বাস্তবায়নে ‘উপদেষ্টা কমিটি’ এবং ‘নির্বাহী কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। ড্যাপে প্রস্তাবিত ‘মহানগর সরকার’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে এ ধরনের নগরব্যবস্থা না করা হলে আমাদের আন্তসংস্থা সমন্বয়ের অভাবজনিত বিশৃঙ্খলা, জনগণের করের টাকায় অপচয় ও জনভোগান্তির অবসান হবে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রাজউকের বর্তমান যে কাঠামো বা সক্ষমতা, তারা ড্যাপ বাস্তবায়নে কতটা যোগ্য বা সক্ষম?

আদিল মুহাম্মদ খান: রাজউকের মূল কাজ পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ হলেও তাদের মূল আগ্রহ থাকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে। তদুপরি এবারের ড্যাপে ভূমি ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ব্যবহার, জনঘনত্ব পরিকল্পনা, পরিকল্পনা অনুমোদন, শিল্পদূষণ ব্যবস্থাপনা, টিওডি পরিকল্পনাসহ বিস্তৃত পরিসরে পরিকল্পনা অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। রাজউকের বিদ্যমান কাঠামোকে ঢেলে সাজানো ব্যতিরেকে এগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজউকের ‘পরিকল্পনা’ ও ‘উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ’ শাখায় উপযুক্ত সংখ্যক পেশাজীবী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক রাজউক বোর্ড পুনর্গঠন করে পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করা দরকার। উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে রাজউকের নজরদারির দুর্বলতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও পেশিশক্তির কাছে নতজানু হওয়ার উদাহরণও আছে। ঢাকার মতো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি শহরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে রাজউককে তার পরিকল্পনা দলিলের সঠিক বাস্তবায়নে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় ও আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে পারলে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় জনগণ ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করতে পারলে সরকারের জন্য ড্যাপ বাস্তবায়ন সহজতর হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আদিল মুহাম্মদ খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।