বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্যা সবাই স্বীকার করছেন। অর্থনীতির সমস্যাকে কীভাবে দেখতে হবে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান সমস্যার সর্বজনীন স্বীকৃতি এসেছে। হালকা সংকট আর গভীর সমস্যার মধ্যে আছে অর্থনীতি। সরকারের প্রশাসনিক লোকেরা আগে মেনে না নিলেও এখন এই সমস্যার কথা স্বীকার করছেন। সমস্যা লোহিত রেখা বা ‘রেড লাইন’ তখনই অতিক্রম করেছে, যখন ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ধারদেনা করতে গেলাম।
অর্থনীতির সমস্যা নিয়ে বিবেচ্য বিষয় হলো তিনটি। প্রথমত, এ পরিস্থিতির চিত্রায়ণ কীভাবে করব, পরিস্থিতির বর্তমান অভিপ্রকাশ কী কী সূচক ও প্রবণতা দিয়ে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই রকম পরিস্থিতি উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য কতখানি অনুকূল। কারণ, সামনে এলডিসি উত্তরণ, এসডিজি বাস্তবায়ন, অষ্টম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনার সমাপন, নতুন প্রেক্ষিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা ইত্যাদি আছে। তৃতীয়ত, এই মুহূর্তে কী করণীয়? মূলত স্বল্প মেয়াদে।
কিছুটা বিস্ময়কর হলেও, বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরা ‘রোগনির্ণয়’ ও ‘চিকিৎসা’র বিষয়ে মোটামুটি একমত। পরিহাসের জায়গা হলো, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে এখন যেসব বক্তব্য আসছে, তা দেশীয় অর্থনীতিবিদেরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন। তাই বাংলাদেশের সমস্যা ও করণীয় সম্পর্কে শুধু জাতীয় নয়; আন্তর্জাতিকভাবেও একধরনের ঐকমত্য আছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি আলোচিত উত্তরণকালীন ব্যবস্থাগুলো সৎ ও সম্পূর্ণভাবে পরিচালনা করতে পারবে?
পরিস্থিতি কতটা জটিল?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক প্রবণতাগুলো সংশ্লেষিত ও ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে। এটি ধরা পড়ে প্রবৃদ্ধির ধারা শ্লথ হয়ে যাওয়ার ফলে। এর দুটি কারণ আছে। একটি হলো প্রবৃদ্ধির অনুমিতি সম্প্রতি (আইএমএফের শর্তে) তিন মাস পরপর করা হচ্ছে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোর যে প্রবণতা আলোচিত ছিল, তা আগের চেয়ে সংযত হয়েছে। গত প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২৩) দেখেছি, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ শতাংশের নিচে। দ্বিতীয়ত হলো বিনিয়োগ আরও হ্রাস পাওয়ায় এবং ভোগও কমে যাওয়ায় অর্থনীতির বেগ আগের চেয়ে কমে গেছে। আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে, তা কেউ বলছে না। সব আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাসের অবনমন হয়েছে।
বর্তমান সরকারের গত ১৫ বছরের মেয়াদে জিডিপির অনুপাতে মোট বিনিয়োগ ৩০-৩২ শতাংশের বেশি নিতে পারেনি। বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩-২৪ শতাংশে এসে আটকে আছে। বিদেশি বিনিয়োগও প্রায় স্থবির। সামনে বিনিয়োগ কমবে বৈ বাড়বে না। কারণ, সরকার বিবিধ কারণে ঋণপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কাঁচামাল ও পুঁজি পণ্য আনার আমদানিপত্র খুলতে উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে সুদের হারে ‘৯-৬’ নীতি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে পারেনি। উপরন্তু ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে।
বিষয়টা হলো সরকার এত দিন এক ইঞ্জিনে বোয়িং বিমান চালিয়েছে। ইঞ্জিনটি ছিল সরকারি বিনিয়োগ। বন্ধ দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি হলো বেসরকারি বিনিয়োগ। এখন প্রথম ইঞ্জিনটির শক্তিও নিঃশেষ হতে চলেছে। এত দিন সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৭-৮ শতাংশের মতো ছিল। সরকারের যে আর্থিক সংগতি দরকার, তা রাজস্ব আদায় দিয়ে মেটানো যাচ্ছে না। সরকার তার রাজস্ব বাজেট দিয়ে দায়দেনা পরিশোধ, বেতন-ভাতা, ভর্তুকি দিতেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাজেট বাস্তবায়নে অর্থ দেওয়া যাচ্ছে না। আবার প্রকল্পে বিদেশি অর্থ ব্যবহার করতে পারছি না, কারণ ওই সব প্রকল্পের দেশীয় সম্পূরক অর্থায়ন জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ বছর তো স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে কম বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার, ২৭ শতাংশ (প্রথম সাত মাস)।
কেন অর্থ পাচ্ছি না?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ব্যয়যোগ্য অর্থ না পাওয়ার বড় কারণ হলো আমাদের প্রয়োজনীয় রাজস্ব আয় নেই। প্রবৃদ্ধি হলো, প্রবৃদ্ধি মানেই তো আয়। তাহলে সে আয়ের ওপর কর আদায় করা কেন গেল না? এখনো কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। এত দিন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম কর-জিডিপি অনুপাত ছিল বাংলাদেশে। এখন আফ্রিকার গরিব অঞ্চলের দেশগুলোর চেয়েও কম কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের।
এটা আর্থিক বা রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় চরম সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। এতে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব প্রকাশ পেয়েছে। একই সঙ্গে বৈরী রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে কর খেলাপি ও টাকা পাচার—কোনোটাই আটকানো সম্ভব হয়নি। উচ্চবর্গীয় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর আয় প্রায় অনেক এ ক্ষেত্রে ‘পবিত্র’ ছিল না। তাই সে আয় কার্যত করের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। তবে এত দিন রাজস্ব খাতে সংকট থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। কারণ, বাজেট ঘাটতি জিডিপির মোটামুটি পরিমিতভাবে ৫ শতাংশের আশপাশে ছিল।
বিগত দশকে অর্থনীতিতে শক্তির জায়গা ছিল বৈদেশিক খাত। নিট রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ওঠানামা করলেও, প্রবণতা ছিল ইতিবাচক। আর বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহও বৈদেশিক খাতকে চাঙা রাখে। তবে প্রকাশমান বৈদেশিক খাতের ভারসাম্যহীনতা এখন রাজস্ব খাতের পুঞ্জীভূত সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এটা অর্থনৈতিক সমস্যার জটিল ত্রিযোগ।
বিদেশি দায়দেনা পরিস্থিতি কতটা নাজুক বলে দেখতে পাচ্ছেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বহিঃখাতের বিষফোড়া এখন দায়দেনা পরিস্থিতি যা টাকার বিনিময় হারেও প্রতিফলিত হচ্ছে। সরকার গত দেড় দশকে যে ‘দৃশ্যমান’ উন্নয়ন পরিচালনা করেছে, এর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের প্রকাশ হলো এই দায়দেনা পরিস্থিতি। যথাসময়ে নীতি সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি মোচন না করা এবং সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি থাকায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বলা চলে অর্থনীতির ডায়াবেটিস হয়েছে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা সময়মতো না করলে তা সারা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রমান্বয়ে বিকল করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ রোগের চিকিৎসা আমরা সময়মতো করিনি। এখনো অবহেলা অব্যাহত আছে।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ আহরণ করতে না পারায় বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, এ সময় আমরা বিদেশের চেয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দুই গুণের বেশি ঋণ নিয়েছি। অনেকে বিদেশি ঋণ নিয়ে চিন্তিত, আমি বরং বেশি চিন্তিত দেশি ঋণ নিয়ে। ব্যাংক খাত থেকে সরকার ব্যাপকভাবে ঋণ নেওয়ায় ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ সীমিত হয়েছে। উচ্চ সুদে ট্রেজারি বন্ড দিয়ে ঋণ নিচ্ছে সরকার। সরকার দুই হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশি বন্ড ছেড়েছে জ্বালানি খাতের দায় মেটাতে।
বিদেশি ঋণের আলোচনায় ব্যক্তি খাতের নেওয়া বিদেশি ঋণের বিষয়টি আসে না। দেশ ১০০ টাকা ঋণ পেলে তার ২০ শতাংশ যায় ব্যক্তি খাতে। ব্যক্তি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তা বিনিময় হারসহ সামষ্টিক বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।
বলা হয়, বাংলাদেশ কখনো বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। অথচ মাসের পর মাস বিদেশিরা বিক্রীত পণ্যের মূল্য পাচ্ছে না। বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফার অর্থ দেশে নিতে পারছে না। এর ন্যূনতম পরিমাণ ৫০০ কোটি ডলার। এই বাংলাদেশ কোনো বিদেশি ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়নি। এই গর্বের জায়গায় তো ফাটল ধরেছে।
কেন এমন হলো?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কাঙ্ক্ষিত কর আহরণ করা যায়নি। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি বিনিয়োগ তেজি করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বিবিধ কারণে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পও যথাযথভাবে যথাসময়ে করা যায়নি। অবকাঠামো প্রকল্পগুলো অতিমূল্যায়িতভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বা হচ্ছে।
আবার সরকার যে জনগ্রাহী প্রকল্প নেয়নি, তা–ও বলতে পারব না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে সুবিধাভোগীদের নামমাত্র ভাতা দেওয়া হচ্ছে। আবার প্রকৃত সুফলভোগীদের সঙ্গে সুবিধা বিতরণের দুর্নীতি হচ্ছে। সর্বোপরি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের অবহেলা করা হয়েছে। শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে পারিনি। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দিতে পারিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি পরিসংখ্যানে দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি দেখার মতো। একটি চিত্র উঠে এসেছে। যেমন সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে, শিশুমৃত্যু বেড়েছে। মানুষ ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। অন্যদিকে যুব বেকারত্ব বেড়েছে। শ্রমশক্তিতে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষ হয় বেকার, না হয় শিক্ষার অভাবে আছে। যেটুকু কর্মসংস্থান হয়েছে, তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে হয়েছে, শোভন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সরকারি খানা জরিপ বলে ভোগ, আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে অনুভবনীয়ভাবে। বাংলাদেশ এখন দ্রুততম শতকোটি টাকা বানানোয় বিশ্বে প্রথম।
এ ধরনের ঘাটতি হলো কীভাবে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: স্বীকার করতে হবে, বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নের একটি পরিবর্তনশীল রূপকল্প এবং একটি বাস্তবধর্মী পথরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বেশ কিছু ইতিবাচক ও জনকল্যাণকর নীতি ও কর্মসূচি নিয়েছে। তবে এই পথচলার গণতন্ত্রহীনতা তাকে কায়েমি স্বার্থের কাছে জিম্মি করে ফেলেছে, উন্নয়ন চেষ্টা সুষম সুফল দেয়নি। জ্বালানি খাত এই পরিস্থিতিকে উৎকট করেছে।
লক্ষণীয়, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর বিন্যাসে বড় পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর বিজিএমইএ-কে একচেটিয়া পরাক্রমশালী বলা যায় না। এখন জ্বালানি খাতে সংশ্লিষ্টরা ক্ষমতাবান, ব্যাংকের মালিক তথা খেলাপিরা প্রতিপত্তিশালী, বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারেরা প্রভাবশালী।
এসব সমস্যা সমাধান না হওয়ার কারণ কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এক ইঞ্জিনের প্লেন নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রমের পর আর উড়তে পারে না। এক ইঞ্জিনে চলার সময় দ্বিতীয় ইঞ্জিন চালুর জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা নিতে পারে না। এসব দেশ প্রায়ই কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্রায়িত ও গণতান্ত্রিকতাবিচ্যুত রাষ্ট্র হয়ে যায়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার নাগরিকদের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া (ফিডব্যাক) পায়, এসব রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেসব রাস্তা ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যায়। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের অভাব, প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকার না থাকা, প্রতিযোগিতাহীন জাতীয় নির্বাচন ইত্যাদি এর বৈশিষ্ট্য। প্রশাসন, আইন রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারব্যবস্থা ও নজরদারি সংস্থাগুলো নিরপেক্ষতা হারাতে থাকে। দেখা যায় চাটুকার পেশাজীবী সম্প্রদায়, সংযত গণমাধ্যম ও ম্রিয়মাণ নাগরিক সমাজ।
বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক উচ্চবর্গের সঙ্গে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রকাঠামোভিত্তিক গোষ্ঠীর কলুষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্ক অর্থনীতিতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার প্রতিবন্ধক হয়ে গেছে। অথচ প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা ভীষণভাবে প্রয়োজন বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ক্রমবর্ধনশীল উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
মনে রাখতে হবে, প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন প্রতিযোগিতাপূর্ণ রাজনীতি। আমাদের রাজনীতি তো এখন একটি অপস্রিয়মাণ প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুশীলনে অধিকার ও মেধার চেয়ে আনুগত্য ও মেধাহীন সংযোগ প্রাধান্য পাচ্ছে। দেশে উদ্যোগ, উদ্ভাবন ও উৎকর্ষের বিস্তারে এটি একটি বড় অন্তরায়।
রাজনীতির সঙ্গে এই পরিস্থিতির সম্পর্ক কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আগে বলেছি, গত দেড় দশকে যে রাজনৈতিক অর্থনীতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে প্রচলিত ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর নতুন বিন্যাস হয়েছে। পুরোনোদের নতুন অবয়ব এসেছে, নতুন গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছে। আগে রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক দেখতাম। এখন এর সঙ্গে প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্তঃস্থিত গোষ্ঠীর স্বার্থ যুক্ত হয়েছে। ফলে প্রতিযোগীসক্ষম উদ্যোক্তারা হতাশ হয়ে গেছেন।
নতুন সরকার এসে ব্যাংক খাতে সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, লক্ষ করি তা তিন সপ্তাহের মধ্যেই থমকে গেছে। আসলে যেসব কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী দেশের এই জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রেখেছে, তাদের মোকাবিলা করার জন্য রাজনৈতিক শক্তি দরকার। সেই শক্তি বিগত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার অর্জন করতে পেরেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
বাগাড়ম্বরের সঙ্গে বাস্তবতার পার্থক্য আছে, এটাই প্রতারণামূলক বাস্তবতা। এসব সমস্যার বস্তুনিষ্ঠ মৌলিক মূল্যায়ন করে আগামী বাজেটে একটি সামগ্রিক ও সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া উচিত। কিন্তু এখানেও হোঁচট খেতে হয়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যে নেতৃত্ব দরকার, তা দেখছি না। এখন আর নীতি সংস্কারের মৌখিক আশ্বাসে আইএমএফও আস্থা রাখে না। বাজারও বিশ্বাস করে না। এর মানে, অর্থনীতি একটা আস্থাহীনতার সংকটে আছে। এমন অবস্থায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি শ্লথ হবে, কর্মসংস্থান কমে যাবে। সামাজিক দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে। এ সরকারের আমলে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, তারাই সবচেয়ে বেশি আঘাত পাবে।
তাহলে কী করা উচিত?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সার্বিকভাবে বিগত সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সার্বভৌমত্ব চলে গেছে। আগে রাজনৈতিক উচ্চবর্গীয়রা (এলিটরা) ছিলেন, করপোরেট জগতের উচ্চবর্গীয়রা ছিলেন। এখন রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চবর্গীয়রা যুক্ত হয়েছেন। এই নতুন গোষ্ঠীর কেউ উর্দি পরা, কেউ উর্দি ছাড়া। এই নতুন ক্ষমতার গোষ্ঠীবলয় বাংলাদেশের ভবিষ্যতে আস্থা রাখে না। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে সমাজ ও অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের অনুশীলন ফিরিয়ে আনতে হবে। জবাবদিহিহীন ও দায়বদ্ধহীন শুভচিন্তা শেষ বিচারে উপকারী হয় না। টেকসইও হয় না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আপনাকেও ধন্যবাদ।