প্রথম আলো: ২৩ জুন আপনার ৮৮তম জন্মদিন। আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। পেছনে ফিরে তাকালে ৮৭ বছরের জীবনকে কীভাবে দেখেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি যে পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগিয়েছি, তাতে জীবন অন্য রকম হওয়া সম্ভব ছিল। চাকরি, ব্যবসার ওপর নির্ভর করে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো বিকশিত হচ্ছিল, আমি সেই পরিবারের সন্তান। আমার জন্ম গ্রামে, নানাবাড়িতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা গ্রামে ছিলাম। আমার বাবা তখন চাকরিসূত্রে রাজশাহী ছিলেন। আমরা রাজশাহীতে গেলাম। বাবা রাজশাহী থেকে কলকাতায় বদলি হলেন। আমরাও কলকাতা চলে গেলাম। কলকাতায় আমরা বেশ গুছিয়ে বসেছিলাম। আমাদের চিন্তা ছিল অনেক দিন কলকাতা থাকব। কিন্তু কলকাতার দাঙ্গা ও দেশভাগের কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই বাবা অপশন নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকায় তখন থাকার খুব অসুবিধা। আত্মীয়দের বাড়িতে উঠতে হলো। ১৯৫০ সালে আমরা প্রথমে থাকার জায়গা পেলাম আজিমপুর কলোনিতে। সেখানে তখন ৫০০ পরিবার থাকত, সবাই সরকারি চাকরি করেন। আমার ম্যাট্রিক, আইএ, অনার্স, এমএ পরীক্ষা—সবই আজিমপুর কলোনি থেকে দিয়েছি।
পড়াশোনা শেষে চাকরি নেওয়ার পর প্রথম আমি আজিমপুর কলোনি থেকে বের হলাম। প্রথমে হরগঙ্গা কলেজে চাকরি করি, সেখানে কয়েক মাস চাকরি করার পর জগন্নাথ কলেজে চলে আসি। সেখানে ৯ মাস শিক্ষকতা করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা খালি হলে সেখানে চলে এলাম।
প্রথম আলো: আপনার বেড়ে ওঠা ও আপনার চিন্তাচেতনায় কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার চিন্তাচেতনায় বাবার প্রভাব আছে। আমার বাবা স্টেটসম্যান ও আজাদ পত্রিকা পড়তেন। স্বাধীনতা পড়তেন। কলকাতা থাকতেই তিনি আমাদের বলতেন, স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু আসলে স্বাধীনতা কোথায়? স্বাধীনতা ছিল কমিউনিস্টদের পত্রিকা। ঢাকায় আসার পর তিনি দেখলেন, সেক্রেটারিয়েটে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্য। তিনি বলতেন, এখানে তো খাজা নাজিমুদ্দীন বলেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি, তোমরা তো স্বাধীন হওনি’। এসব ধারণা আমি বাবার কাছ থেকে পেয়েছি।
তবে আমি যতটা না মায়ের দ্বারা প্রভাবিত, ততটা বাবার দ্বারা প্রভাবিত নই। মায়ের কাছ থেকে যে শিক্ষাটা পেয়েছি, সেটা হলো গণতান্ত্রিকতার শিক্ষা। আমার বাবা কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ছিলেন। উঠতি বুর্জোয়ার ছেলে পাস করবে, সিএসপি হবে, বড় আমলা হবে—এই উন্নতির কথা বলতেন। সেই তুলনায় মা ছিলেন অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। পাড়াপ্রতিবেশী তো বটেই, গ্রামের মানুষের সঙ্গে মায়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমার মায়ের ঘনিষ্ঠতম বান্ধবীদের একজন ছিলেন গোয়ালিনী মা। গোয়ালিনী মা আমাদের আজিমপুরের ছোট্ট বাসায় এসে থেকেছেন। বাড়ি থেকে মুড়ি, মোয়া, গুড়, চিড়া—এগুলো নিয়ে আসতেন। আমার মা শ্রেণিনির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন।
প্রথম আলো: আপনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন কি কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা যখন আজিমপুর কলোনিতে থাকতাম, তার পাশেই ছিল তমদ্দুন মজলিসের অফিস। তমদ্দুন মজলিস তখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আইএ পড়তাম, তমদ্দুন মজলিসের সৈনিক পত্রিকায় লিখতাম। সেখান থেকে দ্যুতি নামে একটা মাসিক পত্রিকাও বের হতো। সেখানেও লিখতাম। পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে আমার একটা সংযোগ তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু আমি যখন এমএ ক্লাসে উঠেছি, তখন আমার মধ্যে এই বোধটা জন্ম নিয়েছে যে তমদ্দুন মজলিস যে সমাজতন্ত্রের কথা বলে, সেটা ইসলামি সমাজতন্ত্র। তারা পাকিস্তান রেখে সমাজতন্ত্র করতে চায়। পাকিস্তানে কেন ইসলাম হচ্ছে না, সেটাই তাদের প্রধান বিষয়। তারা শ্রেণিগত কাজের চেয়ে মতাদর্শগত কাজকে গুরুত্ব দেয়।
প্রথম আলো: সে সময় তো কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশন ছিল। তাদের সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ ছিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে আমার সংযোগ ছিল না। কিন্তু আমরা তখন নতুন সাহিত্য ও পরিচয় নামে দুটি পত্রিকা পড়তাম। এ দুটি পত্রিকা কমিউনিস্ট পার্টির ভাবধারায় পরিচালিত। কলকাতা থেকে বের হতো। এ দুটি পত্রিকা আমার খুব প্রিয় ছিল। সে সময় ঢাকা থেকে বাম ধারার পত্রিকা বের হতো না। সিলেট থেকে বের হতো নও–বেলাল।
প্রথম আলো: পঞ্চাশের দশকে নিবু নিবু হলেও প্রগতি লেখক সংঘের একটা তৎপরতা ছিল এখানে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সে সময় আমরা একটা বুর্জোয়া বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সমাজতান্ত্রিক ধারাটি পরে পেয়েছি। ১৯৫১ সালে ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনীটা হলো লিটন হলে। আমি তখন সেই প্রদর্শনীর ওপর একটা রিভিউ লিখেছিলাম, সেটা জিন্দেগি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। জিন্দেগি পত্রিকার অফিসেই পরে সংবাদ পত্রিকা শুরু হয়। সংবাদ-এর খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ত হই। তখন আমি খেলাঘর করার বয়স পার হয়ে এসেছি। খেলাঘরের পরিচালক ছিলেন কবি হাবীবুর রহমান। তাঁর কাছে লেখা পাঠাতাম।
আজিমপুর কলোনিকেন্দ্রিক যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠছে, সেখানে একটা নতুন চেতনার জন্ম হয়। আমরা আজিমপুর ছাত্র সংঘ গঠন করলাম। আমি সেই সংগঠনের সাহিত্য সম্পাদক। আমরা সেখান থেকে হাতে লেখা পত্রিকা, দেয়ালপত্রিকা বের করতাম। পাঠাগার করতাম। আমরা সেখানে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত এই তিন কবিকে নিয়ে উৎসব করলাম।
প্রথম আলো: আপনি প্রথম দেশের বাইরে গেলেন কবে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি ইংল্যান্ডে গেলাম দুবার। প্রথম গেলাম ১৯৫৯ সালে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্কলারশিপে। লিডস ইউনিভার্সিটির ১০ মাসের পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা। এরপর ১৯৬৫ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। সেখান থেকে পিএইচডি করলাম।
প্রথম আলো: আপনার চিন্তাচেতনার রূপান্তর কখন হলো?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ১৯৫৯ সালে। তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হয়েছে। ইংল্যান্ডজুড়ে একটা পুঁজিবাদবিরোধী অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের সময় চলছে। তারা নাটক লিখছে, সিনেমা করছে। আমি পড়তে গেছি লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিডস এলাকাটি বামপন্থীদের এলাকা। সেখানে বামপন্থী ছেলেমেয়েদের সংগঠন ছিল।
অ্যাংরি ইয়াংম্যানরা সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। তাঁরা পুঁজিবাদবিরোধী ছিলেন। তখন আমরা নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকা পড়তাম। সাপ্তাহিক এই পত্রিকা বামপন্থীদের।
প্রথম আলো: ১৯৬৫-তে গিয়ে দেশে ফিরলেন কবে? এ সময় কী পরিবর্তনটা দেখলেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ৬৮-এর জুলাই মাসের শেষে ফিরলাম। তখন এখানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চলছে। প্রথম পরিবর্তন যেটা দেখলাম, আমি যখন ইংল্যান্ডে গেছি, তখন ক্যাম্পাসে কোনো গাড়ি দেখতাম না। আইয়ুব সরকার তখন গাড়ি আনার ক্ষেত্রে সুবিধা এনে দিয়েছিল। গাড়ির ওপর কোনো ট্যাক্স ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যাঁরা পিএইচডি করতে যেতেন, তাঁরা একটা করে গাড়ি নিয়ে আসতেন। কেউ নিজে রাখতেন, কেউ আবার বিক্রি করে দিতেন। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার আগে আমি ও আমার স্ত্রী দুজনে ভাবলাম, ঢাকা শহরে গাড়ি নিয়ে যাব, আমরা চালাব কোথায়? আমাদের আত্মীয়স্বজন কারও গাড়ি নেই। তাদের মনের ভেতর একটা দুঃখবোধ তৈরি হবে। সে কারণে আমরা গাড়ি আনিনি। দেশে ফেরার পর বন্ধুবান্ধবের প্রথম প্রশ্নটিই ছিল গাড়ি কোথায়? গাড়ি তখন সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।
রাজনৈতিকভাবে দেখলাম, রাজ্জাক (অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক) সাহেব ও সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের মধ্যে খুবই গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সাজ্জাদ সাহেবকে একবার সেক্রেটারি বানানো হলো। তিনি এই শর্তে রাজি হলেন যে রাজ্জাক সাহেবকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি করতে হবে। দুজনের মধ্যে এতটাই খাতির ছিল। ঢাকায় ফিরে দেখি রাজ্জাক সাহেব ও খান সারওয়ার মুরশিদ সাহেব একদিকে, আর সাজ্জাদ সাহেব আরেক দিকে। ৬৫-এর যুদ্ধের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বিকাশ ঘটেছে, তার পক্ষে ছিলেন রাজ্জাক ও মুরশিদ সাহেব। আমি অবাক হলাম, সাজ্জাদ সাহেবের মতো একজন সফিসটিকেটেড মানুষ মোনায়েম খানের পয়গাম পত্রিকায় কলাম লিখছেন।
তৃতীয়ত, দেশে ফেরার পর দেখলাম জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে।
প্রথম আলো: সে সময় কি কোনো সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিলেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আইয়ুব খানের অন্যায় কাজগুলোর একটি ছিল ১৯৬১ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স। পাকিস্তানজুড়েই করা হয়েছিল। সেই অর্ডিন্যান্সে ছাত্রদের তো বটেই, শিক্ষকদেরও অধিকার খর্ব করে নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষকদের লেখার জন্য অনুমতি নিতে হতো। এই আমলাতান্ত্রিক অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে আমরা শিক্ষকেরা প্রতিবাদ করলাম। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হলো, সেই নির্বাচনে আমরা যারা এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী, সবাই জয়ী হলাম। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলাম। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সমান্তরালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করেছি। আমার এক ছাত্রীর মাধ্যমে ন্যাপের মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী দুই অংশে ভাগ হয়ে গেছে, কোনো পন্থাতেই আমার আস্থা ছিল না।
প্রথম আলো: একাত্তরের মার্চে লেখক সংগ্রাম শিবির করলেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংঘ ছিল। ১৯৬৫ সালে সেই সংগঠনটাকে নির্বাচিত সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। নির্বাচনে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। মুনীর চৌধুরী সভাপতি, আমি কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলাম। এর কার্যালয় ছিল বর্তমান বর্ধমান হাউসে। লেখক সংঘ থেকে পরিক্রম পত্রিকাটি বের করতাম, এ পত্রিকাটি বুর্জোয়া বিকাশের প্রতিনিধিত্ব করত। সেখান থেকেই লেখক সংগ্রাম শিবির তৈরি হয়েছিল। আমরা সেখানে যুক্ত হয়েছিলাম।
প্রথম আলো: আপনার চিন্তায় শ্রেণির বিষয়টা প্রথম কখন এল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই প্রথম শ্রেণি বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের একজন অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর নাম আর্নল্ড কেটি। তিনি মার্ক্সবাদী ছিলেন। আমাদের উপন্যাস পড়াতেন। তিনি ব্যাখ্যা করতেন শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে। পিএইচডি করে ফেরার পর এসে দেখলাম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। সে সময় আমার কাছে প্রশ্নটা জন্ম নিল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটা সফল হবে, এরপর কী হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চরিত্রটা কী হবে—এসব প্রশ্ন আমার ভেতরে হতো। পাকিস্তান থাকবে না, সেটা আমরা নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের পরিবর্তে যে বাঙালি শাসকেরা আসবেন, তাতে কি রাষ্ট্রের চরিত্রের পরিবর্তন হবে? এই প্রশ্ন থেকেই সমাজতন্ত্রের প্রশ্নটি সামনে আসে।
প্রথম আলো: আপনি এই বয়সেও চিন্তা ও কাজে প্রবলভাবে সক্রিয়। আপনার এত প্রাণশক্তির উৎস কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর মূল কারণ, আমি খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন করি। আমার একটা অভ্যাস হলো প্রতিদিন সকালে উঠে হাঁটা। এখনো আমি নিয়মিত হাঁটি। আমি খুব নিয়মানুবর্তিতা পালন করি। কাজেই স্বাস্থ্যের দিক থেকে আমাকে কখনো হাসপাতালে থাকতে হয়নি। আমার কাজের পেছনে মনের জোরও কাজ করেছে। মনে হয়েছে, আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। আমি একসময় নিয়মিত শিক্ষকতা করেছি, প্রতি সপ্তাহে সংবাদ-এ একটা কলাম লিখেছি, প্রতিবছর আমার একটা বই বের হয়েছে, পত্রিকা সম্পাদনা করেছি। এত কাজ আমি একসঙ্গে করতে পেরেছি শৃঙ্খলার কারণে, রুটিনমাফিক চলার কারণে।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিতে কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন? গোলাপি দল গঠনের পেছনে কী কারণ ছিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমরা তো একসময় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন করেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা দেখতে পেলাম, যাঁরা এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কর্তৃত্ব করছেন। প্রথমে উপাচার্য হলেন মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী। এরপর উপাচার্য হলেন আবদুল মতিন চৌধুরী। তিনি উপাচার্য হওয়ার পর একটা স্বৈরাচারী রাজত্ব কায়েম করলেন। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন এল। সে সময়ে আমরা যারা এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী, তারা একটি প্যানেল দাঁড় করালাম। নীল দল, গোলাপি দল—এ নামকরণের পেছনে একটা মজার বিষয় আছে। আমরা গোলাপি দলের সদস্যরা গোলাপি কাগজে লাল অক্ষরে প্যানেল ছাপাতাম। এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে যাঁরা, তাঁরা নীল কাগজে কালো কালিতে প্যানেল ছাপাতেন। নির্বাচনে আমি সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটে সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম।
প্রথম আলো: নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সে সময়ে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা দেখেছি। যেটা এখন একেবারেই অনুপস্থিত। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: স্বাধীনতার পর আমরা মহা উৎসাহে নানা কাজ করেছি। পত্রিকা প্রকাশ করেছি। ডাকসু ছিল একটা বিরাট ব্যাপার। সেখানে নিয়মিত বিতর্ক হতো। নাটক হতো। আন্তহল সাহিত্য প্রতিযোগিতা হতো। হলগুলো থেকে ম্যাগাজিন বের হতো। গানবাজনা, বিতর্ক, খেলাধুলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণবন্ত ছিল। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ হতো ছাত্র সংসদের মাধ্যমে।
সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি উদ্যোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশনা সংস্থা করেছিলাম। উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণাকেন্দ্র করার পেছনেও আমার ভূমিকা ছিল। এগুলোর সবকিছুই থেমে গেল ১৯৯১ সালের পর। স্বৈরাচারবিরোধিতার মধ্য দিয়ে এসব চর্চা বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক আমলেই থেমে গেল। শিক্ষকদের একাংশ গেলেন আওয়ামী লীগ প্রধানের কাছে। আরেক দল গেলেন বিএনপির প্রধানের কাছে। শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসনের অবসান হলো।
প্রথম আলো: দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা কতটা বাস্তবে রূপ নিল?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়নি। আমরা আশা করেছিলাম সামাজিক রূপান্তর ঘটবে। সেটা হয়নি। এখন সমাজের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু রূপান্তর হচ্ছে না। পাকিস্তান আমলে ঔপনিবেশিকতা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঔপনিবেশিকতা, বাংলাদেশ আমলে ঔপনিবেশিকতা হলো বাঙালি ধনীদের ঔপনিবেশিকতা। এটাকে প্রতিহত করা যায়নি। স্বাধীনতার পর পরিকল্পনা কমিশন হলো, শিক্ষা কমিশন হলো, কিন্তু বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন হলো না।
প্রথম আলো: আমাদের শিক্ষা এখন কী অবস্থায় আছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষার বিস্তার হয়েছে, কিন্তু মান বাড়ছে না। এর প্রধান কারণ হলো উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। মেধাবী মানুষকে যদি শিক্ষকতায় না আনা যায়, তাহলে শিক্ষার মান বাড়বে না। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে গেলে বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে এবং সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে। সামাজিক মর্যাদা আগে শিক্ষকের ছিল, এখন আর সেটা নেই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতাম পড়াশোনা, গবেষণা, প্রকাশনা—এগুলো নিয়ে। এখন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটা বদলে গেছে। কে কত আয় করতে পারে, কার কয়টা গাড়ি আছে—এগুলো এখন প্রতিযোগিতার বিষয়।
প্রথম আলো: তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী। তারা তো কোনো বড় স্বপ্ন দেখতে পারছে না। এর কারণ কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: তরুণদের আমরা হতাশ করেছি। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করিনি। তরুণেরাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছে। উনসত্তরের অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধে তারাই প্রধান শক্তি। এসব অসম্ভব কাজ এ দেশের তরুণেরা করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এসেছে, তারা তরুণদের ব্যবহার করতে চেয়েছে। আগে তরুণেরা বিদ্রোহ করেছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পর তাদের সেই ভূমিকা আর রইল না। একাংশ চলে গেল রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে, আরেক অংশ বামপন্থীদের বিভক্ত ধারার মধ্যে গিয়ে হতাশ হলো। নতুন একটা সুযোগও এল, অনেকে যারা বিদেশে গেল, তারা আর ফিরে এল না।
আমি বলব, তরুণদের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল এখন সমাজে দেখছি। তারা সমাজে নানা অনাচার দেখছে, অপরাধ দেখছে। তরুণদের সামনে কোনো লক্ষ্য নেই। পাকিস্তান আমলে লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার। স্বাধীন হওয়ার পর সেই লক্ষ্য হওয়া দরকার ছিল সমাজতন্ত্রের। সেটা হয়নি। এ জন্য তরুণেরা দায়ী নয়।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।