অবশেষে সরকার নির্বাচন করেই ফেলল। এখন এই নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শান্তনু মজুমদার: এই প্রশ্নটার মধ্যে একটা আক্ষেপ বা শ্লেষ আছে। আমার অবশ্য তা নেই। আমি মনে করি, এই নির্বাচনটা হওয়ার দরকার ছিল। সেটা হয়েছে। আপনি যদি জানতে চান এই নির্বাচন¦ সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছে কি না, আমি বলব ‘না’। কারণ, বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি যেকোনো কারণে হোক নির্বাচনে আসেনি।
অনেকেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ আসলে কখনোই চায়নি যে বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আবার অনেকে বলেছেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপি চালে ভুল করেছে। কিন্তু নির্বাচন হয়ে গেল...
শান্তনু মজুমদার: বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা দুটি আপস-অযোগ্য দাবি তুলেছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল। প্রথম দাবিটায় কেউ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয়নি। আর তত্ত্বাবধায়কের দাবির এবার ইতি ঘটা দরকার। এই দাবিটা বিপজ্জনক, অগণতান্ত্রিক এবং রাজনীতি ও রাজনীতিকদের জন্য চূড়ান্ত অসম্মানজনক। গণতন্ত্র পাঁচ মিনিটের জন্যও অগণতান্ত্রিক কারও হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দেওয়া সমর্থন করে না। ভালো নির্বাচনের ব্যাপারে আপত্তি থাকলে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় সময়ের পরীক্ষিত পথগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষ কোনো সমাধান নয়। যাঁরা এটা চালু করেছিলেন, তাঁরা ভুল করেছিলেন।
বিরোধী দলের তাহলে উপায় কী? পড়ে পড়ে মার খাওয়া?
শান্তনু মজুমদার: সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল হলো গভর্নমেন্ট ইন ওয়েটিং। তাদের সংবিধানসম্মত অধিকার আছে। একই সঙ্গে কর্তব্য আছে। ক্ষমতাসীনেরা যখন বিরোধীদের অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে, তখন শুধু বিরোধী দল নয়; গণবুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের দায়িত্ব হলো গণতান্ত্রিক বিরোধীদের পাশে দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা। আর বিরোধীদের মধ্যে যদি গণতান্ত্রিক শিকড় ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন দল না থাকে, তখন কী হবে? এটাও ভাবার ব্যাপার আছে।
আমাদের সমাজ তো বিভক্ত। এক সুরে কথা বলার মতো লোক কোথায়?
শান্তনু মজুমদার: কেন নয়! বহু মানুষ বিরোধীদের সমর্থন দিচ্ছেন। তবে সরকারি দলের হলেই দানব এবং বিরোধী দলের হলে পরম পূজ্য, এহেন সমীকরণ অন্যায্য। বিএনপির দুই দাবি নিয়ে বিদেশ থেকে কিন্তু কোনো সমর্থন আসেনি। আর বাকি ছিল কূল-ভাসানো গণ-আন্দোলন। হামলা-মামলার কথা যতই বলা হোক; বাস্তবতা হচ্ছে বিরোধীরা এই ঘটনা ঘটাতে পারেনি।
লোকের কষ্ট হচ্ছে দ্রব্যমূল্য নিয়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তথাকথিত সিন্ডিকেট, টাকা পাচার, এমন অনেক ইস্যু আছে, যা দিয়ে সরকারকে জেরবার করে ফেলা সম্ভব। এগুলো ঠিকঠাকভাবে উত্থাপন করা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশ একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে?
শান্তনু মজুমদার: আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, বাংলাদেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে লিখিত নীতি-আদর্শ এবং অনুশীলনের মাধ্যমে ধারণ করা বিরোধী দলের অভাব আছে। এই বাস্তবতা সরকারি দলের কুপথগামী হওয়ার সুযোগ তৈরি করে।
সব উত্তর ঔপনিবেশিক দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠতে সময় লাগবে। বাংলাদেশের মতো একাধিক নামে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের ক্ষমতায় আসা দেশে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী নতুন শতক শুরুর কয়েক বছর পর থেকেই চলছে গণতন্ত্র-ঘাটতি। বাংলাদেশেও এটা চলছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, রাশিয়া সবাইকেই কথা বলতে শুনেছি। বাংলাদেশকে নিয়ে দেশগুলোর এত আগ্রহের কারণ কী?
শান্তনু মজুমদার: বাংলাদেশের এখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক গুরুত্ব আছে। দুটো শক্তি যারা কখনোই একমত হয় না, সেই ভারত ও চীন বাংলাদেশ ইস্যুতে ভিন্ন জায়গা থেকে একমত হয়েছে। অন্য পক্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা। বাংলাদেশের বাজার বড় হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরসহ এর ভৌগোলিক কারণে এর কৌশলগত গুরুত্বও আছে। গত মাস ছয়েক বাদ দিলে শেখ হাসিনা বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে ভালো খেলেছেন। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচনের পর আগামী সপ্তাহ ও মাসগুলোতে কে কেমনভাবে ক্রিয়া করে।
যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা বলেছিল। সামনে তাদের তরফে কোনো উদ্যোগ আসতে পারে বলে মনে করেন কি?
শান্তনু মজুমদার: আমার ধারণা নেই। নির্বাচন নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মৃদু সমালোচনা আছে।
সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে অনেকেই বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল বলার চেষ্টা করছেন। দলটি নিষিদ্ধ হতে পারে, এমন আলোচনা আছে...
শান্তনু মজুমদার: আপনার কাছে শুনলাম। এমন কিছু হওয়াটা আজগুবি কাজ হবে। এমন কিছু হলে কে লাভবান হবে?
নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে ভাগ করার যে কৌশল নিল, দলের ওপর তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে কি?
শান্তনু মজুমদার: নির্বাচনকে ঘিরে যে মতবিরোধ দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেটা আরও গাঢ় হতে পারে। অফিশিয়াল প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর যে বিরোধ, সেটা কোনো কোনো জায়গায় থেকে যাবে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, সরকারি দলের ওপরে দলপ্রধানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে বলুন, বাংলাদেশের বর্তমান যে সরকারব্যবস্থা, সেটা আসলে কী? এটা আসলে কোন ধরনের গণতন্ত্র? উত্তরণের পথ কী?
শান্তনু মজুমদার: রাজনীতি থেকে মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক বিদায় করা গেলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকঠাক চলার পথ তৈরি হয়। এই বক্তব্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল দুইয়ের জন্য প্রযোজ্য। সরকারি দলের প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দরকার। সর্বদা বিষাদ-গীতি পরিবেশনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলের দিক থেকে সরকারের সঠিক সমালোচনা করা জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হিতে বিপরীত হয়েছে। এতে রাজনীতিবিদদের প্রতি ঘৃণা বেড়েছে। এই ধারণা থেকে অনতিবিলম্বে বেরিয়ে আসা দরকার। তরুণদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া দরকার। আর বিরোধী দল ও সরকারি দল দুই পক্ষকেই কুতথ্য ও সহিংসতা থেকে দূরে থাকতে হবে।
আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি? তাদের সম্পর্ক?
শান্তনু মজুমদার: সমঝোতা হয়ে যাবে বলে আশা দেখি না। কারণ, বিবদমান এই দুটি শক্তির মধ্যে ভোটের বাইরেও একটা বিষয় আছে। তা হচ্ছে মতাদর্শ।
আপনাকে ধন্যবাদ।
শান্তনু মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।