প্রথম আলো: আজ ঢাকা শহরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশ কিছু দলের সমাবেশ। তারিখটিও ২৮ অক্টোবর। নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই দিনে সমাবেশ ডাকায় মানুষের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই শঙ্কা কি যৌক্তিক, কোন পথে এগোচ্ছি আমরা?
হারুন-অর-রশিদ: সংঘাতময় পরিস্থিতি এটাই প্রথম না। নব্বইয়ের দশক থেকে আমরা সাংঘর্ষিক রাজনীতি হতে দেখেছি। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর মাগুরা ও মিরপুরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূচনা হয় এবং একপর্যায়ে বিরোধীদলীয় ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। আমরা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঘিরে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। ২০০৬-০৭–এর কথা মনে করুন। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা দেখেছি আমরা, সেটা ছিল সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেই দেখবেন, দুই দলের মধ্যে যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব, সাংঘর্ষিক সম্পর্ক, সেটা বরাবরই নির্বাচনের সময় দৃশ্যমান হয়। তবে এবার পরিস্থিতি অতটা সংঘাতময় নয়।
প্রথম আলো: আপনি শুরুতেই বলেছেন, আপনার মনে হচ্ছে এবার পরিস্থিতি অতটা সংঘাতময় নয়। কেন মনে হচ্ছে?
হারুন-অর-রশিদ: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনগণের সচেতনতা, মিডিয়া, বিদেশিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—এসব কিছু মিলে একটা পরিবেশ–পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের আরেকটি সংস্করণ হতে পারে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এটা অবাধ ও সুষ্ঠু হতে বাধ্য। এর কোনো আর বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় দলের যে সভা করলেন, সেখানে স্পষ্ট বলেছেন, আপনাদের নিজেদের যোগ্যতায় নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। আমি কাউকে নির্বাচিত করে নিয়ে আসতে পারব না। তার মানে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার কোনো বিকল্প নেই। যদি এবার নির্বাচন সুষ্ঠু না হয়, যারাই এ জন্য দায়ী থাকবে, তাদেরই চড়া মূল্য দিতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন একটি অগ্নিপরীক্ষা।
প্রথম আলো: কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা কতটুকু?
হারুন-অর-রশিদ: এবারকার নির্বাচন নিয়ে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র বা উন্নয়ন সহযোগী বলি যাদের, তারা পর্যবেক্ষণ করছে। আগের কোনো নির্বাচনেই তাদের এত মনোযোগ ছিল না। আমার মতে, এই মনোযোগ ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী দল—সবার জন্য প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে। যদি জাতীয় ক্ষেত্রে বলি, জনগণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে চায়। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পাঁচ হাজার তরুণের ওপর জরিপ করেছে। তাদের ৯০ ভাগ বলেছে তারা ভোট দিতে যাবে।
প্রথম আলো: কিন্তু বিএনপি তো এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছে এবং বলেছে, দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। এ অবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কী করে হবে?
হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচনে বিএনপি না এসে ৫০০ দল এলেও কোনো লাভ হবে না, এটা ঠিক। তবে ২০১৪ সালে যে সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে, একই কাজ করলে রাজনৈতিকভাবে তাদের চরম মূল্য দিতে হবে। প্রথমত, তারা সরকার পতনের এক দফা দাবি করেছে। তার মানে বিএনপিকে একটা গণ-অভ্যুত্থান করতে হবে। কিন্তু শুধু নেতা–কর্মীদের ওপর নির্ভর করে একটা গণ-অভ্যুত্থান ঘটানো যায় না। এ জন্য দরকার গণজাগরণ। দ্বিতীয়ত, তারা যে কথাগুলো বলছে, তা নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া। এতে ভোটে যদি জনগণের রায়ের কোনো প্রতিফলন না ঘটে বা কোনো পক্ষ যদি ঘটাতে না দেয়, তাহলে জনগণই তাদের পক্ষে দাঁড়াবে। তৃতীয়ত, তারা নির্বাচন বর্জন করতে পারে। জাতীয় পার্টি তখন ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, অন্য দলগুলোও আসবে। কোনো প্রতিযোগিতা না থাকলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনেও কোনো আপত্তি থাকবে না। তাই এই নির্বাচন বিএনপির জন্যও অগ্নিপরীক্ষা।
প্রথম আলো: কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবেশ কী আছে? বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা। নির্বাচনের আগেই যেন সব রায় হয়ে যায়, সে জন্য রাতেও আদালত বসছে। এ অবস্থায় কীভাবে বিএনপি আসলে আস্থা পাবে?
হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি গণতান্ত্রিক পথে থাকলে এত মামলা হতো না। ২০১৪ সালে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে তারা পাঁচ শ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। রাজনৈতিক দলের তো জনগণের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার কথা নয়। বরং সুরক্ষা দেওয়ার কথা। ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত যখন সরকারে এল, তখন কী করেছে? জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে। কিন্তু দলের সদস্য কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে বিচারপতির বয়স ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাড়িয়ে দিলেন। ফলে এই ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হলো। পঞ্চদশ সংশোধনী যখন হলো, এর আগে ১৫ সদস্যের সংসদীয় কমিটি করা হয়েছিল। সেখানে বিএনপির দুজন সদস্যকেও রাখা হয়েছিল। তারা যদি কমিটিতে থাকত, তাহলেও কথা বলতে পারত। ইয়াজউদ্দিন সাহেব কী করলেন? রাষ্ট্রপতি থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে গেলেন। এরপর তো এক–এগারো হলো। আসল সমস্যা হলো আমরা রাজনীতির চর্চা করি। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে মূল্যবোধ, তার কি চর্চা আছে?
প্রথম আলো: আপনি ২০১৪ সালে নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে নাশকতা মামলার প্রসঙ্গ টানছেন। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের মামলা হয়েছে। এটাকে আপনি কী বলবেন?
হারুন-অর-রশিদ: যুগে যুগে শাসকগোষ্ঠী এমনই করেছে। কেউ কি চায় তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী কেউ দাঁড়াক? তাদের তো চেষ্টাই থাকবে শক্তিশালী পক্ষকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তারা কেন সেই ট্র্যাপে (জালে) পা দেবে? এই যে বিএনপি এক দফা দাবিতে চলে গেল। বিএনপি তো নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসতে পারত। বঙ্গবন্ধু তো ইয়াহিয়া খানের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। তিনি কি দেশ স্বাধীন করার পরিকল্পনা থেকে তাই বলে বেরিয়ে এসেছিলেন?
প্রথম আলো: অনেকেই মনে করেন, সরকার পরিবর্তন হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে? এই সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে মানুষের নাভিশ্বাস...
হারুন-অর-রশিদ: কিন্তু পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, আশ্রয়ণ প্রকল্পও তো এই সরকার করেছে। বিএনপি কি দৃষ্টান্তমূলক একটা কিছু দেখাতে পারবে? মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি আছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আছে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু মানুষের কাছে তো বিকল্প নেই।
প্রথম আলো: সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপের যে অভিজ্ঞতা, তাতে বিএনপি আস্থা পাবে কী করে? আমরা তো এর আগেও সংলাপ হতে দেখেছি...
হারুন-অর-রশিদ: দুই পক্ষেই আস্থার সংকট আছে। আস্থা তৈরি করতে হলে ছাড় দিতে হবে। আমরা তো ছাড় দেওয়া–দেওয়ির মধ্যে নেই। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (প্রতিযোগিতার জন্য সমতলভূমি) সৃষ্টি হয় কীভাবে? দুই পক্ষেরই শক্তি-সামর্থ্য থাকতে হয়। মাঠ ছাড়ব না এই মনোভাব থাকতে হয়, যাকে বলে শক্তির ভারসাম্য। তবে অবশ্যই সেটা আইনের মধ্যে থেকে। সেটাকে বাদ দিয়ে কিছু হবে না।