প্রাথমিক বিদ্যালয়: নতুন বাংলাদেশে বিস্কুট ফিরে আসুক

স্যাটেলাইট প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিটিআই প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত আট থেকে নয় ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ভ্রাম্যমাণ বা বেদে সম্প্রদায়ের শিশুরাও যাতে যাযাবর অবস্থায়ও শিখতে পারে, সে ব্যবস্থাও আছে। অর্থাৎ ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী যেকোনো শিশুর জন্য বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে সব পরিস্থিতিতেই প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। তবু এ বছর সাত লাখ শিশু কম ভর্তি হয়েছে গত বছরের তুলনায়। কেন?

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে প্রশিক্ষণ পান, তা অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা পান না। কিন্ডারগার্টেন বা মাদ্রাসার শিক্ষকদের সঙ্গে প্রাথমিকের শিক্ষকদের গুণগত তফাতও রয়েছে। তবু কেন প্রাথমিকের শিশুরা প্রাথমিক ছেড়ে ওই সব প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে? বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের সংগঠক ও শিক্ষক লিপি দেবগুপ্তা বলেন, ‘আগে কাজের মৌসুম ছাড়া সব সময় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল। এখন সারা বছরেই নেই।’

দুই.

একসময় এসব প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার জনগণই গড়ে তুলেছেন। তবু তা আজ ভেতরে-ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে কেন? তাহলে কি স্কুলগুলো সমাজের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না? যেসব শিক্ষক স্কুলগুলোয় পড়ান, তাঁরা এলাকাবাসীর সঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছেন না? এই কারণে ৫০০ টাকা ফি দিয়েও গরিব মানুষটি সন্তানকে কিন্ডারগার্টেনে দিচ্ছেন?

মানুষ চাঁদে গেল। বাংলাদেশ বেশি রপ্তানি দেখিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হলো। আর সেই মধ্যম আয়ের দেশের শিশুরা, আগামী দিনের কর্ণধারেরা দুপুরে না খেয়ে থাকে।

তিন.

আগে উপবৃত্তিতে প্রধান শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যে শিক্ষার্থী জানুয়ারি মাসে নিয়মিত হলেও ফেব্রুয়ারি মাসে নিয়মিত ছিল না, তার নাম প্রধান শিক্ষক বাদ দিতে পারতেন। এখন ছয় মাস পরপর নাম পাঠাতে পারেন। এ বিষয়ে রংপুরের কাউনিয়ার সারাঙ্গপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও কবি নাফিদা নওরীন (৩৫) বলেন, ‘যে উপবৃত্তি পায় না, সে পায়ই না। বারবার কারেকশন করার পরেও পায় না। এতে অভিভাবকদের কাছে শিক্ষকদের সম্মান ও গুরুত্ব নষ্ট হয়।’

আর যে শিশুটি একবার উপবৃত্তি পেল, তার আর সারা বছর স্কুলে না এলেও চলে। আর শিক্ষার্থীটি একবার পেল না, সে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। বিদ্যালয়ে আর আসে না। অন্যদিকে শিক্ষকদের হাত থেকে টাকা পাওয়ার বদলে মুঠোফোনে টাকা আসায় মনস্তাত্ত্বিকভাবেও শিক্ষকদের গুরুত্ব আর থাকছে না।

চার.

বিস্কুট খাওয়ার পর শিশুদের স্বাস্থ্যের কী কী উন্নতি হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। শিশুদের উচ্চতা, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু জায়গায় উন্নতি দেখা গিয়েছিল প্রতিবেদনগুলোতে। সেই বিস্কুট যে করোনার বিধিনিষেধে লক খেয়ে গেল, আর খোলার নামগন্ধ নেই।

এরপর কত মধুমাখা বুলিতে সাবেক সরকারের মন্ত্রী–আমলারা দুপুরে ডিম-দুধ, না ডিম-খিচুড়ি দেবেন, সেই তর্ক কিছুদিন চালালেন। বিস্কুট আর ফিরল না। উপবৃত্তির টাকা মুঠোফোনে তিন মাসে ছয় মাসে মায়ের কাছে চলে যায়, কিন্তু বিস্কুট সরাসরি শিক্ষার্থী পায়। শিশুদের কাছে দুপুরের আহারটা জরুরি। শতভাগ শিক্ষকই একবাক্যে জানিয়েছেন, দুপুরের বিস্কুট শিশুদের স্কুলে ফেরাতে পারে। শিশুর কাছে দুপুরের এক বেলা আহার জরুরি।

গরিব গর্ভবতীরাও পাশের বিদ্যালয় থেকে বিস্কুট চেয়ে খেতেন। এতে গর্ভের সন্তানও উপকৃত হতো। চিলমারী ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারজানা জেনি (৩০) জানান, ‘খিচুড়ি থাক, আপাতত বিস্কুটটাই দিন। নইলে আগামী বছর স্কুলগুলোতে বাচ্চা খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

মানুষ চাঁদে গেল। বাংলাদেশ বেশি রপ্তানি দেখিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হলো। আর সেই মধ্যম আয়ের দেশের শিশুরা, আগামী দিনের কর্ণধারেরা দুপুরে না খেয়ে থাকে। এক প্যাকেট বিস্কুটের আশায় স্কুলে আসে। তা–ও এখন বন্ধ হয়ে আছে। নতুন বাংলাদেশে অন্তত বিস্কুটটি জুটুক।

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক

[email protected]