সুশাসন ও নীতিগত সহায়তা জরুরি

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রতিবেদনে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা একদিকে আশাব্যঞ্জক, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জপূর্ণ। প্রতিবেদনে অর্থনীতির তিনটি প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে রপ্তানিবাজার, প্রবাসী শ্রমিকদের আয় ও সরকারি বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। আমরা যদি ধরেও নিই সরকারি বিনিয়োগ ও প্রবাসী আয়ের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকবে, তারপরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জোর গলায় প্রচার চালাচ্ছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে, কিন্তু সেই সড়কে খানাখন্দগুলো ভরাট করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তাঁরা নিয়েছেন বলে জানা নেই। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা এক পা এগোই তো দুই পা পিছিয়ে পড়ি।

ব্যবসায় খরচ বাড়ানোর যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, অর্থায়নে ঘাটতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, উচ্চ করহার, কর্মীদের শিক্ষার ঘাটতি, নৈতিকতার নিম্নমান ও নীতিগত স্থিতিশীলতা। এর কোনোটিকে উপেক্ষা করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ১২ বছর একটানা তারা ক্ষমতায় থাকার পর দুর্নীতির পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা। দুর্নীতি থাকলে অদক্ষতা বাড়বেই। আবার দুর্নীতি থাকলে নৈতিকতার মানেরও অবনতি হবে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা উন্নয়নের যতই ফিরিস্তি দিন না কেন ব্যবসার প্রধান তিন মাধ্যম সড়ক, রেলপথ, বন্দর ও বিমান পরিবহনে আমরা পিছিয়ে আছি। চীন–ভিয়েতনাম তো বটেই; ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকেও কনটেইনারে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশে খরচ বেশি, বন্দরে পণ্য খালাস করতেও সময় বেশি লাগে। এসব সমস্যার পাশাপাশি স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণকালে বাংলাদেশকে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, তাতে ব্যবসার খরচ আরও বেড়ে যাবে। এ কারণেই ব্যবসায়ীরা সরকারের নীতিগত সহায়তা তথা করহার কমানোর ওপর জোর দিয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তার আরেকটি কারণ হলো উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কারণে রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০২৬ সাল থেকে বিদ্যমান শুল্কসুবিধা উঠে যাবে। এতে রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমে যেতে পারে। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কয়েকটি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে। এর ফলে দেশটি ওসব দেশে শুল্কসুবিধা পাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতে পারে; যা ব্যবসার খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে।

এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে এখনই কৌশল খুঁজে বের করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে। প্রতিবেশী কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর চেয়ে করহার বেশি হলে পণ্যের দামও বেশি পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত তা ব্যবসা-বাণিজ্যকে চাপে ফেলবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে শুল্কহারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে এখনই আলোচনা শুরু করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ কমানোর বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া।

ব্যবসায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের বাড়তি খরচ বা লোকবলের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যেসব আইন আছে, তার যথাযথ প্রয়োগ।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রতিবেদনে কেবল নেতিবাচক কথাই বলা হয়নি। করোনাকালে সরকারের নীতিগত সহায়তার কারণে অর্থনীতির চাকা যে সচল ছিল, তারও সপ্রশংস উল্লেখ ছিল।