রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় সিট-বাণিজ্য, হলে শিক্ষার্থীদের হয়রানি-নিপীড়ন ও শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। গত সোমবার দুপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনসংলগ্ন প্যারিস রোডে মানববন্ধন করেন তাঁরা। ক্যাম্পাসে দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করার বহু নজির থাকলেও শিক্ষক ও অভিভাবকদের এ রকম কর্মসূচিকে ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।
অভিযোগ আছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তুচ্ছ অজুহাতে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দিচ্ছেন। ফলে যাঁদের নামে আসন বরাদ্দ আছে, তাঁরা হলে থাকতে পারছেন না। থাকছেন ছাত্রলীগ নামধারী বহিরাগতরা। সোমবার মানববন্ধন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া এক শিক্ষক খেদের সঙ্গে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে হল থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের বড় অবমাননা।’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট-বাণিজ্য ও দখলদারি চলে আসছে অনেক বছর ধরেই। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্রসংগঠনটিই এ কাজ করে থাকে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব অনাচার কেবল মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে না, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যায়কারীদের মদদও দিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের আসন বণ্টন ও বরাদ্দের দায়িত্ব হল প্রশাসনের। এখানে ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের কিছু বলার থাকতে পারে না। এমন অভিযোগও আছে, সাত থেকে আট বছর আগে ছাত্রত্ব হারিয়েও একশ্রেণির ছাত্রলীগ কর্মী তথ্য সেল, প্রচার সেল ইত্যাদি নামে হলে থাকছেন। যাঁদের পছন্দ তাঁদের হলে রাখছেন; যাঁদের অপছন্দ, তাঁদের হল থেকে বের করে দিচ্ছেন।
এ ঘটনা কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য। আসন বরাদ্দের বিষয়েও তাঁরা হল প্রশাসনের ওপর খবরদারি করে থাকেন। গত বছর খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) একটি আবাসিক হলের ক্যানটিনের ব্যবস্থাপক নিয়োগের বিষয়ে এক শিক্ষককের ওপর ছাত্রলীগ ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রাখে।
ওই শিক্ষক সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শিক্ষকদের অপমান করা, হুমকি দেওয়া, গালাগাল করা সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকেরা সিট-বাণিজ্য ও দখলবাজির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানাই। তাঁরা যথার্থই শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাঁদের অনুসরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিলে পরিস্থিতি বদলের একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে।
একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে মূক ও বধিরের ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে, তার নিন্দা জানাই। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তব্য হবে কিসের ভিত্তিতে তারা কাকে আসন বণ্টন ও বরাদ্দ করল, তা ওয়েবসাইটে বা বিজ্ঞপ্তি আকারে জানিয়ে দেওয়া। বহিরাগতদের হলে থাকার ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা হল প্রশাসনের কাছে সব শিক্ষার্থীই যেন সমান বিবেচিত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোন শিক্ষার্থী কোন ছাত্রসংগঠন করেন, তা বিবেচনায় নেওয়া সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। মেধার ভিত্তিতে যে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের ক্লাস করা, পরীক্ষা দেওয়া এবং আসন বরাদ্দের বিপরীতে হলে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের এই দায়িত্ব পালনে সজাগ ও সচেষ্ট থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত।