আন্তর্জাতিক গেমস এলেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে শুরু হয় আশা-নিরাশার দোলাচল। সম্ভাব্য ফল নিয়ে কাটাছেঁড়ায় নামেন বিশ্লেষকেরা। সাউথ এশিয়ান গেমস বা এসএ গেমস ঘিরে সেটি একটু বেশিই দেখা যায়। কারণ, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আসল সামর্থ্যটা বোঝার জন্য এই গেমস উপযুক্ত মঞ্চ। ১৯৮৪ সালে নেপালে এসএ গেমস শুরুর পর এক আসরে বাংলাদেশের অর্জন ছিল সর্বোচ্চ ১৮টি সোনা। ২০১০ সালে যা এসেছিল দেশের মাটিতে তৃতীয়বারের আয়োজনে। এবার নেপালে ১৩তম গেমসে সব ছাপিয়ে রেকর্ড ১৯টি সোনা পেয়েছে বাংলাদেশ। সঙ্গে রেকর্ডসংখ্যক ৩৩টি রুপা ও ৯০টি ব্রোঞ্জ। পদকের বিচারে এ গেমসে এটিই বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। এ জন্য বাংলাদেশ দলকে অনেক অনেক অভিনন্দন।
১৯টি সোনায় বড় অবদান রেখে একটু বেশিই অভিনন্দন পাবেন লাল-সবুজের মেয়েরা। ৬টি ব্যক্তিগতসহ মোট ১১টি সোনার সঙ্গে যুক্ত তাঁরা। এতেই বোঝা যায়, খেলাধুলায় বাংলাদেশের মেয়েরা দ্রুত অগ্রসরমাণ। আর্চারির ইতি খাতুন ব্যক্তিগত, দলীয় ও মিশ্র দলগতে দারুণ সাফল্য দেখান। বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে এই প্রথম এসএ গেমসে ৩টি সোনা জিতলেন তিনি। এখন এই মেয়েদের জন্য নিরাপদ এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন একটি ক্রীড়াঙ্গন নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। কেননা, ক্রীড়াঙ্গনের পরিধি বাড়ছে। ১-১০ ডিসেম্বর কাঠমান্ডু, পোখরাসহ নেপালের তিনটি শহরে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার ‘অলিম্পিকে’ ২৬টি খেলার মধ্যে ২৫টিতেই দল পাঠায় বাংলাদেশ। তবে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ নিশ্চিত ছিল না কেমন সাফল্য আসবে। সব অনিশ্চয়তা দূর করে খেলোয়াড়েরা দেশের সম্মান রেখেছেন।
কিন্তু এতেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ, ১৯টি সোনার ১০টিই এসেছে আর্চারিতে। গেমসে আর্চারিতে সোনা ছিল এই ১০টিই। আমরা জানি, আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ থাকায় এই অঞ্চলে পরাশক্তি ভারত এবার সাউথ এশিয়ান গেমস আর্চারিতে অংশ নিতে পারেনি। অথচ ২০১৬ গেমসে আর্চারির ১০টি পায় ভারত। বাংলাদেশ পেয়েছিল ৩টি করে রুপা ও ব্রোঞ্জ। তার আগের দুটি গেমসে আর্চারিতে বাংলাদেশে ২টি রুপা ও ৪টি ব্রোঞ্জ জেতে। সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের আর্চারি এবার এগিয়ে চলার স্বাক্ষর রেখেছে নেপালে।
শুধু আর্চারি নয়; ক্রিকেট, কারাতেসহ আরও কয়েকটি খেলায় দল পাঠায়নি ভারত। এতে বাংলাদেশের সোনা গতবারের ৪টি থেকে একলাফে ১৫টি বেড়েছে। আর্চারির ১০টি বাদে বাংলাদেশ সোনা জিতেছে কারাতেতে ৩টি, ক্রিকেটে ও ভারোত্তোলনে ২টি করে, তায়কোয়ান্দো ও ফেন্সিংয়ে ১টি করে। এর উল্টো পিঠের হতাশা হচ্ছে, অনেক খেলাতেই বাংলাদেশের বড় রকমের দুর্বলতা আবার ফুটে উঠেছে। ভলিবল, বাস্কেটবল, সাইক্লিং, টেনিসে কোনো পদকই পায়নি বাংলাদেশ। অ্যাথলেটিকসে অর্জন একটি রুপা। এই খেলায় বাংলাদেশ ২০০৬ সালের পর গত ৩টি গেমসে একটিও সোনা জিততে পারেনি। বাংলাদেশের পক্ষে সাউথ এশিয়ান গেমসে সর্বোচ্চ ২২টি সোনা জেতা শুটিং এবার ফিরেছে সোনা ছাড়াই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭টি সোনা জেতা সাঁতার দল চরম হতাশ করেছে। গতবারের ২টি সোনা হারিয়ে সাঁতার এবার নিঃস্ব। টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টনের মতো খেলাগুলোয় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রীড়ায় বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে, পরিসংখ্যানই তা বলবে। ১৩টি এসএ গেমসে ২ হাজার ৪৫টি সোনার মধ্যে মাত্র ৮৬টি জিতেছে বাংলাদেশ, যা মোট সোনার মাত্র ৪ শতাংশের একটু বেশি। ভারত ১ হাজার ২৬২, পাকিস্তান ২৯৯, শ্রীলঙ্কা ২৫০, নেপাল ১২৪টি সোনা জিতেছে। লক্ষণীয়, এবার রেকর্ড ১৯টি সোনা জিতলেও পদক তালিকায় বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানেই রয়ে গেছে। ৭ দেশের প্রতিযোগিতায় পঞ্চম হওয়া মোটেও সন্তুষ্টির নয়। আমাদের উচিত এখনই দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিয়ে ধাপে ধাপে এগোনোর চেষ্টা করে যাওয়া। চেষ্টা করলে যে সাফল্য আসে, আর্চারির দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট।