বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে যে যিশুর জন্ম হয়েছিল, তিনিই পরে আবির্ভূত হন ত্রাতা হিসেবে। হিংসা, বিদ্বেষ, পঙ্কিলতার বদলে মানুষকে ভালোবাসা, করুণা, মিলন ও সুন্দরের পথ দেখিয়েছেন তিনি। খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুর জন্মের মুহূর্তটি তাই শুধু এই ধর্মাবলম্বীদের জন্যই নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এক উৎসবের মুহূর্ত।
এ বছর বড়দিন উদ্যাপিত হচ্ছে এক ভিন্ন বাস্তবতায়। যিশুর সেই ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণার এক বিস্তৃত ও নবমঞ্চায়ন হচ্ছে যেন। গোটা মানবজাতিই আজ সংকটাপন্ন। এত দিনের এত অর্জন, জীবনের গতি—সবই এক লহমায় থমকে দাঁড়িয়েছে। নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এক বিস্ময়কর নীরবতার জন্ম দিয়েছে সারা বিশ্বে। এই বিনাশী নির্জনতায় মানুষ তটস্থ হয়ে উঠেছে, হাঁসফাঁস করছে। মুক্ত হাওয়ায় আগের মতো শ্বাস নিতে সবার মন আইঢাই করছে। কিন্তু সেই শুভক্ষণ যেন দেখাই দিতে চাইছে না।
করোনাভাইরাসে সারা বিশ্বের ১৭ লাখের বেশি মানুষ এরই মধ্যে মারা গেছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৭ কোটি ৯০ লাখের বেশি মানুষ। গত এক শতকে এত ভয়াবহ মহামারি দেখা যায়নি। এই শীতে সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। অথচ এরই মধ্যে কোভিড-১৯ রোগের কিছু কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতির দেখা মানুষ পেয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে করোনার টিকাও, এরই মধ্যে যার প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে দেশে দেশে। কিন্তু তাও ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং সবার পিলে চমকে দিয়ে যুক্তরাজ্যে মিলেছে ভাইরাসটির বিবর্তিত একটি রূপের সংক্রমণের প্রমাণ। নতুন এই স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে এখন মানুষকে আবার লড়াইয়ে নামতে হবে।
করোনাভাইরাস শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, ধসিয়ে দিয়েছে অর্থনীতিকেও। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এই শীতে টিকা দেওয়া শুরু হলেও মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। ফলে এই বড়দিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বের জন্যই যিশুর আগমনের মর্মবাণীটি সামনে নিয়ে এসেছে।
বড়দিন মানে উৎসব, বেড়াতে যাওয়া, আনন্দে মেতে ওঠা—এ সত্য। তবে এটা বাইরের সত্য; আচারিক সত্য। আর এর ভেতরের সত্যটি হচ্ছে মানুষের প্রতি, সব প্রাণের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি, করুণা ও সুন্দরের চর্চা। এবারের বড়দিন এই অন্তর্নিহিত সত্যকেই আচারে প্রকাশ করার দাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যবারের মতো উৎসব আয়োজন ও হইহল্লা যদি বিদ্যমান সংকটকে বাড়িয়ে তোলার ঝুঁকি তৈরি করে, তবে সে পথে না হাঁটাই হলো সুন্দরের পথ। জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কী আছে? তাই এ জীবন রক্ষার্থে প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের একমাত্র পথ এবার সতর্ক আচরণ করা। গত থ্যাংকসগিভিং ডের ছুটিতে এমন কিছু অপরিণামদর্শী আচরণ মানুষ করেছে, যার জের এখনো টানতে হচ্ছে মার্কিনদের। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা একটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষ স্বাস্থ্য সতর্কতা না মানলে এই স্বস্তি আর থাকবে না।
যিশু যে মানবিক আদর্শের বাণী প্রচার করে গেছেন, তা সর্বকালে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর শান্তির বাণী শাশ্বত। যিশুর আহ্বান ও আত্মত্যাগ সব অশুভ ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে। যিশুর সংযম, সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসার শিক্ষা হোক সবার পাথেয়। এই বড়দিনে এই তিন মর্মবাণীকে বুকে ধারণ করে মানুষ আবার স্বস্তির সময় ফিরিয়ে আনবে—এটাই প্রত্যাশা।