বাংলাদেশে মাদকাসক্তির সমস্যা যতটা ব্যাপক, এর সমাধানের জাতীয় উদ্যোগ সে তুলনায় একেবারেই ক্ষুদ্র। সারা দেশে বিপুলসংখ্যক তরুণ ও যুবক এ দুরারোগ্য আসক্তির শিকার; কিন্তু মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে মাত্র চারটি। আর সেগুলোর অবস্থা এতই শোচনীয় যে সংবাদমাধ্যমে ‘নিরাময় কেন্দ্রেরই চিকিৎসা দরকার’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। ঢাকার তেজগাঁওয়ে একটি এবং চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে একটি করে—এ চার সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, চিকিৎসকসহ অন্যান্য লোকবলের ঘাটতি অত্যন্ত প্রকট। পরিবেশ এমন শোচনীয় যে রোগীদের নিরাময় দূরে থাক বরং জীবাণুঘটিত নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা কত, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক ১৯ হাজার মাদকাসক্ত রোগীর মধ্যে এক জরিপ চালিয়ে এমন একটি অনুমানে পৌঁছেছেন যে এ দেশে মোট মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ লাখের বেশি হতে পারে। কিন্তু ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা জরিপের সূত্রে প্রথম আলোয় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, সংখ্যাটি ৬৬ লাখ।
বিভিন্ন গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রতি ১০ জনের একজন চিকিৎসার বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্রের শরণাপন্ন হয়। এ হিসাব থেকে বলা যেতে পারে, এ দেশে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় লাখ মাদকাসক্ত মানুষের চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর খুবই কমসংখ্যক মাদকাসক্তের চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য আছে। তারা সারা বছরে মোট ১৫ হাজারের মতো রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারে। বলা বাহুল্য, সেই চিকিৎসার মানও ভালো নয়। তা ছাড়া নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা গ্রহণের পর রোগীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে কিছুদিন কাটাতে হয়; কিন্তু পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে স্থান সংকুলান হয় না বলে অধিকাংশ মাদকাসক্ত রোগী বাড়ি চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে মাদকাসক্তি থেকে অধিকাংশেরই নিরাময় ঘটে না।
মাদকাসক্তদের চিকিৎসা, নিরাময় ও পুনর্বাসনের সরকারি উদ্যোগের এ সীমাবদ্ধতার কারণে বেসরকারি উদ্যোগে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে গড়ে উঠেছে অজস্র নিরাময় কেন্দ্র। প্রথম আলোয় গত শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য ঢাকাসহ দেশের ৪৪টি জেলায় ৩৫১টি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র আছে। সেগুলোর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই আছে ১০৫টি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, সরকারের অনুমোদন ছাড়াই মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দিচ্ছে এমন অবৈধ নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা অনুমোদনপ্রাপ্ত কেন্দ্রের কয়েক গুণ হতে পারে। কিন্তু সেগুলোতেও চিকিৎসকের ঘাটতি আরও বেশি। সেগুলোতে চিকিৎসার নামে যা চলছে, তাতে রোগী সুস্থ হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে ঢাকার আদাবরে ‘মাইন্ড এইড অ্যান্ড সাইকিয়াট্রি ডি-অ্যাডিকশন’ নামের এক বেসরকারি হাসপাতালে আনিসুল করিম নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা রোগীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা এবং এর ফলে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটির কথা। বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে রোগীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া ও নির্যাতন করা। শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে মাহফুজুর রহমান নামের এক সাবেক মাদকাসক্ত রোগীর মানিকগঞ্জের এক নিরাময় কেন্দ্রে নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা ছাপা হয়েছে। তাঁকে প্রায়ই মারধর ও অপদস্থ করা হতো। তাঁর মতো মাদকাসক্ত অনেক রোগীর আত্মীয়স্বজনের ভাষ্য থেকেও জানা যায়, বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে রোগীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা দৈনন্দিন চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এসব বন্ধ করা দরকার। সে জন্য সরকারের নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি উদ্যোগ বাড়ানো দরকার। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার অবসান ঘটাতে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।