মহামারি মোকাবিলা

সম্পাদকীয়

করোনা মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে হাসপাতালগুলো যখন অক্সিজেন-সংকটে ভুগছে, তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) উদ্ভাবিত ডিভাইস (যন্ত্র) আশার আলো দেখাতে পারে।

বাংলাদেশের হাসপাতালে সাধারণ বেডে রোগীকে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়, এর বেশি অক্সিজেনের ক্ষেত্রে রোগীর হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা লাগে অথবা তাঁকে আইসিইউতে নিতে হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ হাজার ৭১৪ হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ১ হাজার ৫৯টিই রয়েছে ঢাকা বিভাগে। ৫৬টি হাসপাতালে আছে ৫টির কম এবং ১৫টি হাসপাতালে এর সুবিধাই নেই। অতএব অবিলম্বে ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে অধিক আক্রান্ত জেলার হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতেই হবে।

অক্সিজেন সরবরাহে বুয়েটের ডিভাইসটি ব্যবহার করা হলে প্রতি মিনিটে ৬০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। অক্সিজেট নামের এই ডিভাইস তৈরির পর প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও হয়েছে। যদিও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) অনুমোদন না পাওয়ায় সেটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

আইনানুযায়ী চিকিৎসাসংক্রান্ত কোনো যন্ত্রপাতি ও উপাদান কারখানায় তৈরি করার পর বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অনুমতি দিয়ে থাকে। কিন্তু বুয়েটের ডিভাইসটি কোনো কারখানায় তৈরি হয়নি; হয়েছে বুয়েটের গবেষণাগারে। ডিভাইসটি যদি মানসম্মত হয় এবং কোনো ঝুঁকি না থাকে, তাহলে কারখানায় তৈরি নয়—এ দোহাই দিয়ে অনুমোদন আটকে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। একজন আইনজীবী বুয়েটের ডিভাইসটি সম্পর্কে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাননীয় বিচারক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলেছেন। সম্প্রতি অক্সিজেন-সংকটের কারণে সাতক্ষীরা ও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ১২ জন রোগী মারা গেছেন।

আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য, ঔষধ প্রশাসনের আইন বা বিধির বাধ্যবাধকতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতি বা মহামারিকালের হিসাব-নিকাশ আলাদা হতে হবে। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সময়সাপেক্ষ কিছু কাজ বা সিদ্ধান্ত জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে মানুষের জীবন রক্ষার সম্পর্ক রয়েছে।

তবে করোনা চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে অক্সিজেনের স্বল্পতাই একমাত্র সমস্যা নয়। স্বাস্থ্যসেবা খাতের পরতে পরতে সমস্যা। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে অনেক হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, প্রয়োজনীয় শয্যা ও যন্ত্রপাতিও নেই। করোনায় আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করারও প্রয়োজন নেই। যাঁদের অবস্থা গুরুতর নয়, অস্থায়ী ক্যাম্প করেও তাঁদের চিকিৎসা দেওয়া যায়। অর্থাৎ এ মুহূর্তে রোগী ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জরুরি। পাইকারি হারে চিকিৎসকদের বদলি না করে স্থানীয়ভাবে বেসরকারি চিকিৎসকদের সহায়তা নিলে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বেশি সুফল পাওয়া যেত।

গত বছর করোনার সংক্রমণ যখন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে কেন্দ্রীভূত ছিল, তখন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে শহর এলাকাকে অগ্রাধিকার দেওয়া অযৌক্তিক ছিল না। বর্তমানে সারা দেশেই করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় গ্রাম থেকে দলে দলে রোগী ঢাকায় আসতে থাকলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে, যার আলামত ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে।

রোগীকে হাসপাতালে না এনে যতটা সম্ভব রোগীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। হাসপাতালে রোগী একা আসেন না। তাঁর সঙ্গে আত্মীয়স্বজন থাকেন। এভাবে একজন থেকে অপরজনে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। যেসব রোগীকে বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়, তাঁদের নিকটবর্তী হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে িচকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত না করে গ্রামাঞ্চলেও চিকিৎসাসেবার সুযোগ ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।