চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্যের দাম যখন বেড়ে চলেছে, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, পণ্যের দাম ওঠানামার পেছনে একটা সিন্ডিকেট সব সময় কাজ করে। একই সঙ্গে তিনি পণ্যের দাম বাড়ার জন্য করোনা পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আগের অবস্থায় না থাকা কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, সরকার সিন্ডিকেটের কাছে হার মানেনি, সিন্ডিকেট ভাঙতে কাজ করছে।
‘সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার কাজ করছে’—এ ধরনের কথাবার্তা মন্ত্রীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু সেই সিন্ডিকেটের চেহারা-চরিত্র কী, সেটি জানা যায় না। সিন্ডিকেট বরাবর অধরাই থেকে যায়। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যতই বলেন বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেবেন, ততই তারা আরও সংহত হয়। কোনো পণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে মন্ত্রী-আমলাদের কিছু তৎপরতা দেখা যায়। কোথাও কোথাও ব্যবসায়ীদের আড়তে অভিযান চলে, কোনো কোনো খুচরা ব্যবসায়ীর জেল-জরিমানাও হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালেরা আড়ালে থেকে যান। কিছুদিন আগে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল, তেমনি অতি সম্প্রতি আলুর বেলায়। ব্যবসায়ীদের কারসাজির কাছে সরকার পেরে ওঠে না। যদি সরকার ডালে ডালে তাদের খোঁজে, তারা চলে পাতায় পাতায়।
বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে সেটি কমার উদাহরণ নেই। গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে বৈঠকে ভোজ্যতেল আমদানিকারকেরা মিলগেটে খোলা ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটারে ২ টাকা কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন দাম অনুযায়ী, এখন থেকে মিলগেটে খোলা সয়াবিন তেল ৯০ ও পাম তেল ৮০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হবে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ঢাকার খুচরা বাজারে এখন খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ৯২ থেকে ৯৭ টাকা দরে বিক্রি হয়, যা এক বছর আগের তুলনায় প্রতি লিটারে ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি। ২ টাকা কমানোর পরও ভোক্তাদের বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করোনা সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারের উদাহরণ টেনেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্য দাম বাড়েনি, সেসব পণ্যের দাম কেন দেশি বাজারে বাড়বে? এর পেছনেই সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে। আগে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীরা আমদানি করতেন। এখন গুটি কয়েক বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে পণ্য আমদানি করে এবং ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেয়।
পেঁয়াজ সংকটের সময় ছোটখাটো সিন্ডিকেটের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, যারা মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ কেনা দামের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের যৌথ অনুসন্ধানে তাদের নাম উঠে এসেছে। এসব ব্যক্তি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের টেকনাফভিত্তিক পেঁয়াজ আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আড়তদার।
এসব ব্যবসায়ী মৌসুমি সিন্ডিকেট। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় সব সময় যে সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান হয় না। হবে কেমন করে? এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের নিবিড় ও নিগূঢ় সম্পর্কের কথাও কারও অজানা নয়। সরকার যদি সত্যি সত্যি বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে চায়, লোকদেখানো অভিযান চালানো কিংবা চুনোপুঁটিদের ধরলে কাজ হবে না; রাঘববোয়ালদেরও ধরতে হবে।
সেই সঙ্গে সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিং থাকতে হবে। পণ্যের দাম বাড়ার পর দৌড়ঝাঁপ না করে যাতে দাম না বাড়ে, সে জন্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে দাম বাড়বেই।