কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য মো. সোহেল হত্যার ঘটনা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ধারণা করা গিয়েছিল, হত্যা মামলার আসামিরা দ্রুত ধরা পড়বে এবং বিচারে সোপর্দ করা হবে। কিন্তু মামলার এজাহারভুক্ত তিন আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় সে আশা তিরোহিত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব কথিত বন্দুকযুদ্ধকে জনগণ বিশ্বাস করে না।
গত ২২ নভেম্বর কুমিল্লা নগরের পাথুরিয়াপাড়া থ্রি স্টার এন্টারপ্রাইজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলর মো. সোহেল ও তাঁর সহযোগী হরিপদ সাহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহত কাউন্সিলরের ছোট ভাই সৈয়দ মো. রুমন বাদী হয়ে ১১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৮ থেকে ১০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এই সূত্র ধরে পুলিশ আসামি গ্রেপ্তারে নামে এবং এই অভিযানে এজাহারভুক্ত তিন আসামি নিহত হন। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার যে ভাষ্য দিয়েছেন, তা আগের সব বন্দুকযুদ্ধের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া ভাষ্যের মতোই।
তিনি সেই পুরোনো কথাই বলেছেন, পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, কাউন্সিলর হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ও অজ্ঞাতনামা আসামিরা কুমিল্লা নগরের সংরাইশ ও নবগ্রাম এলাকায় অবস্থান করছেন। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও কোতোয়ালি মডেল থানা-পুলিশের একাধিক দল গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে ২৮ নভেম্বর অভিযান শুরু করে। রাত পৌনে একটার দিকে পুলিশ সদস্যরা গোমতী নদীর বেড়িবাঁধের কাছে পৌঁছালে আসামিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকেন। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এতে আসামি সাব্বির ও সাজন মারা যান। এর ৪৮ ঘণ্টা পর পুলিশের অপর অভিযানে মারা যান মামলার আরেক আসামি শাহ আলম।
সরকারের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের চেয়ে অনেক দক্ষ ও অভিযান চালানোর মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র ও লোকবল তাদের আছে। তারপরও আসামি ধরতে গিয়ে একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা কেন ঘটে? কেনই-বা আসামিকে তারা জীবিত ধরতে পারছে না? এর কোনো জবাব নেই। এটা যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, সেটা তাদের বিবেচনায় আছে বলে মনে হয় না। চার ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগের এক অংশের অনুসারী ছিলেন কাউন্সিলর সোহেল। এ নিয়ে গত দুই বছরে তিন আওয়ামী লীগ নেতা খুন হলেন। আসামিরা ধরা পড়লে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা রয়েছে বা বিরোধের মূল কারণ কী, তা বের হয়ে আসত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্দুকযুদ্ধের যে ব্যাখ্যাই দিক না কেন, এটি বিচারবহির্ভূত হত্যা ছাড়া কিছু নয়। এর মাধ্যমে শুধু মানুষের বিচার পাওয়ার পথই রুদ্ধ হচ্ছে না, আইন–আদালতের প্রতিও অনাস্থা প্রকাশ পাচ্ছে। বিএনপির আমলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ অভিযানের নামে বহু মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। তখন অন্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগও এর তীব্র সমালোচনা করেছিল। তদুপরি ২০০৮ সালে দিনবদলের নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। একটানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি উল্টো পথেই হাঁটছে। গত রোববার ভোলার চরফ্যাশনে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই জলদস্যু নিহত হয়েছেন। এর আগে নভেম্বরে কক্সবাজার, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামে বেশ কজন মারা গেছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৮৮ জন।
আমরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে বিচারবহির্ভূত হত্যা থেকে সরে আসার জন্য সরকারের প্রতি আবারও আহ্বান জানাই। আমরা সরকারকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ পথে কোনো দেশে অপরাধ দমন হয় না; বাংলাদেশেও হবে না।