গ্রামগঞ্জ বা মফস্বলে যাঁরা ‘মুরব্বি মানুষ’, শহরের অভিজাত শ্রেণির কাছে তাঁরা ‘সিনিয়র সিটিজেন’। একেবারে সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যতক্ষণ তাঁরা কর্মক্ষম বা ‘অর্থকরী’ থাকেন, ততক্ষণ তাঁরা বয়ঃকনিষ্ঠ স্বজনদের কাছ থেকে এই সমীহসঞ্জাত ‘মুরব্বি’ কিংবা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ সম্বোধনের সম্মান পান। কিন্তু প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে কর্মক্ষমতা অথবা চলনশক্তি হারিয়ে ফেললে এই লোকগুলোই হয়ে যান ‘ওল্ড হ্যাগার্ড’, সোজা বাংলায় ‘বুড়ো হাবড়া’।
যে দেশে রিকশার পেছনে পরম শ্রদ্ধায় লেখা হয়, ‘মায়ের দোয়া’ কিংবা ‘মা-বাবার দোয়া’, সেই একই দেশের প্রায় দেড় কোটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিকটজনের সঙ্গে থেকেও অরক্ষিত জীবন যাপন করছেন। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ বলছে, এঁদের মধ্যে ৫০ লাখ জনের আবাসনের নিশ্চয়তা নেই। তাঁদের একটি অংশ অতিদরিদ্র। অনেকের আর্থিক সামর্থ্য আছে। তারপরও তাঁদের খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত হয় না।
গবেষণা বলছে, পরিবারে রান্না হলেও এই প্রবীণদের ৮৯ শতাংশকে মাংস খেতে দেওয়া হয় না। ২১ শতাংশ প্রবীণ দিনে তিন বেলা খেতে পারেন না। নতুন প্রজন্ম তাঁদের এড়িয়ে চলে। হতাশা ও নিস্পৃহতা তাঁদের ঘিরে ধরে। অথচ স্বস্তিময় বার্ধক্য ও সম্মানজনক জীবনসায়াহ্ন তাঁদের প্রাপ্য।
যেসব অসমর্থ প্রবীণ-প্রবীণা বিভিন্ন গণপরিবহনে ওঠেন, তাঁদের জন্য দু-চারটি আসন আলাদা রাখলে ক্ষতি কী? ব্যাংক সুদেই যাঁদের চলতে হয়, তাঁদের হাফ পার্সেন্ট সুদ বাড়ালে কী এমন রাজকোষ খালি হবে?
আজ যাঁরা ষাটোর্ধ্ব, তাঁদের অনেকেই সন্তানের ‘ক্যারিয়ার’ নিয়ে ভেবেছেন। চেয়েছেন ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আজ জীবনসায়াহ্নে এসে অবাক বিস্ময়ে দেখছেন, ‘শিব গড়তে’ তাঁরা এমন এক স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম গড়ে ফেলেছেন, যাঁরা প্রবীণদের সেই আত্মত্যাগের মূল্য দেন না।
তাঁরা মনে করেন, ‘বুড়োগুলো’র প্রতি কোনো প্রকার দয়াদাক্ষিণ্য, সৌজন্য-শ্রদ্ধা দেখানোর দরকার নেই। এই ‘বুদ্ধিমান’ ছেলেমেয়েরা সাধারণত মা-বাপের খোঁজ রাখেন না। যাঁরা দায়ে পড়ে বৃদ্ধ-অসুস্থ মা-বাবার খোঁজ নেন, তাঁরাও হয়তো মনে মনে বলেন, ‘আপদগুলো গেলেই বাঁচি।’ তাঁদের ভাবনায় প্রবীণ-প্রবীণারা সমাজের জঞ্জাল।
আজ যাঁরা তরুণ, তাঁরাও একদিন সেই জঞ্জাল হিসেবে পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করবেন, সেই চরম সত্যটা বুঝতে হবে। সে অনুযায়ী, বিশেষত তরুণসমাজকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।