আসন্ন নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) মোট ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৩৯৪টি পাঠ্যবই ছাপাতে হবে। ছাপার কাজটি এনসিটিবি নিজে করে না, দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক দরে বিভিন্ন বেসরকারি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে এ কাজ দিয়ে থাকে। এ বছরও তারা সেই কাজ বিলিবণ্টন করে দিয়েছে। এখন তাদের ছাপা বই বুঝে নেওয়া বাকি। ইতিমধ্যে ডিসেম্বর মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। জানুয়ারির ১ তারিখের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছাতে হবে। কিন্তু খবর বেরিয়েছে, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর কারণে ৬ লাখের বেশি বই এনসিটিবি ইতিমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে। বই ছাপানোর কাজ পেয়েছে এমন প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন কাগজ নিম্নমানের বলে চিহ্নিত করে সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ, বিপুলসংখ্যক বই আবার ছাপাতে হবে। সেসব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে কত দেরি হবে, তা নিশ্চিত নয়।
এ রকম পরিস্থিতি প্রতিবছরই সৃষ্টি হয়। প্রতিবছরই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়, কিন্তু এ সমস্যার সমাধান ঘটে না। কারণ একাধিক। প্রথম কারণ, বই ছাপার কাজ যেসব মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়, তাদের অধিকাংশেরই প্রতারণামূলক পন্থায় অতিরিক্ত লাভ করার চেষ্টা। দ্বিতীয়ত এনসিটিবি সুষ্ঠুভাবে, যথাসময়ে গুণগত মানসম্পন্ন পাঠ্যবই মুদ্রণের বিষয়টি সামলাতে পারে না। প্রায় পাঁচ কোটি বই ছাপানোর জন্য কাগজ এনসিটিবি নিজে কিনে দেয়, বাকি প্রায় ৩০ কোটি বইয়ের কাগজ মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই কেনে। তাদের অনেকেই নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়ে অতিরিক্ত লাভ করার অপচেষ্টায় থাকে। সেই ব্যাপারটার যথাযথ নজরদারির সামর্থ্য এনসিটিবির নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।
কাগজের মান যাচাই করার জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ‘ইনডিপেনডেন্ট ইন্সপেকশন’ এবার তাদের একটি অভিজ্ঞতার কথা এনসিটিবিকে জানিয়েছে, যা থেকে মুদ্রণকারীদের একাংশের অসৎ পন্থা অবলম্বন সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি এক লিখিত অভিযোগে এনসিটিবিকে জানিয়েছে, নোয়াখালীর চৌমুহনীর অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান এই ৭৮ লাখ পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পেয়েছে; ইনডিপেনডেন্ট ইন্সপেকশনের প্রতিনিধি তাদের কাগজের নমুনা সংগ্রহ করে দৈবচয়নের ভিত্তিতে; কিন্তু অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের লোকজন সেসব নমুনার পরিবর্তে নিজেদের পছন্দমতো নমুনা নিতে ‘পীড়াপীড়ি’ করেন। ফলে যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানটি ওই মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কাগজের মান যাচাইয়ের কাজ শেষ করতে পারেনি।
এ প্রক্রিয়ায় এক জটিল সমস্যা হলো, মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বই ছাপানোর আগে মানসম্পন্ন কাগজ দেখিয়ে ছাপার অনুমোদন নিয়ে ছাপানোর সময় নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করলে এনসিটিবি বা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেই প্রতারণা ধরা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, বইয়ের সংখ্যা প্রচুর কিন্তু এনসিটিবির লোকবল ও নজরদারির সামর্থ্য কম।
কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার। সে জন্য প্রথম চেষ্টা হওয়া উচিত এনসিটিবির সামর্থ্য বাড়ানো; সম্ভব হলে সব বই ছাপার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ এনসিটিবি নিজেই কিনে মুদ্রণকারীদের দেবে এবং এটা নিশ্চিত করবে যে মুদ্রণকারীরা সেই কাগজেই বইগুলো ছাপবে। দ্বিতীয়ত, যেসব মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির নির্দেশিত মানের কাগজের চেয়ে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপবে, তাদের শাস্তি দেওয়া এবং তাদের কালো তালিকা তৈরি করে ঘোষণা দেওয়া যে তারা আর কখনো পাঠ্যবই ছাপার কাজ পাবে না।
আসন্ন নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্পন্ন কাগজে ছাপা বই পৌঁছানো নিশ্চিত করতে যদি কিছুটা দেরি হয়েও যায়, তবু মানের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না।